Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪,

তৈমূরের শেষ ভরসা নৌকার দ্বন্দ্ব

রফিকুল ইসলাম, নারায়ণগঞ্জ থেকে ফিরে

জানুয়ারি ১৩, ২০২২, ০৭:০৫ পিএম


তৈমূরের শেষ ভরসা নৌকার দ্বন্দ্ব
  • লোক দেখানো নৌকার পক্ষে বাস্তবে বিমুখ শামীমপন্থিরা
  • নৌকার বিজয় নিশ্চিতে ডোর টু ডোর ঘুরছে আ.লীগ 
  • এন্টি আ.লীগের এক-তৃতীয়াংশ ভোট পাবেন আইভী
  • ভোটের কৌশলে প্রকাশ্যে তৈমূরের পাশে নেই বিএনপি

সেলিনা হায়াৎ আইভী না কি তৈমূর আলম খন্দকার, কে হচ্ছেন নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র? বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যাবে আগামী ১৬ জানুয়ারি ভোট গণনার পর। তবে নির্বাচনের আগেই নিজ ঘরের ভোটারদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে তোড়জোড় শুরু করেছে আওয়ামী লীগ। পূর্ব শত্রুতার জের ধরে দলীয় ভোট যেন নৌকার বিরুদ্ধে না যায়— সেদিকে প্রখর দৃষ্টি রাখছে ক্ষমতাসীন দলটি। 

তারা বলছে, উৎসবমুখর পরিবেশের মধ্য দিয়ে নৌকার পক্ষে গণজোয়ার সৃষ্টি হয়েছে। যদিও দলটির মাঠপর্যায়ের কর্মীরা বলছেন, এবার সিটি নির্বাচনে আইভীকে অগ্নিপরীক্ষা দিতে হবে। দলের অভ্যন্তরে সৃষ্ট দ্বন্দ্বই ভোটের মাঠে ভোগাতে পারে তাকে। তবে শেষ মুহূর্তে ওই দ্বন্দ্ব ভোটের মাঠে গড়ালে একক সুবিধা পাবেন হাতি প্রতীকের মেয়র প্রার্থী (স্বতন্ত্র) তৈমূর আলম খন্দকার। 

জানা যায়, নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচনের বাকি মাত্র একদিন। শেষ মুহূর্তে মেয়র-কাউন্সিলর প্রার্থীদের ব্যানার, ফেস্টুন ও বিলবোর্ডে ছেয়ে গেছে পুরো নারায়ণগঞ্জ সিটি। আজ শেষ দিনের মতো প্রচার-প্রচারণায় ব্যস্ত সময় পার করবেন প্রার্থী ও তাদের কর্মী-সমর্থকরা। এ সিটি নির্বাচনে দৃষ্টি এখন সমগ্র দেশবাসীর। বিশেষ করে আওয়ামী লীগসহ সব রাজনৈতিক দলের। ভোটের সময় যতই ঘনিয়ে আসছে, ততই উত্তাপ বাড়তে শুরু হয়েছে। নিজ নিজ দলীয় প্রার্থীদের বিজয় নিশ্চিত করতে কাজ করছেন রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতারা। কে হবেন সিটির মেয়র, কে পাচ্ছেন এ শিল্প নগরের উন্নয়নের দায়িত্ব। তা নিয়ে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ।

সরেজমিন দেখা যায়, নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে নৌকার বিজয় নিশ্চিত করতে গতকালও প্রচার-প্রচারণার ব্যস্ত সময় পার করেছেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সিনিয়র নেতারা। নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সমন্বয়ের দায়িত্বে থাকা দলটির প্রেসিডিয়াম সদস্য অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানকের নেতৃত্বে আরেক প্রেসিডিয়াম সদস্য আব্দুর রহমান, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দীন নাছিম, সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন, মির্জা আজম, ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক সুজিত রায় নন্দীসহ শীর্ষ পর্যায়ের কেন্দ্রীয় নেতারা নৌকার বিজয় নিশ্চিত করতে ডোর টু ডোর পৌঁছে দিচ্ছেন নারায়ণগঞ্জ উন্নয়নে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিশ্রুতি। তাদের পদচারণায় পাল্টে গেছে ভোটের মাঠের দৃশ্যপট। 

আগামী ১৬ জানুয়ারি নির্বাচনে নৌকার বিজয় নিশ্চিত করতে কাজ করছেন আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন যুবলীগ, সেচ্ছাসেবক লীগ, ছাত্রলীগ, মৎসজীবী লীগ, মহিলা আওয়ামী লীগ ও যুব মহিলা লীগের নেতাকর্মীরা। তাদের কেন্দ্রভিত্তিক টিমগুলো গতকালও নৌকার প্রচার-প্রচারণায় ব্যস্ত ছিল। স্থানীয় আ.লীগ সূত্রে জানা যায়, দীর্ঘদিন ধরেই দ্বন্দ্ব চলছে স্থানীয় সাংসদ শামীম ওসমান ও নৌকার মনোনীত মেয়র প্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভীর। সৃষ্ট ওই দ্বন্দ্ব, কোন্দল, বিভক্তি-বিভাজন ও সিন্ডিকেটের রাজনীতি ভেঙে দিয়ে ঐক্যবদ্ধ আওয়ামী লীগ গড়ে তোলার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় শীর্ষ নেতারা। এ জন্য নির্বাচনের ভোট গ্রহণ শেষ না হওয়া পর্যান্ত এ নগরেই অবস্থান করবেন তারা।  

এদিকে ভোট গ্রহণের দিনকে সামনে রেখে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের পদচারণায় নারায়ণগঞ্জ সিটি উৎসবের নগরীতে পরিণত হলেও এখনো নৌকায় বিমুখ স্থানীয় সাংসদ শামীম ওসমানপন্থি মাঠ পর্যায়ের নেতারা। তারা বলছেন, শামীম ওসমান আওয়ামী লীগের নিবেদিতপ্রাণ। দলের দুঃসময়ে আন্দোলন-সংগ্রাম, মিছিল-মিটিং, সভা-সমাবেশ ও সাংগঠনিক কার্যক্রমে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন। বিএনপি-জামায়াত কর্তৃক আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের অত্যাচার-নির্যাতনে বিরুদ্ধে প্রতিবাদ প্রতিরোধ করেছেন। কিন্তু দলীয় মেয়র প্রার্থী আইভী প্রকাশ্যে শামীমের বিরুদ্ধে যে বক্তব্যে দিয়েছেন, তার দায় দিন শেষে আওয়ামী লীগের ঘাড়ে এসে পড়েছে। 

তবে তারা কেউ কেউ মনে করেন, শামীম ওসমান আওয়ামী লীগের রাজনীতি করেন। তার কাছে নৌকার প্রতীক মানে আওয়ামী লীগের আদর্শ, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ, শেখ হাসিনার আদর্শ। তাই দ্বন্দ্ব থাকলেও দলের নীতি আদর্শ অনুকরণ করেই নৌকায় ভোট দেবেন।

নির্বাচন নিয়ে কথা হয় নারায়গঞ্জের বন্দর খেয়াঘাট এলাকার ব্যবসায়ী তারিকুল ইসলামের সাথে। তিনি আমার সংবাদকে বলেন, ‘কে নির্বাচিত হবে, সেটি বলতে পারছি না। কিন্তু আমার যেটা মনে হয়, আওয়ামী লীগ দেশ পরিচালনা করছে, তাদের মনোনীত প্রার্থীকে আমাদের ভোট দেয়া উচিত। তাহলে সরকারের সুদৃষ্টি সবসময় আমাদের দিকে থাকবে। কিন্তু যদি অন্য দলের কেউ নির্বাচিত হন তাহলে কিন্তু সরকার ইচ্ছা করেই আমাদের এলাকার উন্নয়ন করবে না।’ 

বন্দরঘাটে সেতু না হওয়ায় দুঃখপ্রকাশ করে তিনি আরও বলেন, ‘আশা করি, এবার আমাদের এই দুঃখটার শেষ হবে।’

জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য আব্দুর রহমান আমার সংবাদকে বলেন, ‘উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে নারায়ণগঞ্জবাসী আগেও ভুল করেনি, আগামী ১৬ তারিখেও করবে না। তারা দেশের উন্নয়নের পক্ষে, নারায়ণগঞ্জের উন্নয়নের পক্ষে, জননেত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে, সেলিনা হায়াৎ আইভীর পক্ষে রায় দেবেন। এ নগরে নৌকার পক্ষে গণজোয়ার সৃষ্টি হয়েছে।’ 

তিনি আরও বলেন, ‘এখানে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ নেই, দ্বন্দ্ব নেই। সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে জননেত্রী শেখ হাসিনার মনোনীত মেয়র প্রার্থী আইভীর পক্ষে কাজ করবেন।’ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নৌকার প্রতীকের মেয়র প্রার্থী হলেও এবার সিটি নির্বাচনে অগ্নিপরীক্ষা দিতে হবে সেলিনা হায়াৎ আইভীকে। নিজের ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা থাকলেও তার বিজয় নিশ্চিত করতে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা শেষ পর্যন্ত ঐক্যবদ্ধ থাকবেন কি-না তা নিয়ে ধোঁয়াশা সৃষ্টি হচ্ছে। প্রকাশ্যে থাকা ওই দ্বন্দ্বই ভোটের মাঠে ভোগাতে পারে নৌকার মেয়র প্রার্থী আইভীকে। বিষয়টি হালকাভাবে নিচ্ছে না আইভীপন্থিরাও। 

তারা সাংসদ শামীম ওসমান ও তার বলয়ের নেতাকর্মীদের নির্বাচনি প্রচার-প্রচারণা এবং দৈনন্দিন কার্যক্রমের ওপর দৃষ্টি রাখছেন। তবে শেষ মুহূর্তে শামীম-আইভীর দ্বন্দ্ব ভোটের মাঠে গড়ালে একক সুবিধা পাবেন বিএনপির সাবেক নেতা হাতি প্রতীকের মেয়র প্রার্থী (স্বতন্ত্র) তৈমূর আলম খন্দকার। তখন তিনি মেয়র নির্বাচিত হলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। তবে স্থানীয় বিএনপির প্রভাবশালী নেতারা তৈমূরের পাশে প্রকাশ্যে নেই। মূলত বিএনপি নির্বাচন বর্জন করায় তারা প্রকাশ্যে কারো পক্ষে প্রচারণায় অংশ নিচ্ছেন না। যদিও অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে বিভক্ত স্থানীয় বিএনপি নেতাকর্মীরা। 

আইভীপন্থিদের সাথে কথা বলে জানা যায়, দীর্ঘদিন ধরেই নগরের সাধারণ মানুষের সেবা করে আসছেন আইভী। অবহেলিত নারায়ণগঞ্জকে উন্নত নগরে পরিণত করতে বেশ কিছু উদ্যোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করেছেন তিনি। আইভী আরেকবার সুযোগ পেলে তার অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করতে পারবেন বলে দাবি করছেন কর্মী-সমর্থকরা। এ জন্যই এবার সিটি নির্বাচনে আইভীর প্রতি আলাদা সম্মান দেখাবেন সাধারণ ভোটাররা। 

এছাড়া আওয়ামী লীগের এন্টি (বিএনপি-জামায়াত, হেফাজত) রাজনৈতিক দলগুলো এবং জনসাধারণ আইভীকে ব্যক্তিগতভাবে পছন্দ করে। বিগত দিনের নির্বাচনে তারা যেভাবে আইভীকে সহানুভূতি দেখিয়েছে তার ধারাবাহিকতা এবারো অব্যাহত থাকবে বলে আশা আইভীপন্থিদের। 

আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক আমার সংবাদকে বলেন, ভোট গ্রহণের দিনকে সামনে রেখে নারায়ণগঞ্জ সিটিতে উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করছে। নৌকার পক্ষে গণজোয়ার সৃষ্টি হয়েছে। এখানে আমরা কোনো সঙ্কটের মধ্যে নেই। কারণ আমাদের দল আওয়ামী লীগ ও দলের সব সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা ডোর টু ডোর গিয়ে নৌকার পক্ষে ভোট চেয়েছি। নৌকায় ভোট দেয়ার বিষয়ে প্রতিটি ভোটার আমাদের আশ্বস্ত করেছেন। তারা নিজ নিজ ভোট প্রয়োগের মধ্যে দিয়ে নৌকার বিজয় নিশ্চিত করবেন।’