Amar Sangbad
ঢাকা রবিবার, ২০ জুলাই, ২০২৫,

বাঙালির আত্মপরিচয়ের একুশ

শিবু দাশ সুমিত

ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২২, ০৭:১৫ পিএম


বাঙালির আত্মপরিচয়ের একুশ

হুমায়ুন আজাদ চমৎকার করে বলেছিলেন ‘তোমার ‘অ, আ’ চিৎকার সমস্ত আর্যশ্লোকের চেয়েও পবিত্র অজর’। বাংলা ভাষামনের ভাব প্রকাশের অন্যতম মাধ্যম ভাষা। মানুষের যাবতীয় চিন্তা-ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দেয় ভাষা। মানুষের আত্মপ্রকাশের সবচেয়ে বড় মাধ্যম হলো যে ভাষায় মানুষ প্রথম কথা বলতে শেখে, চিন্তা করতে শেখে সেই ভাষা অর্থাৎ তার মাতৃভাষা। কিন্তু বাঙালির মাতৃভাষায় কথা বলাটা এত সহজ ছিল না। 

বারবার আমাদের মাতৃভাষা বাংলাকে নিয়ে প্রাসাদ ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল যাতে বাংলা ভাষায় এই অঞ্চলের মানুষ কথা বলতে না পারে। যদি ভারতবর্ষ ভাগ হয় তবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হবে তা নিয়ে একটি বিতর্ক অবশ্য বেশ আগে থেকেই চলছিল। সে সময় অবশ্য পাকিস্তানের স্পষ্ট কোনো ধারণাও ছিল না। 

১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট রাত ১২টায় মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ভ্রান্ত দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে যখন ভারত ভাগ হয়েছিল তার আগেই আসলে শুরু হয়েছিল ভাষা নিয়ে বিতর্ক। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে এক হাজার ২০০ মাইলের অধিক দূরত্ব, ভাষার ভিন্নতা, সাংস্কৃতিক বৈপরীত্ব থাকলেও শুধুমাত্র ধর্মীয় কারণে দুটি আলাদা অঞ্চলকে একসাথে জুড়ে দেয়া হয়। 

এরপরই ভাষা নিয়ে বিতর্ক তীব্র থেকে তীব্রতর হতে শুরু করে। এর আগে ১৯৩৭ সালে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ মুসলিম লীগের দাপ্তরিক ভাষা উর্দু প্রবর্তনের সুপারিশ করলে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের বিরোধিতায় তা বাতিল হয়ে যায়। এরপর ভাষা নিয়ে বিভিন্ন সময় বিতর্ক হলেও ১৯৪৭ এর পর সেটি অগ্নিগর্ভ রূপ ধারণ করে। 

অবিশ্বাসের শুরু : ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর কিছুদিনের মধ্যেই পাকিস্তানের প্রথম মুদ্রা, ট্রেনের টিকেট, ডাকটিকেট, পোস্টকার্ড ইত্যাদি থেকে বাংলাকে বাদ দিয়ে উর্দু ও ইংরেজি ভাষা ব্যবহার করা হয়। ভাষা সৈনিক আবদুল মতিন (ভাষা মতিন) ও আহমেদ রফিক তাদের লেখা ‘ভাষা আন্দোলন-ইতিহাস ও তাৎপর্য’ শীর্ষক বইতে উল্লেখ করেছেন— ‘প্রথম লড়াইটা প্রধানত ছিল সাহিত্য-সংস্কৃতির অঙ্গনেই সীমাবদ্ধ।’ আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য ডক্টর জিয়াউদ্দিন আহমেদ অবশ্য উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব করেছিলেন ১৯৪৭ সালে। তখন ভাষা নিয়ে বিতর্ক আবারো জেগে উঠেছিল। ততদিনে পূর্ব বাংলার বাঙালিদের আত্ম-অন্বেষণ শুরু হয়ে গিয়েছিল। 

তমদ্দুন মজলিসের উত্থান : বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বহু সংগঠন ও ব্যক্তির অবদান থাকলেও তমদ্দুন মজলিস ও এর প্রতিষ্ঠাতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞানের তরুণ শিক্ষক আবুল কাসেমের অবদান ছিল উল্লেখ করার মতো। এই সংগঠনের মাধ্যমে রাষ্ট্রভাষার দাবি প্রথম সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনে রূপ নেয়। তরুণ শিক্ষক আবুল কাশেম ঢাকায় প্রতিষ্ঠা করলেন তমদ্দুন মজলিস। কাজী মোতাহার হোসেন, আবুল মনসুর আহমদ ও আবুল কাসেমের মোট তিনটি প্রবন্ধের সমন্বয়ে ১৯৪৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত হলো ভাষা আন্দোলনের ওপর প্রথম বই ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু?’
 
রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ থেকে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ : ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ এই একটিমাত্র স্লোগানই সব মত ও পথকে একটি মোহনায় নিয়ে এসেছিল। রাষ্ট্রভাষার আন্দোলনই আমাদের রাজনীতিবিদদের সর্বপ্রথম এক ও অভিন্ন প্লাটফর্মে নিয়ে আসে। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে প্রথমবার রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয় ১৯৪৭ সালের ১ অক্টোবর যার আহ্বায়ক ছিলেন নুরুল হক ভূঁইয়া। দ্বিতীয় বার রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয় ১৯৪৮ এর ২ মার্চ। এম আর মাহবুবের লেখা ‘রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলন ও একুশের ইতিহাসে প্রথম’ গ্রন্থে এ সম্পর্কে বলা হয়, ১৯৪৮ সালের ২ মার্চ ফজলুল হক হলে কামরুদ্দীন আহমদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত তমুদ্দিন মজলিস ও মুসলিম ছাত্রলীগের এক যৌথ সভায় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ সমপ্রসারণ করে প্রথম সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। 

ভাষা আন্দোলনের বিস্তার : মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠায় ভাষা আন্দোলনের আনুষ্ঠানিক সূচনা হয়েছিল ১৯৪৮-এর ১১ মার্চ। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘আমরা দেখলাম, বিরাট ষড়যন্ত্র চলছে বাংলাকে বাদ দিয়ে রাষ্ট্রভাষা উর্দু করার।’ ১৯৪৮ সাল থেকেই ১১ মার্চকে ‘বাংলা ভাষা দাবি’ দিবস হিসেবে পালন করা হয়। ১৯৪৮ সালের এই দিনে পূর্ব বাংলার সাহসী ছাত্রজনতা একটি সর্বাত্মক ও কার্যকর ধর্মঘট পালনের মধ্য দিয়ে ভাষার দাবিকে জোরালো ও আরও সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে আসে। আন্দোলন ছাত্র, জনতা, কৃষক, শ্রমিক, মজুরসহ সর্বস্তরের মানুষের মাঝে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে যায়। ১৯৪৮ সালের এই দিনে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ দাবিতে সর্বাত্মক সাধারণ ধর্মঘট পালন করতে গিয়ে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন সে সময়কার উজ্জ্বল ছাত্রনেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ আরও অনেকে। এরপর থেকেই ধীরে ধীরে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি জোরদার হতে শুরু করে। 

জিন্নাহ ও পাকিস্তানি শাসকদের অনমনীয় অবস্থান : সে সময় পাকিস্তানে ৫৬% এর অধিক বাংলাভাষী থাকলেও পাকিস্তান সরকার বারবার বাংলা ভাষার দাবি অস্বীকার করে এসেছে। ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে পাকিস্তানের গভর্নর মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকা সফরে আসেন। একনায়কী স্বভাবের জিন্নাহ ২১ মার্চ রেসকোর্স ময়দানের নাগরিক সংবর্ধনা সভায় এবং ২৪ মার্চ কার্জন হলে বিশেষ সমাবর্তনের ছাত্রসভায় বেশ জোরালো ভাষায় বলেন, পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু। যারা এর বিরোধিতা করে, তারা পাকিস্তানের দুশমন। তাদের কঠোর হাতে দমন করা হবে। কার্জন হলে উপস্থিত অসংখ্য ছাত্র তখনই ‘নো-নো’ বলে প্রতিবাদ করে ওঠেন। ১৯৫২ সালের জানুয়ারি মাসে খাজা নাজিমুদ্দিন আবার ঘোষণা করলেন ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু।’ পুনরায় আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে।
 
অগ্নি স্ফুলিঙ্গের বিস্ফোরণ : খাজা নাজিমুদ্দিন বাঙালি হয়েও ঘোষণা দিলেন উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। তার ঘোষণায় পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের মনে বঞ্চনার অনুভূতি আরও জোরালো হয়ে জেগে ওঠে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ৩০ জানুয়ারি সভা ও ছাত্র ধর্মঘট আহ্বান করে। ৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা শহরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সর্বাত্মক ধর্মঘট পালিত হয়। এভাবে আন্দোলন চলতে থাকে। ছাত্রজনতার নানামুখী আন্দোলন ও প্রস্তুতির ভেতর দিয়ে উপস্থিত হয় ২১ ফেব্রুয়ারির ভোর। দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। 

সেদিন সারা শহরে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ নেতারা রাত থেকেই বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় অবস্থান করলেও সকাল হতেই পুলিশ সারা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা কর্ডন করে ফেলে। নেতৃবৃন্দের নির্দেশ সংবলিত চিরকুট আগে থেকেই বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পৌঁছে দেয়া হয়। সময় গড়ানোর সাথে সাথেই সভাস্থল জনসমুদ্রে পরিণত হয়। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ নেতা শামছুল আলম, কাজী গোলাম মাহবুব, খালেক নেওয়াজ খানসহ আরও কয়েকজন ১৪৪ ধারা না ভাঙার পক্ষে মত দিলেও আব্দুল মতিনের নেতৃত্বে সাধারণ ছাত্র সমাজ ১৪৪ ধারা ভাঙার পক্ষে অবস্থান নেন। 

সভায় গাজীউল হক, আব্দুল মতিনরা ১৪৪ ধারা ভাঙার পক্ষে জোরালো বক্তব্য রাখেন যাতে করে ছাত্ররা ব্যাপক উদ্বুদ্ধ হয়। ঠিক হয় ১০ জনের একটি করে দল বেরিয়ে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা হবে। ১০ জন বের হয়ে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের প্রস্তাবটি পেশ করেন আবদুস সামাদ আজাদ। পরবর্তীতে যাকে বিখ্যাত ‘১০ জনী মিছিল’ হিসেবে অভিহিত করা হয়। তার মতে, শিক্ষার্থীরা যদি একত্রে মিছিলে নামে তবে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। তাই প্রতি দফায় তারা ১০ জন করে রাস্তায় মিছিল বের করবে। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রক্টর মুজাফফর আহমেদ চৌধুরী এ বক্তব্য সমর্থন করেন এবং কলাভবনের গেট খুলে দেয়ার নির্দেশ দেন। প্রথম দলের নেতৃত্ব দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের মেধাবী ছাত্র হাবিবুর রহমান শেলী (সাবেক প্রধান বিচারপতি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা)। ১৪৪ ধারা ভঙ্গকারী দলগুলোর মধ্যে ছাত্রীদের একটি দলও যোগদান করে। শান্তিপূর্ণ মিছিলে পুলিশ লাঠিচার্জ ও কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে। ছাত্ররা দৌঁড়ে কলাভবনের পুকুরে এসে রুমাল ভিজিয়ে চোখ মুছে আবার মিছিলে যোগ দেন। ছাত্ররা আত্মরক্ষার্থে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ শুরু করে। পুলিশের পাল্টা হামলায় ছাত্রদের একটি বড় অংশ মেডিকেল কলেজের সামনে জড়ো হয়। এখানে পুলিশ আকস্মিকভাবে ছাত্রদের ওপর গুলিবর্ষণ শুরু করে। পুলিশের গুলিতে আবুল বরকত, রফিক উদ্দিন, আব্দুল জব্বার ঘটনাস্থলে নিহত হন। একই বছরের এপ্রিল মাসে আব্দুস সালাম মেডিকেল কলেজে মারা যান। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঠিক কতজন শহীদ হয়েছিলেন তার সঠিক সংখ্যা পাওয়া যায়নি। তবে সেদিন ও পরদিন ২২ ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার এবং শফিউর ছাড়াও আরও অনেকে শহীদ হয়েছিলেন বলে ভাষা আন্দোলন নিয়ে বিভিন্ন বইয়ে উঠে এসেছে।

অবশেষে এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ : প্রায় দুই বছর পর ১৯৫৪ সালের ৭ মে পাকিস্তানের গণপরিষদ বাংলাকে একটি রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকার করে প্রস্তাব গ্রহণ করে। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান প্রণীত হয়। সংবিধানের ২১৪নং অনুচ্ছেদে উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকেও রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেয়া হয়। 

বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষ : ১৯৫২-এর ২১ ফেব্রুয়ারির হত্যাকাণ্ড মাতৃভাষার অধিকারের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। এই আন্দোলনের মাধ্যমেই পরিষ্কার হয়ে উঠেছিল যে, দেড় হাজার কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত দুটি ভূখণ্ডের দুটি ভিন্ন ভাষার জাতিসত্তা কখনো এক হতে পারে না। যার চূড়ান্ত প্রতিফলন ঘটেছিল ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ অর্জিত হওয়ার মাধ্যমে। 

লেখক : সহকারী কমিশনার ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট

জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, নড়াইল