Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪,

ফুটপাতেই টাকার মেশিন

জানুয়ারি ১৭, ২০২২, ০৭:৩০ পিএম


ফুটপাতেই টাকার মেশিন

ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের আওতায় পুরো শহরে তিন লাখেরও বেশি অস্থায়ী দোকান রয়েছে। রাস্তার পাশে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা অস্থায়ী এসব দোকান থেকেই আসে কোটি কোটি টাকা। লাইনম্যান, ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী নেতা, স্থানীয় চাঁদাবাজ এমনকি পুলিশের পকেটেও নিয়মিত ভাগ হয়ে যায় এই টাকার বড় একটি অংশ।

ফুটপাতের পাশে এসব দোকান চালিয়ে হকারদের জীবন না চললেও অনায়েসেই অবৈধ এসব টাকায় সংসার চালাচ্ছেন এই চক্রের সদস্যরা, গড়ে তুলছেন টাকার পাহাড়। ঢাকার এই ফুটপাতই যেন টাকার মেশিন— এমনটাই বলছেন অপরাধ বিশেষজ্ঞরা। 

অনুসন্ধান বলছে, দোকান বসানোর অনুমতি নিতে লাইনম্যান নামে পরিচিত স্থানীয় সন্ত্রাসীদের দ্বারা গঠিত চক্রের কাছে নিয়মিত চাঁদা দিতে হয় হকারদের। দোকানের আকার এবং অবস্থানের ওপর ভিত্তি করে হকারদের দৈনিক ৫০ থেকে ১৫০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা গুনতে হয়। দিনশেষে ফেরিওয়ালাদের থেকে তোলা চাঁদার পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় তিন কোটি টাকার বেশি। 

আর নতুন দোকান বসাতে দিতে হয় পাঁচ হাজার থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকা পর্যন্ত। হিসাব অনুযায়ী মাসে প্রায় ৪০ কোটি এবং বছরে প্রায় ৫০০ কোটি টাকার বেশি চাঁদাবাজদের পকেটে যাচ্ছে। 

বিআইজিডির এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ঢাকার ফুটপাতে বছরে প্রায় এক হাজার ৮২৫ কোটি টাকা চাঁদাবাজি হয়, যা দুই সিটি কর্পোরেশনের সম্মিলিত বাজেটের প্রায় সমান।  

সরেজমিন দেখা যায়, রাজধানীর গুলিস্তান, বায়তুল মোকাররম, পল্টন, মতিঝিল, দৈনিক বাংলা মোড়, গোলাপশাহ মাজার, নিউ মার্কেট, জিরো পয়েন্ট, বঙ্গবন্ধু এভিনিউ এবং ফুলবাড়িয়ায় সবচেয়ে বেশি সংখ্যক দোকান রয়েছে। 

গুলিস্তানে ফুটপাতে ছয় বছর ধরে জুতার ব্যবসা করেন এমন একজন ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে আমার সংবাদকে বলেন, তিন ফুট জায়গার জন্য মাসে প্রায় ১২ হাজার টাকা লাইনম্যানদের দিতে হয়। টাকা না দিলেই চলে উচ্ছেদের পাঁয়তারা। 

হকারদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গুলিস্তান এবং এর আশপাশের এলাকায় ভ্রাম্যমাণ ও ফুটপাতে বসা হকারদের দিনে ন্যূনতম ৫০ থেকে ৫০০ টাকা দিতে হয়। নিউমার্কেট এলাকায় দৈনিক চাঁদার হারও প্রায় একই রকম।

এদিকে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে চলে শিফটভিত্তিক চাঁদাবাজি। এ এলাকায় প্রায় ২৪ ঘণ্টাই ফুটপাত ভাড়া হয়। একই জায়গায় সকালে সবজি, বিকাল থেকে রাত ১০টা অবধি হালিম বা ভাজা খাবারের দোকান আবার রাত ১০টার পর থেকে সকাল অবধি একই জায়গা ভাড়া দেয়া হয় ট্রাকের মালামাল নামানোর কাজে ব্যবহারের জন্য। এসব জায়গার ভিন্ন ভিন্ন মালিক ভিন্ন ভিন্ন নামে চাঁদা তুললেও নেই সরকারি ইজারা। প্রতিনিয়ত শিফটভিত্তিক পরিবর্তন হওয়া এসব মালিকের চাঁদাবাজির কারণে ভুক্তভোগীদের প্রশ্ন— ঢাকার মালিক কয়জন? 

সূত্র জানায়, প্রতিনিয়ত হকারদের রক্ত চুষতে চুষতে যাত্রাবাড়ীতে ১০ তলা বাড়ি করছেন এক হকার নেতা। এ ধরনের বেশ কয়েকজন রয়েছেন এ এলাকায়। এদের চাঁদা না দিলে ব্যবসা করা যায় না। পেশাদার চাঁদাবাজদের পাশাপাশি ছাত্রনেতারাও হরহামেশাই জড়াচ্ছেন এসব সিন্ডিকেটে। হাতিয়ে নিচ্ছেন মোটা অংকের টাকা। পুলিশকে জানিয়েও মেলে না সমাধান। যে এলাকায় চাঁদা ঠিকমতো আদায় হয় না সে এলাকায় হুটহাট চলে উচ্ছেদ অভিযান। আবার নতুন করে বছরভিত্তিক চাঁদা নিয়েও দোকানি বসানোর জন্য পুরনোদের উচ্ছেদ করা হয়। এভাবে সারা বছরই চলে দখল-উচ্ছেদের খেলা। 

২০১৭ সালে ফুটপাত দখলমুক্ত করতে হার্ডলাইনে যেতে হয়েছিল স্বয়ং দক্ষিণের মেয়র সাঈদ খোকনকে। ওই সময় সিদ্ধান্ত হয়, সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত ফুটপাতে কোনো হকার বসতে পারবে না। অফিস ছুটি হলে বিকেল ৫টার পর থেকে হকাররা বসতে পারবেন। ওই সময় পুলিশ ও নিজস্ব লোকবল দিয়ে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি করতে পেরেছিল সিটি কর্পোরেশন। এতে সাময়িক স্বস্তি মিললেও স্থায়ী সমাধান হয়নি আজও। 

সমাধান হবে কি-না তা নিয়েও রয়েছে নানা যোজন-বিয়োজন। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) এক গবেষণায় বলা হয়েছে, দুই সিটি কর্পোরেশন মিলে ঢাকার ফুটপাতের দৈর্ঘ্য ৪৩০ কিলোমিটার। 

এই ফুটপাত দখল করে অবৈধ পথে হকারদের ব্যবসা চলে। ঢাকার রাস্তায় আড়াই লাখের বেশি হকার ব্যবসা করে। ফুটপাতে বসতে একজন হকারকে এলাকাভেদে ৫০ থেকে ৫০০ টাকা লাইনম্যানদের দিতে হয়। লাইনম্যানদের মাধ্যমে এই টাকার ভাগ চলে যায় রাজনৈতিক নেতা, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসহ বিভিন্ন মহলে।

মতিঝিল এলাকার একাধিক হকার জানান, প্রতিদিন আমাদের লাইনম্যানদের টাকা দিতে হয়, পুলিশদের দিতে হয়, আবার ঝাড়ু দেয়ার নাম করে সিটি কর্পোরেশন থেকেও নিয়মিত টাকা নেয়। সব মিলিয়ে দিনে প্রায় চার থেকে পাঁচশ টাকা রাস্তায় খরচ হয়। এই এলাকার পুলিশের টাকা উঠানোর দায়িত্ব আমার। আমি টাকা উঠিয়ে রাখি স্যার (পুলিশ) এসে নিয়ে যান।

ফুটপাতে এসব চাঁদাবাজিতে পুলিশের ইন্ধন ও সম্পৃক্ততা বন্ধে কেমন পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে এমন প্রশ্নের উত্তরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. সাখাওয়াত হোসেন আমার সংবাদকে বলেন, শুধু সিটি কর্পোরেশন এলাকার অস্থায়ী দোকান নিয়ে নয়, থানায় সাধারণ ডায়েরি থেকে শুরু করে পুলিশ ভেরিফিকেশনেও ঘুষ দেয়া প্রথায় পরিণত হয়েছে। পুলিশের এসব অনিয়ম নিয়ে কেউ মুখ না খুললেও সবাই বিষয়টি জানেন। প্রধান সমস্যা আসলে নিয়োগ প্রক্রিয়া থেকেই শুরু হয়। একজন পুলিশ কনস্টেবল হতে গেলেও গুনতে হয় মোটা অংকের টাকা। 

তাছাড়া পদোন্নতি বা স্থানান্তর প্রক্রিয়ায় রয়েছে বেশ জটিলতা। দিনশেষে এসব ঘাটতি মেটাতে খুব সহজেই তারা দুর্নীতির এই চক্রে জড়িয়ে পড়েন। তবে আশার কথা হচ্ছে, বর্তমানে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অনেকটাই স্বচ্ছতা চলে এসেছে। এই স্বচ্ছতার পাশাপাশি পুলিশের সামগ্রিক দুর্নীতি বন্ধ করতে স্মার্ট মনিটরিং এবং অভিযুক্তদের দৃশ্যমান বিচারপ্রক্রিয়ার আওতায় এনে এ সমস্যার সমাধান সমাধান সম্ভব। আর রাজধানীর এসব হকারদের একটি নীতিমালার আওতায় এনে পুনর্বাসন জরুরি। 

এ প্রসঙ্গে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মো. মুনিবুর রহমান আমার সংবাদকে জানান, ফুটপাত থেকে টাকা আদায়ের এখতিয়ার পুলিশের নেই। কিন্তু পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে চাঁদা গ্রহণের অভিযোগ এলে আমরা অবশ্যই আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করব। 

পুলিশি জটিলতা এবং ভয়ভীতির কারণে অনেক হকারই মুখ খুলতে পারেন না বা উপর মহলে অভিযোগ জানাতে পারেন না, সেক্ষেত্রে কি করণীয়— এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানান, আমাদের কোনো স্তরে এ জাতীয় সমস্যা হলে তারা সরাসরি সংশ্লিষ্ট থানায় অথবা জরুরি সেবায় কল করেও সহায়তা নিতে পারেন। তাছাড়া আমাদের সকল কর্মকর্তাদের চেইন অব কমান্ড মেইনটেইন করতে হয়, এক্ষেত্রে এ জাতীয় সমস্যা হওয়ার কথা নয়। তাছাড়া এ ধরনের অপ্রত্যাশিত ঘটনা এড়াতে মাঠ পর্যায়েও আমাদের টিম কাজ করছে।

হকার উচ্ছেদ করা হলেও পুনরায় কিভাবে আবার ফুটপাত দখলে চলে যাচ্ছে এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানান, আমরা একাধিকবার উচ্ছেদ অভিযান চালিয়েছি কিন্তু ফলাফল দাঁড়িয়েছে সকালে উচ্ছেদ করলেও বিকালে তারা বসেছে আবার বিকালে উচ্ছেদ করলে রাতেই ফুটপাত দখলে চলে যায়। সামগ্রিক এই সমস্যা সমাধানে স্থানীয় প্রভাবশালী নেতা এবং সংশ্লিষ্টদের সহযোগিতা এবং সদিচ্ছা প্রয়োজন বলে জানান তিনি। তবে আশার কথা হলো, এ জাতীয় সমস্যা নিরসনে আমরা প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছি। 

এ বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন নগর পরিকল্পনা বিভাগের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ মো. সিরাজুল ইসলাম আমার সংবাদকে জানান, সিটি  কর্পোরেশনের আওতাভুক্ত এলাকা নিয়ে আধুনিক ঢাকা গড়ার পরিকল্পনা রয়েছে আমাদের। নগর পরিকল্পনায় রাস্তার পাশে এসব দোকান বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি করে, সুতরাং এ সংক্রান্ত সমস্যা সমাধানে প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছি। উচ্ছেদ অভিযান বাস্তবায়ন এবং হকারদের নির্ধারিত স্থানে পুনর্বাসন করা জরুরি বলেও জানান তিনি। 

বাংলাদেশ হকার্স ফেডারেশনের একাধিক নেতা জানান, রাস্তায় হকার বসার জন্য দায়ী পুলিশ। পুলিশই হকার বসায়। লাইনম্যানদের দিয়ে এ কাজ করানো হয়। রাস্তা থেকে হকার উচ্ছেদ করা হোক। কিন্তু পুনর্বাসন ছাড়া ফুটপাতের হকার উচ্ছেদ না করার দাবি জানান তারা। এ সমস্যা সমাধানে দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের উচ্ছেদ অভিযানের ফলাফল, সামনের পরিকল্পনা, চিহ্নিত চাঁদাবাজ, নীতিমালা ও করণীয় সম্পর্কে জিজ্ঞাসা থাকলেও দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা মো. রাসেল সাবরিনের সাথে একাধিকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।