Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪,

জমে উঠেছে নাসিক ভোট উৎসব

আসাদুজ্জামান আজম, নারায়ণগঞ্জ থেকে ফিরে

জানুয়ারি ৮, ২০২২, ০৬:৪৫ পিএম


জমে উঠেছে নাসিক ভোট উৎসব

জমে উঠেছে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন (নাসিক) নির্বাচন। ভোটগ্রহণের দিন ১৬ জানুয়ারি সামনে রেখে মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীদের প্রচারণায় নারায়ণগঞ্জ এখন উৎসবের নগরীতে পরিণত হয়েছে। প্রার্থীরা ভোটারদের আকৃষ্ট করতে ওয়ার্ড, পাড়া-মহল্লায় ঘরে ঘরে গিয়ে ভোট চাচ্ছেন এবং ভোটারদের বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। বিশেষ করে নির্বাচনের প্রধান দুই হেভিওয়েট প্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভী  ও তৈমূর আলম খন্দকারের মধ্যে চলা পাল্টাপাল্টি অভিযোগ সময়ের সঙ্গে বেড়েই চলেছে।

উন্নয়নের নানা প্রতিশ্রুতির পাশাপাশি একে অপরের দিকে ছুড়ে দিচ্ছেন বিস্ফোরক মন্তব্য। তবে ভোট উৎসব কেন্দ্র করে ভোটারদের মধ্যে বাড়তি উৎসাহ বিরাজ করছে। প্রার্থীরা ভোট প্রার্থনায় বেরুলে ফুল ছিটিয়ে বরণ করে নিচ্ছেন ভোটাররা। নগরজুড়ে মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীদের নানা ধরনের গানের ছন্দে মাইকিং প্রচারণা, সমর্থকদের মিছিল ও স্লোগানে উৎসবমুখর বন্দরনগরীজুড়ে।

নাসিক নির্বাচনের ভোট উৎসবে সরব উপস্থিতি নিশ্চিত করেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগসহ সহযোগী সংগঠনগুলো। আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকা প্রতীকের প্রার্থী ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভীর বিজয় নিশ্চিতে কাজ করছেন কেন্দ্রীয় ও মহানগর নেতারা। 

এদিকে, নির্বাচনকে কৌশল হিসেবে নিয়েছে ক্ষমতাসীন দলের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি। স্বতন্ত্র প্রার্থী ও বিএনপি নেতা তৈমূর আলম খন্দকারকে বহিষ্কার করার ঘটনাকে আইওয়াশ বলছেন সংশ্লিষ্টরা। তৈমূর আলম খন্দকারকে বহিষ্কার করা হলেও দলটির দ্বিতীয় সারির কেন্দ্রীয় ও মহানগর নেতারা হাতি প্রতীকের পক্ষে কাজ করছেন। 

কৌশল হিসেবে সিনিয়র নেতারা প্রচারণায় নামছেন না বলে একাধিক সূত্র জানিয়েছে। গতকাল শনিবার দুপুরে নারায়ণগঞ্জ প্রেস ক্লাব ভবনে একটি চাইনিজ রেস্তোরাঁয় স্থানীয় সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা করেন নির্বাচন মনিটরিং দায়িত্বে থাকা আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা। এসময় আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগের ভেতরে থেকে নৌকার প্রার্থীর বিরুদ্ধে অবস্থান নিলে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হবে।’ 

নানক সতর্ক করে বলেন, ‘যারা নৌকা নিয়ে বিজয়ী হয়েছেন, তারা নৌকার পক্ষে কাজ না করলে সেটি নিজের সঙ্গে বেঈমানি করা হবে। দলের ভেতরে কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্ব বা বিভক্তি নেই। এই সভায় জেলা ও মহানগরের সব নেতৃবৃন্দ আছে। এখানে ব্যক্তি কোনো বিষয় নয়। কেউ দায়িত্ব পালন করবেন কিনা সেটি তার ওপর বর্তায়। দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে দলের কাছে অবশ্যই জবাবদিহি করতে হবে।’ 

জাতীয় পার্টির প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমরা তাদেরও সমর্থন আশা করি। নৌকার সমর্থন নিয়ে লাঙ্গল প্রতীকে নারায়ণগঞ্জ সদর আসনে পাস করেছেন জাতীয় পার্টির প্রার্থী। অথচ তারা আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছেন। প্রচারণায় শুরু থেকেই নৌকার প্রতীকের পক্ষে প্রচারণা চালাচ্ছেন যুবলীগের কেন্দ্রীয় ও নারায়ণগঞ্জ মহানগর নেতারা। ওয়ার্ডভিত্তিক গঠিত কেন্দ্রীয় টিম মহানগর ও ওয়ার্ড নেতাদের সমন্বয়ে প্রতিদিনই প্রচারণায় অংশ নিচ্ছেন। 

প্রচারণায় আরও গতি ফেরাতে এবং নৌকা প্রতীকের পক্ষে গণজোয়ার সৃষ্টির লক্ষ্যে গতকাল নগরীর ১ ও ২নং ওয়ার্ডে প্রচারণায় অংশ নিয়েছেন যুবলীগের চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস পরশ। এসময় যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মো. মাইনুল হোসেন খান নিখিলসহ কেন্দ্রীয় নেতারা উপস্থিত ছিলেন। পরে সন্ধ্যায় সিদ্ধিরগঞ্জের মিজমিজ পুল এলাকায় এক পথসভায় প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন যুবলীগের চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস পরশ। 

গতকাল দুপুরে বন্দরের ২৪নং ওয়ার্ডের চৌরাপাড়া এলাকায় নির্বাচনি প্রচারণা চালান আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকের প্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভী। এ সময় তিনি নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সংসদ সদস্য শামীম ওসমানের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। শামীম ওসমানকে ‘গডফাদার’ আখ্যায়িত করে সেলিনা হায়াৎ আইভী দাবি করেন, তার প্রতিদ্বন্দ্বী তৈমূর আলম খন্দকার বিএনপি বা স্বতন্ত্র প্রার্থী নন, তিনি শামীম ওসমান ও তার ভাই সেলিম ওসমানের প্রার্থী।

আইভী বলেন, ‘উনি (তৈমূর আলম) অন্য কারো প্রার্থী নন। উনি বিএনপিরও প্রার্থী না, স্বতন্ত্র প্রার্থীও নন। গতকাল বন্দরে প্রচার চালিয়েছেন তৈমূর আলম। ওই প্রচারে সেলিম ওসমানসহ (শামীম ওসমানের বড় ভাই) জাতীয় পার্টির চারজন চেয়ারম্যান তৈমূর আলমের সঙ্গে ছিলেন। 

এতেই প্রমাণিত হয়, সারা নারায়ণগঞ্জে যে গুঞ্জন ছিল তৈমূর আলম খন্দকার গডফাদার শামীম ওসমানের প্রার্থী।’ আইভী বলেন, ‘স্থানীয় আওয়ামী লীগের দ্বন্দ্ব পরিষ্কার হয়েছে কি না জানি না কিন্তু তৃণমূল নেতাকর্মীরা সবাই আমার সাথে আছেন। ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতাকর্মীরা আমার সাথে আছেন এবং তারা আমার জন্য কাজও করছেন। একমাত্র তাদের (শামীম ও সেলিম) লোকজনই তৈমূর আলম খন্দকারের পক্ষে কাজ করছেন।’ 

আওয়ামী লীগের প্রার্থী বলেন, ‘দলীয় হাইকমান্ড সবকিছু দেখছে। পত্রপত্রিকায় আসছে সেই সভার চিত্র। কিন্তু আমি একটা কথা বলতে চাই, আমি নির্বাচন করি জনতার শক্তি নিয়ে। জনতাই আমার শক্তি, দলই আমার মনোবল। সবকিছু মিলিয়েই আমি নির্বাচন করি। আমি কোনো গডফাদারের দিকে তাকিয়ে নির্বাচন করি না।’

জাতীয় পার্টি মহাজোটের অংশ জানিয়ে আইভী বলেন, ‘তারা কালকে প্রকাশ্যে ছিল তৈমূরের পক্ষে। এতে প্রমাণিত হয় কারা তৈমূর আলম খন্দকারকে দাঁড় করিয়েছে। কারা পেছন থেকে কলকাঠি নাড়ছে।’ শনিবার দুপুরে ৯নং ওয়ার্ডের জালকুড়িতে প্রচারণাকালে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে স্বতন্ত্র প্রার্থী তৈমূর আলম খন্দকার বলেন, নিজ দলের এমপি ও নেতাকর্মীরা যদি তাকে সমর্থন না দেন তাতে আমার কিছু করার নেই।

তৈমূর আলম বলেন, ‘তাকে (আইভী) নাকি কেউ সাপোর্ট দেয় না, এখানে আমি কী করবো। তাদের এমপি, দলের নেতাকর্মীরা যদি তাকে সাপোর্ট না দেন সেটা আমার করার কিছু নেই। সিটি কর্পোরেশনে অতিরিক্ত তিন-চারগুণ ট্যাক্স দিতে গিয়ে তো তারাও ভুক্তভোগী। আমি মাঠে নেমেছি, তাই সবার ভোট চাইব।’ 

সাংসদ শামীম ওসমান ও তার বড় ভাই সাংসদ সেলিম ওসমানের সমর্থনও চান জানিয়ে তৈমূর বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জে যারা এমপি আছেন আমি তো তাদেরও সমর্থন চাই। আমি মাঠে নেমেছি, জনগণসহ সবার সমর্থন চাইছি।’ 

স্বতন্ত্র প্রার্থী তৈমূর বলেন, ‘আমার পক্ষে নারায়ণগঞ্জের সব মানুষ নেমে এসেছে। তাদের কাছে ভোট চাইছি। যদি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নারায়ণগঞ্জের ভোটার হতেন আমি তার কাছেও ভোট চাইতে যেতাম এবং আমার বিশ্বাস তিনি আমাকে ভোট দিতেন। কারণ গত ৫০ বছরে আমার স্বচ্ছ, নির্ভেজাল ও গণমুখী কর্মকাণ্ড দেখে তিনি আমাকে ভোট দিতেন। আমি তো আওয়ামী লীগের ভোটও চাই, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ভোটও চাই, সমর্থন চাই। আমি তো সবার প্রার্থী, সবার ভোট চাই।’ 

বিএনপি থেকে অব্যাহতি পাওয়া এই নেতা বলেন, ‘আমি খেটে খাওয়া মানুষের প্রার্থী ও জনগণের প্রার্থী। জনগণের চাহিদার কারণেই আমাকে প্রার্থী হতে হয়েছে। পৌরসভা ও সিটি কর্পোরেশন ১৮ বছর ধরে এক ব্যক্তির হাতে। এতে ঠিকাদারদের সিন্ডিকেট শক্ত হয়েছে, কিন্তু নগরবাসীর সেবা বাড়েনি। ফলে নগরবাসী এখন ঐক্যবদ্ধ।’ 

বিএনপির ভোট প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আর আমি বিএনপি কি না এটা নারায়ণগঞ্জের বিএনপি নেতাদের জিজ্ঞেস করেন। আমাকে বিএনপি বহিষ্কার করেনি। তারা আমাকে সুযোগ করে দিয়েছে সব দলের সমর্থন যেন আমি পাই।’ দু-একদিনের মধ্যে সংবাদ সম্মেলনে আসছেন শামীম ওসমান : নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে নিজের ব্যক্তিগত অবস্থান জানাতে দু-একদিনের মধ্যেই সংবাদ সম্মেলনে আসছেন নারায়ণগঞ্জ-৪ (ফতুল্লা-সিদ্ধিরগঞ্জ) আসনের সংসদ সদস্য শামীম ওসমান। আইভীর এমন বক্তব্যে ক্ষোভ প্রকাশ করেন শামীম ওসমান। 

তার ভাষ্য, আইভী তাকে গডফাদার বলে দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনার প্রতি আঙুল তুলেছেন। তিনি বলেন, ‘দুই দিন আগে একটা ভিডিও দেখলাম সেখানে উনি (আইভী) বলছেন শামীম ওসমান আমাদের নেতা। উনি বড় ভাই, আওয়ামী লীগের সাংসদ। দুই দিনের মধ্যে গডফাদার হয়ে গেলাম?’ 

শামীম বলেন, ‘আমাকে মনোনয়ন দিয়েছে আমার দল। আমি যদি গডফাদার হই তাহলে আমাকে মনোনয়ন দিয়েছেন কে? কাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হলো? যে বলেছে, তার (আইভী) কাছে জিজ্ঞেস করেন, আপনি দুই দিন আগে এটা বলেছেন, দুই দিন পরে এটা বললেন। কোনটা সঠিক।’ সিটি নির্বাচন ঘিরে আইভীর অভিযোগ ও মন্তব্যের বিষয়ে দুই দিনের মধ্যে সংবাদ সম্মেলন করে জবাব দেবেন বলে জানান এই সাংসদ।

বলেন, ‘সেটা কালকেও হতে পারে, কিংবা পরশু হতে পারে। সেখানে আমি আমার কথা বলবো।’ আগামী ১৬ জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন। নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে এলেও নিজের অবস্থান পরিষ্কার করেননি স্থানীয় সংসদ সদস্য শামীম ওসমান। 

গত ২০ ডিসেম্বর নির্বাচন উপলক্ষে ঢাকা বিভাগের সাংগঠনিক দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের সঙ্গে নারায়ণগঞ্জ জেলা ও মহানগর নেতাদের বৈঠকেও উপস্থিত ছিলেন না শামীম ওসমান। নাসিক নির্বাচনে সিটি কর্পোরেশনের ২৭টি সাধারণ ওয়ার্ডে এবং ৯টি সংরক্ষিত ওয়ার্ডে মোট ১৮৭টি ভোট কেন্দ্রে মোট পাঁচ লাখ ১৭ হাজার ৩৫৭ ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার দুই লাখ ৫৯ হাজার ৮৩৪ জন, মহিলা ভোটার দুই লাখ ৫৭ হাজার ৫১৯ জন ও তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার চারজন। এ নির্বাচনে ইভিএমে ভোট দিবেন ভোটাররা।