Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪,

আইভীর হ্যাটট্রিক

নিজস্ব প্রতিবেদক

জানুয়ারি ১৬, ২০২২, ০৮:১০ পিএম


আইভীর হ্যাটট্রিক
  • ৬৯ হাজার ১০২ ভোটের ব্যবধানে আইভী জয়ী 
  • শামীম ওসমান, সাখাওয়াতের পর তৈমূরও লণ্ডভণ্ড 
  • শান্তিপূর্ণ ভোটের নজির স্থাপন হলো নারায়ণগঞ্জে 
  • ৫০ শতাংশ ভোট পড়েছে বলে ধারণা ইসি সচিবের 
  • যন্ত্রের সাথে নতুন অভিজ্ঞতা, ইভিএমে সব কেন্দ্রে ভোট 
  • আঙুলের ছাপ না মেলায় বয়স্ক ও নারীদের ভোগান্তি

বৃদ্ধা ছাবেদা বেগম। বয়স ৯৫। নাতনি ইয়াসমিনের কাঁধে ভর দিয়ে গতকাল শীতের সকালে নারায়ণগঞ্জের শিশুবাগ স্কুল কেন্দ্রে ভোট দিতে আসেন। হাতে ছিল মেয়র প্রার্থী আইভীর নৌকা প্রতীকের কার্ড। 

বললেন, ‘আমার এক পা কবরে চলি গেছে। কদিন আর বাছুম। তয় চুনকার মাইয়্যারে (আলী আহমেদ চুনকা আইভীর বাবা) ইজ্ঞা ভোট দিমু তাই চলি আইছি। চুনকার মাইয়্যার বহুত সাহস আছে, যা দেখে মন ভরে যায়। বাগাবাগা লোকের লগে লড়াই করে। তাই নাতনিরে লই চলি আইছি।’ বেলা শেষে দেখা গেল সেই চুনকার মেয়েই জিতল। বিফলে যায়নি বৃদ্ধের ভোট। 

দিনব্যাপী ভোট শেষে সন্ধ্যায় ফলাফল ঘোষণা করেন এনসিসির রিটার্নিং কর্মকর্তা মাহফুজা আক্তার। তাতে দেখা যায় ১৯২ কেন্দ্রের ফলাফলে নৌকা পেয়েছে এক লাখ ৬১ হাজার ২৭৩ আর হাতি ৯২ হাজার ১৭১টি। ৬৯ হাজার ১০২ ভোটের ব্যবধানে সেলিনা হায়াৎ আইভী টানা তৃতীয়বার মেয়র পদে হ্যাটট্রিক করেন। 

লড়াই হয় স্বতন্ত্র প্রার্থী অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকারের সাথে। এই তৈমূর আলমের রাজনীতি শুরু আইভীর বাবা আলী আহাম্মদ চুনকার হাত ধরেই। আইভী তৈমূরকে চাচা বলেই সম্বোধন করেন। বেলা শেষে সেই ভাতিজির কাছেই পরাজিত হন চাচা। এর আগে ২০১১ সালের ৩০ অক্টোবরের নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী শামীম ওসমানকে পরাজিত করে প্রথমবারের মতো মেয়র নির্বাচিত হন। 

এরপর ২০১৬ সালের ২২ জানুয়ারির নির্বাচনে বিএনপি দলীয় প্রার্থী সাখাওয়াত হোসেন খানকে পরাজিত করেন। উল্লেখ্য, ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভীর বাবা আলী আহাম্মদ চুনকা শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন, স্বাধীনতার পর দু’দুবার (১৯৭৪ সালের ৪ মার্চ থেকে ১৯৭৭ সালের ৯ মার্চ এবং ১৯৭৭ সালের ১০ সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৮৪ সালের ২২ সেপ্টেম্বর) নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৮৪ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি মারা যান নারায়ণগঞ্জ পৌর পিতা আলী আহাম্মদ চুনকা। আলী আহাম্মদ চুনকার পাঁচ সন্তানের মধ্যে সবার বড় হলেন ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী।

এদিকে এবার শান্তিপূর্ণ ভোটের নজির স্থাপন হয়েছে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনে। ভোটে রক্ত ঝরেনি। হয়নি খুন, আহত। প্রার্থীদের পাল্টাপাল্টিতে উত্তাপও ছড়ায়নি। শীতের মধ্যেই দীর্ঘ সারিতে দাঁড়িয়ে ভোট দিয়েছেন ভোটাররা। গতকাল রোববার সকাল ৮টায় ১৯২ কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ শুরু হয়ে, যা একটানা বিকেল ৪টা পর্যন্ত চলে। 

এবারই প্রথম পুরো নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনে ইভিএমে ভোট হয়। যন্ত্রে চাপ দিয়েই খুব সহজেই ভোট দিতে পেরে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন অনেকেই। আবার আঙুলের ছাপ না মেলায় বয়স্ক অনেকের ভোগান্তির খবরও ছিল। দুপুরে কেন্দ্র ঘুরে দেখার সময় নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা মাহফুজা আক্তার বলেন, ‘আমরা বিভিন্ন কেন্দ্রে দেখলাম, কথা বললাম। চার ঘণ্টায় ভালো ভোট কাস্ট হচ্ছে। ভোটারের উপস্থিতিও ভালো রয়েছে।’ জেলা প্রশাসক মোস্তাইন বিল্লাহ সাংবাদিকদের বলেন, দুপুর পর্যন্ত কোনো কোনো কেন্দ্রে ৩০-৩৫ শতাংশ ভোট পড়ার তথ্য তিনি পেয়েছেন। বিকেলে ভোট শেষে আদালত ভবন কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার আইয়ুব আলী ভুইয়া জানালেন, তার কেন্দ্রে ৬০ থেকে ৬৫ শতাংশ ভোট পড়েছে বলে তার ধারণা। 

২০১১ সালে এ সিটির নির্বাচনে ভোটের হার ছিল ৬৯ শতাংশ; তবে ২০১৬ সালে তা কমে ৬২ দশমিক ৩৩ শতাংশে দাঁড়ায়। এবারের সংখ্যার জন্য অপেক্ষা করতে হবে আরো কিছু সময়। তবে সন্ধ্যার সময় নির্বাচন কমিশন (ইসি) সচিব মো. হুমায়ুন কবীর খোন্দকার বলেছেন, নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন (নাসিক) নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হয়েছে। কমিশনে এখনো পর্যন্ত কেউ অভিযোগ করেননি। সেই সাথে ধারণা করা হচ্ছে, ৫০ শতাংশ ভোট পড়েছে। নারায়ণগঞ্জের সহকারী রিটার্নিং অফিসার আল আমিন বলেন, ‘৪টায় ভোট শেষ হয়েছে। এখনো অনেক ভোটকেন্দ্রে ভোটারের লাইন রয়েছে। কেন্দ্রের নির্ধারিত চৌহদ্দিতে থাকা ভোটারদের ভোট শেষ করেই ফলাফল তৈরির কাজ শুরু হবে।’ ইভিএমে আগের মতো ভোট গুনার ঝামেলা নেই। ভোটগ্রহণ শেষে যন্ত্রই সব হিসাব করে দেবে। বাকি থাকবে শুধু কেন্দ্র ফল ঘোষণা এবং এজেন্টদের সই নিয়ে তা নিয়ন্ত্রণ কক্ষে পাঠানোর আনুষ্ঠানিকতা। ডিসি অফিসের সামনে উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে শামিয়ানা আর মঞ্চও সাজিয়ে প্রস্তুত করা হয়ে রিটার্নিং কর্মকর্তার নিয়ন্ত্রণ কক্ষ। সেখান থেকেই একীভূত ফল ঘোষণা করা হবে সন্ধ্যার পর থেকে।

মেয়র এবং সাধারণ ও সংরক্ষিত আসনের কাউন্সিলর মিলিয়ে এ নির্বাচনে ১৮৯ জন প্রার্থী হলেও স্বাভাবিকভাবেই প্রচারের আলোয় ছিলেন চিকিৎসক আইভী ও আইনজীবী তৈমূর। দলীয় প্রতীকে অনুষ্ঠিত এই নির্বাচনে আইভী ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রতীক নৌকা নিয়ে লড়েন। আর এ সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা নেয়া বিএনপি নেতা তৈমূর দলের পদ ছেড়ে হাতি প্রতীক নিয়ে হন স্বতন্ত্র প্রার্থী। তাদের নিয়ে মোট সাতজন প্রার্থী এ সিটির মেয়র হতে ভোটের লড়াইয়ে ছিলেন। এ ছাড়া সাধারণ কাউন্সিলর পদে ১৪৮ জন ও সংরক্ষিত কাউন্সিলর পদে ৩৪ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন নারায়ণগঞ্জ সিটির তৃতীয় এই নির্বাচনে। তবে ভোটের লড়াই ছাপিয়ে যে এই নির্বাচন জাতীয়ভাবেও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে, সে কথা আগেই বলেছেন নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থা জানিপপের চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ। তার ভাষায়, এ সিটি নির্বাচনে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোও নজর রাখছে।

পাঁচ বছর ধরে সমালোচনাবিদ্ধ কে এম নুরুল হুদা নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশনের জন্য এই নির্বাচন ছিল শেষটা ‘ভালো’ করার চ্যালেঞ্জ। আবার জাতীয় নির্বাচনের আগের বছর রাজধানীর পাশের এ নগরে নির্বাচন রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকেও গুরুত্বপূর্ণ ছিল। গতকাল সকাল ৮টায় এ সিটির ১৯২ কেন্দ্রে ইভিএমে ভোটগ্রহণ শুরু হয়। তবে মাঘের শীতের মধ্যে ভোটারদের কেন্দ্রে কেন্দ্রে জড়ো হতে দেখা যায় নির্দিষ্ট সময়ের আগেই। বেলা বাড়ার সাথে সাথে ভোটারদের কিউ দীর্ঘ হয় কেন্দ্রের বাইরে। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারী ভোটারও দেখা যায় ভোট দেয়ার অপেক্ষায়। 

২০১১ সালের নির্বাচনে পরীক্ষামূলকভাবে কয়েকটি কেন্দ্রে ইভিএম পদ্ধতিতে ভোটগ্রহণ হলেও এবারই প্রথম এ সিটির ২৭টি ওয়ার্ডের ১৯২টি কেন্দ্রের এক হাজার ৩৩৩টি বুথে একযোগে ইভিএমে ভোট হয়। যন্ত্রে ভোট দেয়ার বিষয়টি অধিকাংশের জন্য ছিল নতুন এক অভিজ্ঞতা। আওয়ামী লীগের মেয়র পদপ্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভী সকালে শিশুবাগ বিদ্যালয়ে ইভিএমে ভোট দিয়ে স্বস্তি প্রকাশ করেন। তবে ৭ নম্বর ওয়ার্ডের কদমতলীতে একটি কেন্দ্রে ইভিএম নষ্ট হওয়ার খবর পাওয়ার কথাও তিনি জানান। সকালে নিজ কেন্দ্রে ভোট দিয়ে স্বতন্ত্র মেয়র পদপ্রার্থী তৈমূর আলম খন্দকার কয়েকটি কেন্দ্র পরিদর্শন করেন। এ সময় তিনি কোথাও কোথাও ভোটারের উপস্থিতি কম দেখে গণমাধ্যমের কাছে অভিযোগ করেন, ‘ইভিএম-ভীতির কারণে’ হয়তো মানুষ কম। ইভিএমে দ্রুত ভোট দিয়ে অনেকে যেমন উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন, বয়স্ক অনেকে আবার ভোগান্তিতে পড়েছেন আঙুলের ছাপ না মেলার কারণে।

শিশুবাগ বিদ্যালয় কেন্দ্রের সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার মোহাম্মদ বাদশা বলেন, ‘ভোটাররা ভোট দিতে গিয়ে অনেক সময় নিয়ে নিয়েছে। আমরা বাইরে থেকে বলে দেয়ার পরেও তারা বুঝতে পারেনি। আবার অনেকে আছে এক মিনিটের মধ্যে ভোট কাস্ট করে চলে গেছে।’ কোনো কোনো কেন্দ্রে ভোট নিতে এই বিলম্বের ফলে ভোটারদের লাইনে অপেক্ষার প্রহর দীর্ঘ হয়েছে। ভোটের পরিবেশ নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করলেও ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভী নিজেও ভোটদানে গতি বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছেন, যাতে সবাই ভোট দিতে পারেন। দুটি কেন্দ্রে কাউন্সিলর প্রার্থীর সমর্থকদের হাতাহাতির ঘটনা ছাড়া বড় কোনো গোলযোগ কোথাও হয়নি। একটি কেন্দ্রে এক কাউন্সিলর প্রার্থীর স্ত্রী ও সমর্থকদের ওপর হামলার অভিযোগ উঠেছে। কোথাও কোনো কেন্দ্র বন্ধ হয়নি। অনিয়মের কোনো অভিযোগও পাওয়া যায়নি। নির্বাচন কমিশনের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ বলেন, ‘ইভিএমে বেলা ৪টায় ভোট শেষ হয়েছে। আমরা যেমন ভালো নির্বাচন আশা করেছিলাম, সেরকম শান্তিপূর্ণ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হলো। কোনো ধরনের ঝামেলা ও গোলযোগ হয়নি; সুন্দর নির্বাচন হয়েছে।’

প্রধান দুই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভী ও তৈমূর আলম খন্দকার সকালে ভোট দিয়ে পরিবেশ নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেন। সেই সাথে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ ভোট হলে নিজেদের জয়ের প্রত্যাশার কথাও বলেন। ওয়ার্ডের দেওভোগের শিশুবাগ বিদ্যালয়ে ভোট দিয়ে আইভী বলেন, ‘আমি জানি, নারায়ণগঞ্জের মানুষ আমাকে বেছে নিয়েছে। তারা অলরেডি নির্ধারণ করে নিয়েছে কাকে ভোট দেবে। ইনশাআল্লাহ নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে আইভীর জয় হবেই হবে, নৌকার জয় হবেই হবে। গণজোয়ারের জয় হবেই হবে।’ 

আর ইসলামিয়া কামিল মাদ্রাসা কেন্দ্রে ভোট দিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী তৈমূর আলম খন্দকার বলেন, ‘ভোটের ব্যবধান হবে লক্ষাধিক, আল্লাহর রহমতে আমি লক্ষাধিক ভোটে জিতব।’ পরে বিকেলে আরেক ব্রিফিংয়ে ইভিএমের ভোটের ‘ত্রুটি’, ভোটারদের ‘হয়রানি’ ও যুবদলের এক নেতাকে গ্রেপ্তার নিয়ে গণমাধ্যমে অভিযোগ করেন বিএনপি থেকে অব্যাহতি পাওয়া স্বতন্ত্র প্রার্থী তৈমূর। নিজেদের মেয়াদের শেষ সময়ে বড় নির্বাচনটি দেখতে নারায়ণগঞ্জ গিয়েছিলেন নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার। তবে কেমন ভোট হচ্ছে তা নিয়ে মন্তব্য না করে শুধু বলেছেন, ‘বিদায় লগ্নে ভালো একটা নির্বাচন দেখতে চাই। তাই এখানে এসেছি।’