Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪,

সন্তানের চোখে বাবা হোক আদর্শ মানুষ

মো. তানজিমুল ইসলাম

জানুয়ারি ১৫, ২০২২, ১১:০৫ পিএম


সন্তানের চোখে বাবা হোক আদর্শ মানুষ

পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় আধুনিককালের পুরুষদের খুব ছেলেবেলা থেকেই স্বপ্ন থাকে বড় হয়ে চাকরি করবে, কেউবা ব্যবসা। মোটকথা সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়া চাই, তারপর বিয়ে-সন্তান-সাংসারিক/সামাজিক দায়িত্ব পালন এবং নতুন করে আবারও সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার লড়াই। স্বপ্নের সাথে বাস্তবতা অনেক সময় মেলে আবার বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মেলে না। প্রাইমারি স্কুলের সবচেয়ে মেধাবী বন্ধুটি যখন মাধ্যমিক পাস করার আগেই ঝরে পড়ে, অন্য বন্ধুরা তখন পড়ালেখায় অনেকাংশেই নিরুৎসাহিত বোধ করে। 

অনেকে আবার আবেগের বশবর্তী হয়ে মূল লক্ষ্য থেকে পথভ্রষ্ট হয়; প্রেমে ছ্যাঁকা খেয়ে মরণ নেশার অন্ধকার জগতে পা বাড়ায়। বাবা-মায়ের কষ্টার্জিত টাকা ভুল জায়গায় খরচ করে বিপথে যায়। পরিশেষে চরম বিপদেও পড়ে! অনেকে আবার পড়ালেখা শেষ করার মাঝখানে এসে চরম অপ্রত্যাশিত ভুল করে। যেমন তীরে এসে তরী ডোবানোর দুঃখ মোচন হয় না, ঠিক তেমনি সেসব ভুলগুলো কখনোই শুধরানো সম্ভব হয় না। অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে শেষমেষ যখন অধ্যয়ন সমাপ্তির সার্টিফিকেট হাতে আসে, চোখ থেকে এবার রঙিন চশমাটিও নিমিষেই খুলে যায়। 

তখন মনের মধ্যে আর আবেগের ঘোড়ারোগ মনে দানা বাঁধে না। শুরু হয় কঠিন বাস্তবতায় টিকে থাকার জীবন-সংগ্রাম। পথে-পথে, দ্বারে-দ্বারে ঘুরেও যখন নিষ্ঠুর প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারে না, হতাশার চাদর গায়ে জড়িয়ে তারা আত্ম-গোপন করে পাড়ি জমায় অন্ধকার জগতে। প্রকৃতির নিয়মে বসন্ত আসে-বসন্ত যায়। 

যৌবনের চাহিদা সত্ত্বেও বিয়ে করার শক্তি-সাহস কোনোটাই থাকেনা তখন। দৈবক্রমেই ত্রিশ/পঁয়ত্রিশোর্ধ্ব লোকটি একদিন যদিওবা বিয়ের পিঁড়িতে বসে তখন তারা সত্যিকারের বরের চেয়ে মাঝ-বয়সিদের কাতারের মানুষ বলে বেশি বিবেচিত হয়। কেননা মানুষের গড় আয়ু যেখানে ষাট- সেখানে এমন মন্তব্য দোষের কিছু নয়, এবার শুরু হয় সন্তান জন্মদানের জটিলতা। 

নেশা-নিয়ন্ত্রিত জীবন আর অসময়ে বিয়ে নামক জীবন-যুদ্ধে নিজেকে সঁপে দেয়ার কুফল হিসেবে অনেকেরই বাবা হওয়ার স্বপ্ন অধরাই থেকে যায়। এভাবেই জীবনের গল্পটা আর সুখকর থাকে না। হতাশা-ব্যর্থতা-বেদনার নীল চাদর গায়ে জড়িয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত দাম্পত্য জীবনকে উপেক্ষা করার কোন উপায় থাকেনা তখন। এভাবে এমনি করেই একদিন হঠাৎ না ফেরার দেশে চলেও যায় অজস্র স্বপ্নদ্রষ্টা মানুষটি! কেউ তাকে সেভাবে মনেও রাখে না আর।

অনেক সৌভাগ্যবান পুরুষ যারা বিপথে না গিয়ে লক্ষ্যে পৌঁছায়, তারাও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই প্রতিষ্ঠিত হওার লড়াইয়ে অনেক বেশি কালক্ষেপণ করে। এক পর্যায়ে অসময়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসে, আল্লাহর রহমতে সন্তান জন্মদানও করে এবং যথারীতি দায়িত্ববোধ বেড়ে যায় অথবা নিজেই বাড়িয়ে দেয়। স্ত্রী-সন্তানের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে শুরু হয় বিরামহীন ছুটে চলা। 

খাওয়া নেই, নাওয়া নেই, সময়মত বিশ্রাম নেই, নিজেকে অর্থ-উপার্জনের মেশিন মনে করে সঁপে দেয় অসুস্থ প্রতিযোগিতার এই কঠিন সময়ে। খুব সকাল বেলায় বেরিয়ে পড়ে, সারাদিন ক্লান্ত-অবিশ্রান্ত-অবসাদ সাথে নিয়ে তিনি যখন বাসায় ফেরেন, কোমলমতি নিষ্পাপ সন্তান তখন গভীর ঘুমে মগ্ন থাকে। স্বামীর অনুপস্থিতিতে টেলিভিশন যখন অন্যতম অবলম্বন, তাই নানা চ্যানেল-নানা সিরিয়ালের সাথে স্ত্রীর সখ্য বেড়ে ওঠা অস্বাভাবিক কোনো ঘটনা নয়। 

গভীর রাতে চরম ক্ষুধায় স্বামী যখন তার প্রিয়তম স্ত্রীকে খাবার পরিবেশন করতে বলেন, তখন তিনি আর প্রিয়তম থাকেন না, বরং টেলিভিশন নামক সখীর কাছ থেকে আলাদা করার রাগে-ক্ষোভে জর্জরিত হয়ে যখন অপ্রত্যাশিত শব্দচয়ন ব্যবহূত হয়, ঠিক তখনই পুরুষ নামক অর্থ-উপার্জনের মেশিনের ভেতরে ক্যামন যেন ছ্যাঁত করে উঠে। এক বুক কষ্ট বুকে চেপে ধরে সে বোবারূপী-পাষাণ-প্রতিবন্ধী সাজে ঐ রাতের জন্য। নির্ঘুম রাত কাটতে না কাটতেই দূর-দিগন্তে নতুন সূর্য হেসে উঠে; শুরু হয় নতুন দিন, নতুন সংগ্রাম। 

মানুষরূপী যন্ত্রটির এভাবেই কেটে যায় অহর্নিশ। প্রকৃতির নিয়মে বেড়ে উঠে সন্তান, ভরণ-পোষণের সমুদয় দায়িত্ব যার কাঁধে, মাঝে-মাঝে তিনিই বড্ড-বেশি অপরিচিত হয়ে যায় সন্তানের কাছে! ফুটফুটে সন্তান মার কাছে শেখা বুলিতে ‘বাবা’ ডাকে মাত্র। কিন্তু বাস্তবে ‘বাবা’ নামক পবিত্র শব্দটির গুরুত্ব/ব্যবহার সম্পর্কে সম্পূর্ণ অপিরচিত সে। বাবার চলা-বলা-নৈতিক আদর্শ কোনোটাই আয়ত্ব ও অনুসরণ করার সুযোগ বা অনুকূল পরিবেশ পায় না বলে সন্তান যেন ডিজিটাল সভ্যতায় নিজেকে নতুন আবির্ভাব হিসেবে ভাবতে শুরু করে। নিবেদিত-প্রাণ মানুষটির ইচ্ছা-উপদেশ-নির্দেশকে স্ত্রী-সন্তান যখন উপহাস/তাচ্ছিল্য করে, বুকফাটা আর্তনাদে কান্না ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না তখন।

জীবন সায়াহ্নে অবচেতন মনেই অর্থ-উপার্জনকারী মানুষটি উপলব্ধি করতে শেখে, কিন্তু কোনো লাভ হয় না। কেননা বেলা যে অস্তমিত প্রায়, অর্থের পেছনে ছুটতে গিয়ে শেষমেশ মানুষ যেন জীবনের প্রকৃত অর্থ ভুলতে বসে। হতভাগ্য-হতাশাগ্রস্ত মানুষটি শেষ বেলায় তাই জাতিকে সময়ের কাজ যথাসময়ে করতে আহ্বান করে। আধুনিককালে বিয়ে করা বা সন্তান জন্ম দেয়া যতটা সহজ, যথার্থ স্বামী বা আদর্শ বাবা হওয়া তত সহজ কথা নয়, তাই আমাদের বাবা হওয়ার আগে প্রকৃত মানুষ অত্যন্ত জরুরি।
মেডিকেল সায়েন্সের গবেষণা মতে, প্রতিটি মানব সন্তানের জন্মের পর থেকে তিন বছর বয়স পর্যন্ত নিউরন সেল অনেক বেশি সুগঠিত হয়। 

আর তাই এ বয়সে সন্তানকে সঠিকভাবে লালন-পালন করতে, এমনকি তার উন্নত ভবিষ্যতের কথা বিবেচনা করে মা-বাবা উভয়কেই অনেক বেশি যত্নশীল হওয়া জরুরি। শুধুমাত্র ডিভাইস/যন্ত্র-নির্ভর সন্তানেরা একদিকে যেমন মানসিক বিকাশের ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ে; পক্ষান্তরে, মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন জাতি গঠনেও তাদের কোনো ভূমিকা থাকে না। এছাড়া, আমরা প্রত্যেকেই জানি, নবাগত শিশুরা দেখে দেখেই অনেক কিছু শিখে। শিশুদের জন্য পরিবারই হলো সবচেয়ে বড় ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান’। অনুকরণ প্রিয় হওয়ার ফলেই বড়দের চাল-চলন, আচার-আচরণ, ভালো-মন্দ সবকিছু খুব সহজেই শিখে ফেলে। তাই সন্তানদের সামনে বিশেষ করে শিশুদের সামনে কোনো অবস্থাতেই মন্দ কিছু বলা, অপ্রত্যাশিত আচরণ করা বা ঘটানো উচিত নয়; কেননা, সন্তানেরা পরবর্তীতে সেগুলো সজ্ঞানে বা অবচেতনভাবেই বাস্তবায়ন করে! যা কোনোভাবেই আমাদের কাম্য নয়। 

‘এইজিং পপুলেশন ইন পাবলিক হেলথ’-এর গবেষণা মতে, কোনো একটি দেশের মোট জনসংখ্যার মধ্যে আনুপাতিক হারে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী যত বেশি হবে সেই দেশ তত বেশি সমৃদ্ধশীল হবে। অতএব জনসংখ্যা অধিক হলেও যদি কর্মক্ষম হয় সেটি নিঃসন্দেহে আশীর্বাদ। পক্ষান্তরে, কর্মবিমুখ এবং মানবিক মূল্যবোধহীন জনগোষ্ঠী আমাদের সবার জন্যই অভিশাপ বটে, যেহতু পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় সাধারণত ‘বাবা’ নামক প্রণীটিই মূলত চালিকাশক্তি এবং বাবাদের নেতৃত্বেই অন্তত একটি পরিবার পরিচালিত হয়ে থাকে, সুতরাং বাবাদের অন্তত সৎ, নীতিবান, কর্তব্যপরায়ণ, নিরপেক্ষ ও সর্বোপরি, আদর্শ মানুষ হওয়া অত্যন্ত জরুরি। যাতে সন্তানেরাও সেই সঠিক পথ অনুসরণ করতে পারে। এ ক্ষেত্রে মা’দের ভূমিকা কখনো ছোট করে দেখা যাবে না। 

তবে চলমান সভ্যতার বাস্তবতা বিবেচনায় বাবাদের সর্বাগ্রে আদর্শ পুরুষ হওয়ার কোন বিকল্প নেই। এটি বলার অপেক্ষা রাখে না যে, আমাদের প্রত্যেকেরই বাবা ডাক শোনার আগে আদর্শ মানুষ হতেই হবে। কেননা, সন্তানদের চোখে বাবারাই মূল ভরসার নাম, প্রিয় মানুষ, সেরা আদর্শ। তাই তো, সর্বাগ্রে প্রত্যাশা যেন, ‘সন্তানের চোখে বাবা হোক আদর্শ মানুষ।’

লেখক : সামাজিক উন্নয়ন ও মানবাধিকারকর্মী