Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪,

চিঠি চালাচালিতেই ছয় বছর

জানুয়ারি ২৪, ২০২২, ০৭:৪৫ পিএম


চিঠি চালাচালিতেই ছয় বছর
  • এক লাখ মানুষের বিপরীতে বিচারক আছেন একজন
  • একজন বিচারক প্রশাসনিকসহ ৪০ ধরনের কাজ করেন
  • সচিব কমিটিতে আটকে আছে অতিরিক্ত জেলা জজদের পদ সৃজন
  • জনপ্রশাসনে ঝুলে আছে দেড় হাজার পদ সৃজনের প্রস্তাব
  • সর্বোচ্চ আদালতের সুপারিশ দ্রুত বাস্তবায়ন চান আইনজ্ঞরা

অবকাঠামোগত সংকট কাটেনি। রয়েছে বিচারক সংকট। নেই প্রয়োজনীয় বিচার সহায়ক জনবলও। বিচারকদের পর্যাপ্ত বসার জায়গারও সংকট রয়েছে। মামলা ভারে ফাইল রাখার জায়গারও সংকুলান হচ্ছে না। বিচারক যারা আছেন তাদের অনেকের কর্মদিবস চলে এজলাস ভাগাভাগি করে। আবার প্রতিনিয়তই বাড়ছে মামলার হার। তবে নানা সমস্যায় পড়ে নিষ্পত্তির হার বাড়ছে না। ফলে দিন দিন সৃষ্টি হচ্ছে মামলার মহাজট। বিভিন্ন উদ্যোগের পরও জট কমানো সম্ভব হচ্ছে না। ফলে সংকটে পড়ে বিচার প্রক্রিয়ায় নেমে এসেছে ধীরগতি। ভুগছেন বিচারপ্রার্থীরা। মামলা রায় পেতে লেগে যাচ্ছে বছরের পর বছর। নানামুখী সমস্যার সমাধান না হওয়ায় একপ্রকার বাধ্য হয়েই প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল বিচারক নিয়েই চলছে বিচার বিভাগ। 

বর্তমানে উচ্চ আদালতসহ নিম্ন আদালতগুলোতে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ৪১ লাখ ৭১ হাজার ৫৭২টি। এর মধ্যে নিন্ম আদালতে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ৩৬ লাখ ৬১ হাজার ৭৬১টি। এই সংখ্যা প্রতিদিন বাড়ছেই। বিচারক স্বল্পতাকেই মামলা জটের অন্যতম কারণ হিসেবে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা। এদিকে মামলা জট কমাতে অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজের ১১২টি পদ সৃষ্টি করতে ২০১৬ সালে চিঠি দেয় সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন। 

এছাড়া যুগ্ম জেলা জজের ১৫৯টি পদ সৃষ্টি করতে ২০১৭ সালে আরেকটি চিঠি দেয়া হয়। তবে মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেয়ার ছয় বছর পেরিয়ে গেলেও কাজের কাজ হয়নি। দীর্ঘ সময়েও সর্বোচ্চ আদালতের সুপারিশ বাস্তবায়ন হয়নি। নতুন পদ সৃজনের বিষয়টি শুধু চিঠি চালাচালিতেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। তবে কবে নাগাদ নতুন পদ সৃজন করা হবে সে বিষয়েও কোনো সুনির্দিষ্ট কিছু জানা যায়নি।

শুধু অধঃস্তন আদালতই নয়, গত এক দশকে দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্ট থেকে দেশের সব আদালতে মামলার সংখ্যা বাড়লেও বাড়েনি বিচারকের সংখ্যা। বরং আগে বিচারকের সংখ্যা যা ছিল, তুলনামূলক সেটাও কমেছে। সব চেয়ে বেশি বিচারক সংকট রয়েছে চট্টগ্রামের আদালতে। 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিচারক সংকট কাটাতে সুপ্রিম কোর্টের পাশাপাশি আইন কমিশনও কাজ করছে। বিচারকদের নতুন পদ সৃষ্টিতে একাধিকবার চিঠি দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন। সুপ্রিম কোর্টের চিঠির পর বিচারকদের পদ সৃষ্টি করতে চেষ্টা করা হচ্ছে। প্রায় দেড় হাজার পদ সৃষ্টির প্রস্তাব জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে বিবেচনাধীন রয়েছে। এছাড়া অতিরিক্ত জেলা জজদের ৭৩টি পদ সৃষ্টি হওয়ার পরও সেটা এখন সচিব কমিটিতে অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে বলেও জানা গেছে। 

অপরদিকে,  যুগ্ম জেলা জজের পদ সৃজনের বিষয়টি অর্থ মন্ত্রণালয় অনুমোদনের পর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে ঝুলে আছে বলে জানা গেছে। তবে কবে নাগাদ এটি বাস্তবায়ন হচ্ছে সে বিষয়ে স্পষ্ট করে বলতে পারেননি কেউ।

আইন বিশেষজ্ঞরা বলেন, বিচারপ্রক্রিয়া গতিশীল করতে হলে বিচারের প্রধান নিয়ামক বিচারক সংখ্যা বাড়াতে হবে। সুপ্রিম কোর্ট চিঠি দেয়ার পরও তা দ্রুত সময়ের মধ্যে বাস্তবায়ন না হওয়া দুঃখজনক। বিচারকদের পদ সৃজন করতে আইন মন্ত্রণালয়কে আরো বেশি তাগিদ দিতে হবে। তারা বলেন, এই মুহূর্তে দরকার জেলা ও দায়রা জজের সিভিল ও ক্রিমিনাল জুরিসডিকশন আলাদা করে দিয়ে প্রত্যেক জেলায় পৃথক দু’জন জেলা সেশন’স জজ ও জেলা সিভিল জজের নেতৃত্বে দু’টি আলাদা বিচারিক কাঠামো তৈরি করা। প্রতিবেশী দেশগুলো এটা করেছে, সুফলও পাচ্ছে। এটা করা অতি জরুরি। সাথে সাথে বিচারক সহায়ক জনবলও বৃদ্ধি করতে হবে। 

অনেক জায়গায় শোনা যায়, সহকারী জজ ও সিনিয়র সহকারী জজরা সহায়ক কর্মচারী স্টেনো-টাইপিস্ট দাবি করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গেছেন। বিভিন্ন জেলায় অতিরিক্ত যে কয়েকটি যুগ্ম জেলা জজের পদ সৃজন করা হয়েছে তাতে সহায়ক পর্যাপ্ত কর্মচারীর পদ নেই। অন্য আদালত থেকে ধার করা স্টাফ দিয়ে জোড়াতালি দিয়ে চলছে। এ সব সমস্যা দ্রুত সমাধানেরও তাগিদ দেন তারা। 

সংকট যেসব কোর্টে : ঢাকা সিএমএম কোর্টে ডেসকোসহ ৫০টি কোর্ট আছে। সিএমএম অভ্যন্তরেই আছে ৩৫টি কোর্ট। আর অফিসের বাইরে ডেসকো, ডেসাসহ অন্যান্য স্থানে আরো ১৫টি কোর্ট আছে। প্রতিটি আদালতে একজন করে বিচারক থাকার কথা থাকলেও আছেন ১৫ জন।  এ ছাড়া প্রতিটি জেলায়, থানাপ্রতি একজন সহকারী জজ থাকার কথা থাকলেও সেখানে পুরো জেলা মিলেই এ পদে বিচারক আছেন মাত্র দুইজন। একই সাথে সিনিয়র সহকারী জজও আছেন দুইজন। আবার কিছু কিছু জেলায় তা-ও নেই বলে জানা গেছে। 

এ ছাড়া বিচারক নেই ঢাকার পারিবারিক আদালত-২, চট্টগ্রাম বিভাগীয় বিশেষ জজ আদালত, রংপুর ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনাল, মানিকগঞ্জ দ্বিতীয় যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজের যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ আদালত-২, পরিবেশ আপিল ট্রাইব্যুনাল, বিশেষ জজ আদালত-৫ ও ঢাকার প্রথম শ্রম আদালত, বিচারকশূন্য রয়েছে ময়মনসিংহ অতিরিক্ত জেলা জজ আদালত, চট্টগ্রাম অতিরিক্ত জেলা জজ আদালত, চট্টগ্রাম দেউলিয়া আদালত, রাজশাহী অতিরিক্ত জেলা জজ আদালত, গাইবান্ধা অতিরিক্ত জেলা জজ আদালত, ভোলা অতিরিক্ত জেলা জজ আদালত, চুয়াডাঙ্গা অতিরিক্ত জেলা জজ আদালত, পিরোজপুর অতিরিক্ত জেলা জজ আদালত, গাজীপুর চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত ও রংপুর চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত, সাতকানিয়া চৌকি সহকারী জজ আদালত ও সাতকানিয়া অতিরিক্ত সহকারী জজ আদালত, পটিয়া চৌকিতে দুটি সহকারী জজ আদালত, রাউজান সিনিয়র সহকারী জজ আদালত, সহকারী জজ লোহাগাড়া আদালত সাতকানিয়া চৌকি, অতিরিক্ত জেলা জজ বাঁশখালী আদালত, জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বন আদালত।

আইন কমিশনের পর্যবেক্ষণ : মামলাজট নিয়ন্ত্রণে আনতে ২০১৫ সালের আগস্টে আইন কমিশনের পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে বলা হয়— দেশে প্রতি ৪০ হাজার জনসংখ্যার জন্য একজন করে বিচারক প্রয়োজন। সে হিসাবে চার হাজার বিচারক নিয়োগের প্রয়োজন থাকলেও আইন কমিশন সে সময় আপাতত দুই হাজার ৪০০ বিচারক নিয়োগের সুপারিশ করে। অবশ্য তখন দেশে জনসংখ্যা ছিল প্রায় ১৬ কোটি এবং বিচারাধীন মামলা ছিল প্রায় ৩০ লাখ। আর এখন জনসংখ্যা এসে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৯ কোটি, কিন্তু বিচারক আছেন মাত্র দুই হাজার। পাঁচ বছরেও বিচারক নিয়োগে কমিশনের সেই সুপারিশ বাস্তবায়িত হয়নি। 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, ‘মামলাজট ছাড়া আর কোনো সমস্যাই আমার কাছে বড় মনে হয় না। প্রায় ৪০ লাখ মামলার জট। এই বিশাল পরিমাণ মামলা না কমানো গেলে বিচারপ্রার্থী জনগণের দুর্ভোগ দূর করা যাবে না। বিচার-প্রক্রিয়া গতিশীল করতে হলে পর্যাপ্ত বিচারক নিয়োগ দিতে হবে। নতুন ট্রাইব্যুনাল সৃজনের আগে অবকাঠামো ও বিচারক নিয়োগের বিষয়টি আগে বিবেচনা করতে হবে। তা না হলে অন্যান্য বিচারকদের ওপর চাপ বাড়ে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে আইন কমিশনের চেয়ারম্যান ও সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক বলেন, ‘আমরা সে সময় যেটি সঠিক মনে করেছিলাম সেটিই উল্লেখ করেছিলাম। আমরা আমাদের কাজ করে দিয়েছি। এটি কতটুকু বাস্তবায়ন হয়েছে বা হয়নি তা আমাদের জানা নেই। এখন আইন মন্ত্রণালয় কী করবে সেটি তাদের ব্যাপার।’

এক আদালতের বিচারকের ঘাড়ে অন্য আদালতের মামলা : অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারকরা একাধারে দেওয়ানি, অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ, আপিল ট্রাইব্যুনাল, দায়রা আদালত, শিশু আদালত ও বিশেষ ট্রাইব্যুনাল হিসেবে দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলার বিচার করেন। এছাড়া যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ একই সাথে দেওয়ানি আদালত, অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ ট্রাইব্যুনাল, দায়রা আদালত ও বিশেষ ট্রাইব্যুনাল হিসেবে দেওয়ানি এবং ফৌজদারি মামলার বিচার করেন। যুগ্ম মহানগর দায়রা জজ আদালত অপেক্ষাকৃত গুরুতর দায়রা মামলার বিচার করেন। আর আর্থিক প্রতিষ্ঠান কর্তৃক প্রদত্ত ঋণ আদায় সংক্রান্ত মামলার বিচার করেন অর্থঋণ আদালত। 

এ ছাড়া পারিবারিক আদালত, স্মল কজেজ কোর্ট, বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রক। এগুলো চাপানো হয়েছে সহকারী বা সিনিয়র সহকারী জজ আদালতের ওপর। আবার, দ্রুত বিচার আদালত, বিশুদ্ধ খাদ্য আদালত, স্পেশাল ম্যাজিস্ট্রেট (পরিবেশ) আদালত, বন আদালত এগুলো সব চাপানো হয়েছে সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের ওপর। আলাদা আদালতের ভারগুলো চাপানোর ফলে এই আদালতগুলো মামলার ভারে ভারাক্রান্ত। যুগ্ম জেলা জজ আদালতে চার লাখ টাকার উপরে অসীম সংখ্যা পর্যন্ত মামলা হয়। এই আদালত আবার অর্থঋণ আদালত হিসেবে কাজ করে। এই আদালতই আবার সহকারী জজের আপিলও শুনেন। ফলে তিন ধাপের বিচারকাজ চালিয়ে মামলাজট সৃষ্টি হবেই, স্বাভাবিক।  

আবার যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ আদালত আবার ফৌজিদারি মামলারও বিচার করেন। তিনি আবার স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল। অস্ত্র মামলাসহ গুরুতর অপরাধের বিচার করেন। অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজও আপিল শুনেন। দেওয়ানি ও ফৌজদারি উভয় মামলার বিচার করেন। স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল হিসেবেও তিনি কাজ করেন। অথচ এই পদমর্যাদার কর্মকর্তা দ্বারা নতুন ট্রাইব্যুনাল হওয়ার কথা। কিন্তু ট্রাইব্যুনাল এখন পর্যন্ত গঠন করা হয়নি। আইন মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবও ফেরত দেয়া হয়েছে। 

কারণ, আইন অনুযায়ী ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হলে ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক বিচার্য হওয়ায় ভ্রাম্যমাণ আদালত মাদক আইনে মোবাইল কোর্ট করার ক্ষমতা হারাবে। নতুন শিশু আইন-২০১৩ প্রণীত হয়েছে। এর ভার আগে চাপানো হয়েছিল অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতের ওপর। বর্তমানে চাপানো হয়েছে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের ওপর।

জেলা ও দায়রা জজ আদালত জেলার সর্বোচ্চ আদালত। এই আদালতের বিচারক পদাধিকারবলে সিনিয়র স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল। তিনি দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলার আপিল, রিভিশন শুনেন। সব ম্যাজিস্ট্রেটের তিনি আপিলেট, রিভিশনাল অথরিটি। জেলা ও দায়রা জজকে একাধারে প্রশাসনিক কাজসহ বিচারকাজও করতে হয়। তিনি পদাধিকার বলে জেলা লিগ্যাল এইড কমিটির সভাপতি। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল না থাকলে তিনিই আবার নিজ দায়িত্বের অতিরিক্ত নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল হিসেবে বিচারকাজ পরিচালনা করেন। 

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের ওপর মানবপাচার ট্রাইব্যুনালের বোঝা চাপানো হয়েছে। এখনো প্রয়োজনীয় সংখ্যক মানবপাচার ট্রাইব্যুনাল, প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল, সাইবার ট্রাইব্যুনাল, শিশু আদালত, দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল সৃষ্টি হয়নি। এই আদালতগুলোর দায়িত্ব অন্য আদালতের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। জেলা ও দায়রা জজের কাজের পরিধি হিসাব করে দেখা গেছে, তিনি বিচারিক ও প্রশাসনিক কাজ মিলে মোট ৪০ ধরনের কাজের সাথে জড়িত।