ফেব্রুয়ারি ১৯, ২০২২, ০৬:১৫ পিএম
ক্রমেই বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় হয়ে উঠছে অনলাইন শপিং। সে ক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই আমাদের দেশও। জনপ্রিয় ও সহজলভ্য এই ব্যবসার প্রসারের সাথে সাথে একে ঘিরে গড়ে উঠেছে এক শ্রেণির প্রতারক চক্র। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর ইচ্ছাকৃত দুর্বলতার সুযোগে চক্রটি হাতিয়ে নিচ্ছে গ্রাহকদের হাজার কোটি টাকা।
দ্রুত প্রসার হওয়া অনলাইন ব্যবসার প্রতিটি ধাপে গ্রাহকদের যে ধরনের আইনি নিরাপত্তা দরকার ছিল তা কিন্তু নেই। আইন প্রণয়নকারী প্রতিষ্ঠানগুলো খানিকটা নির্বিকার। দৃশ্যত তারা নীরব দর্শকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। অনিরাপদ বিনিয়োগে সর্বসান্ত গ্রাহক জানেন না কে দেবে তাদের পুঁজির নিরাপত্তা। অথচ গ্রাহকের মূলধনের নিরাপত্তা দিতে রাষ্ট্র ও সরকারের দায় রয়েছে।
ই-কমার্স ব্যবসা বাংলাদেশে ২০০০ সালে প্রথম শুরু করে মুন্সিব্জি ডটকম নামে একটি প্রতিষ্ঠান। ধীরে ধীরে এই খাত বিকশিত হতে থাকে। একই সাথে বাড়তে থাকে প্রতারণা ও গ্রাহক হয়রানি। গ্রাহকদের সাথে প্রতারণার দায়ে গত বছর ২৪টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ১০৫টি মামলা হয়েছে, যদিও অভিযোগ ছিল ৩৩টির বিরুদ্ধে।
প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, বর্তমানে দেশে প্রায় ৩০ হাজার ই-কমার্স শপ রয়েছে। এছাড়া ফেসবুক ভিত্তিক (এফ কমার্স) প্রতিষ্ঠান আছে প্রায় ৫০ হাজার। এর মধ্যে ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) নিবন্ধিত সদস্য রয়েছে এক হাজার ৬৫৬টি। অনিয়মে জড়িত থাকায় আটটি প্রতিষ্ঠানের সদস্যপদ স্থগিতও করেছে ই-ক্যাব।
সাম্প্রতিককালে কয়েকটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান গ্রাহকদের সাত হাজার কোটি টাকারও বেশি আত্মসাত করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এর মধ্যে আলেশা মার্ট প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা, ই-অরেঞ্জ ১১শ কোটি টাকা, ই-ভ্যালি প্রায় ৪০৪ কোটি টাকা, ধামাকা ৩৬৫-৩৮০ কোটি টাকা, কিউকম ২৫০ কোটি টাকা, সিরাজগঞ্জ শপে গ্রাহক ও বিনিয়োগকারীসহ ৩৪৭ কোটি টাকা, রিং আইডি দেড় হাজার কোটি টাকা, দালাল প্লাস ৫০০ কোটি টাকা, আলাদিনের প্রদীপ ১০০ কোটি টাকা ও আদিয়ানা মার্ট সাত কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে। এ ছাড়াও বুম বুম শপ, নিডস ডটকম, বাজাজ কালেকশন, টোয়েন্টিফোর ক্রিকেট ডটকম, গ্রিন বাংলা, এক্সিলেন্ট ওয়ার্ল্ড অ্যাগ্রো ফুড অ্যান্ড কনজ্যুমারস, গ্লিটার্স আরএসটি ওয়ার্ল্ড এবং নেট ডটকম সম্পর্কে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
ক্রমাগত প্রতিষ্ঠানগুলোর গ্রাহক ও ভোক্তাদের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের ১৬ সেপ্টেম্বর প্রথমবারের মতো ই-কমার্স খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ই-ভ্যালির চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিন ও সিইও মো. রাসেলকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। এরপর একে একে গ্রেপ্তার করা হয় ই-অরেঞ্জ, কিউকম, আদিয়ানা মার্ট ও রিং আইডির পরিচালক ও কর্মকর্তাদের। এ পর্যন্ত আটটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের মালিক ও কর্মকর্তা মিলিয়ে ২০ জনকে গ্রেপ্তার করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
তবে এখনো ধামাকার জসিম উদ্দিন চিশতী, আলাদিনের প্রদীপের মেহেদী হাসান মুন, দালাল প্লাসের এস এম রাব্বি আল মামুন, সিরাজগঞ্জ শপের জুয়েল রানা, রিং আইডির চেয়ারম্যান আইরিন ইসলাম ও এমডি শরিফুল ইসলামসহ অনেকে বিদেশে অবস্থান করায় গ্রেপ্তার করা যায়নি। তবে তাদের কেউ কেউ দেশে অবস্থান করে আত্মগোপন করছেন বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে।
এদিকে গ্রাহকদের অভিযোগের প্রেক্ষিতে সমস্যা সমাধানে কাজ করছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। চলতি বছরের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী ব্যবসায়িক বিভিন্ন ফেসবুক পেজসহ ৪২টি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ২৬ হাজার ৪৯১টি অভিযোগ জমা পড়েছে সংস্থাটিতে। শুধু ফেসবুক ভিত্তিক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগ পড়েছে পাঁচ হাজার।
এসব অভিযোগের মধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে ১২ হাজার ৫৩৫টি। অর্থাৎ মোট অভিযোগের ৪৭.৩১ শতাংশের সমাধান দিয়েছে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। তবে ই-কমার্স ব্যবসা ব্যবস্থাপনা ও নিয়ন্ত্রণে ভোক্তা অধিকার আইনগত প্রতিষ্ঠান কি-না, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়ে যায়। ই-কর্মাসের এই অনিয়ম-প্রতারণার মূল কারণ হিসেবে পরিচালন ও নিয়ন্ত্রণে আইন এবং মনিটরিংয়ের অভাবের পাশাপাশি গ্রাহকদের অতি লোভকেই দুষছেন বিশ্লেষকরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ও ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস বিভাগের চেয়ারম্যান ড. সুবোধ দেবনাথ সাম্প্রতিক এক সাক্ষাৎকারে জানান, যেকোনো ব্যবসায়ে মূলত চার ধরনের গ্রাহক পাওয়া যায়। অর্থনীতির ভাষায় এর মধ্যে একটি হলো মৌমাছি গ্রাহক। আমাদের দেশে ই-কমার্স গ্রাহকদের বেশির ভাগই মৌমাছি গ্রাহক বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ। অর্থাৎ যতক্ষণ পর্যন্ত কোম্পানির লোভনীয় ডিসকাউন্ট রয়েছে ততক্ষণ পর্যন্ত গ্রাহকরা সেখানে স্থায়ী হয়। এরপর অন্য আরেক প্রতিষ্ঠানের সন্ধান করে।
এসবের পাশাপাশি ই-কমার্স নিয়ে যথাযথ আইন ও নীতিমালা না থাকার বিষয়টিকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, ডিজিটাল মাধ্যমে ব্যবসা ও লেনদেন হওয়ায় এই বিষয়ে আমাদের ঘাটতি রয়েছে। ফলে সুশাসন নিশ্চিতে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর পাশাপাশি সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোও পদে পদে ব্যর্থ হয়েছে। তাই প্রথমত কঠিন শাস্তি, সুশাসন ও আইনের বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা জরুরি।
এ বিষয়ে ই-কমার্স সংগঠন ই-ক্যাবের মহাব্যবস্থাপক জাহাঙ্গির আলম শোভন দৈনিক আমার সংবাদকে বলেন, ‘আমাদের দেশে ২০০০ সাল থেকে ই-কমার্স ব্যবসা শুরু হলেও এখনো এটি সরকারি স্বীকৃতি পায়নি। এখন পর্যন্ত ট্রেড লাইসেন্সে ই-কমার্স নামে কোনো ক্যাটাগরি তৈরি হয়নি। তবে খুশির খবর সম্প্রতি সরকার এ বিষয়ে চিন্তাভাবনা করছে। ফলে ২০১৮ সালে ই-কমার্স গাইড লাইন তৈরি হয়েছে। এই গাইড লাইন সঠিকভাবে অনুসরণ করলে হয়তো ৭০ শতাংশ অনিয়ম কমে যাবে। পাশাপাশি ডিজিটাল বিজনেস আইডেন্টিফিকেশন নাম্বার (ডিবিআইডি) চালুর ফলে প্রতিষ্ঠানগুলো নিবন্ধনের একটা বাধ্যবাধকতা এসেছে। এখন কেউ প্রতারণা করলে সহজেই চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেয়া যাবে।’
অবশ্য গাইড লাইন তৈরির পর থেকেই অনিয়ম অনেকখানি কমে এসেছে বলে মনে করছেন এই কর্মকর্তা। তিনি বলেন, ‘এখন আর কেউ আগের মতো টাকা নিতে পারছে না। ৭০-৮০ শতাংশ ছাড় দেয়া, তিন থেকে ছয় মাস আগে টাকা নেয়া, এগুলো বন্ধ হয়েছে। ফেসবুকে ব্যবসা সংক্রান্ত অনিয়ম নিয়ে প্রায় পাঁচ হাজার অভিযোগ এসেছে, যার মধ্যে ৮৬ শতাংশের সমাধান করা হয়েছে। বাকিগুলোর নাম-ঠিকানার তথ্য সঠিক না হওয়ায় সমাধান করা যায়নি। ফেসবুকে ব্যবসা সংক্রান্ত অনিয়ম অনেক কম। বাহ্যিকভাবে যারা ব্যবসা করে তারা ট্রেড লাইসেন্স না নিলে সরকার তাদের ব্যবসা বন্ধ করে দিতে পারে, কিন্তু অনলাইনে এটা বন্ধ করা সম্ভব নয়। এ জন্য ডিবিআইডি (ডিজিটাল বিজনেস আইডেন্টিফিকেশন) নাম্বার চালু করা হয়েছে।’ তবে ডিবিআইডি হলেই যে অনিয়ম পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাবে, তা মনে করেন না তিনি।
জানান, ‘কেউ যদি এই আইডি গ্রহণ না করলেও তার ব্যবসা বন্ধ করা সম্ভব নয়। বাংলাদেশ থেকে কেউ ব্যবসা করতে চাইলে ডিবিআইডি লাগবে। কিন্তু কেউ যদি বাংলাদেশের বাইরে বসে করে, সেটা বন্ধ করা সম্ভব হবে না। তা ছাড়া বেশি কঠোর হলে দেশের অনেক ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাবে, সে ক্ষেত্রে বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো সেই জায়গা নেবে।’
এদিকে কয়েক হাজার কোটি টাকার অনিয়ম হলেও অর্থের মোট পরিমাণ এবং প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়ের বিপরীতে সম্পদের পরিমাণ নিয়ে সংশ্লিষ্ট কোনো সংস্থাই তথ্য দিচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে ই-ক্যাবের ভূমিকার বিষয়ে জানতে চাইলে জাহাঙ্গির আলম বলেন, ‘বাণিজ্য সংগঠন আইন-১৯৯৪ অনুসারে কোনো ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের আর্থিক তথ্য জানার সুযোগ নেই আমাদের। অনেকের আমাদের কাছে অভিযোগ আছে, কিন্তু মামলা নেই। যাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে তাদের মধ্যে আমাদের সংগঠনের আটটি প্রতিষ্ঠানের সদস্যপদ স্থগিত করা হয়েছে। এর বাইরে কোনো কিছু করার এখতিয়ার আমাদের নেই।’
অপরদিকে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক পর্যায়ের এক নারী কর্মকর্তা জানান, এই খাতে মোট কত টাকার অনিয়ম হয়েছে এবং গ্রাহকদের কাছে প্রতিষ্ঠানগুলো কত টাকার দায় রয়েছে তা জানা তাদের পক্ষে সম্ভব না। তারা শুধু গ্রাহকদের অভিযোগের প্রেক্ষিতে সমাধানে ব্যবস্থা নিতে পারে। তবে মোট কত টাকার আর্থিক অনিয়ম হয়েছে তা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জানা থাকতে পারে বলে মনে করেন এই কর্মকর্তা।
তবে এই ধারণার সাথে একমত নয় বাংলাদেশ ব্যাংক। নাম প্রকাশ না করে উপমহাব্যবস্থাপক পদে কর্মরত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক নারী কর্মকর্তা বলেন, ‘কোনো প্রতিষ্ঠানের দায় ও সম্পদের তথ্য আমরা জানতে পারি না। আমাদের পরিধি কেবল ব্যাংক এবং গেটওয়ে পর্যন্ত। সে ক্ষেত্রে কার্ডের (ভিসা কার্ড, মাস্টার কার্ড) মাধ্যমে কোনো লেনদেন হলে সে টাকা প্রাপ্তিতে আমরা সহায়তা করতে পারি। আমরা গেটওয়ে সার্ভিস প্রোভাইডারকে বলতে পারি পণ্য না পাওয়া পর্যন্ত কোনো টাকা দেবে না। কিন্তু এমএফএসের (মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস) ক্ষেত্রে চার্জ ব্যাক পলিসি না থাকায় এটা সম্ভব না। আর বেশির ভাগ লেনদেনই হয়েছে বিকাশ ও নগদের মাধ্যমে।’ এ ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকদের টাকা ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা প্রায় নেই বলেই মনে করেন এই কর্মকর্তা। তবে এমএফএসের ক্ষেত্রেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক চার্জ ব্যাক ব্যবস্থা চালুর প্রক্রিয়া হাতে নিয়েছে বলে জানান তিনি।
ই-কমার্স প্রতারণায় জড়িত প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিচালক ও কর্মকর্তাদের নাম-ঠিকানাসহ অনেক কিছুই জানে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও ভোক্তা অধিদপ্তর, এমনটাই মনে করছে ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকরা। তারা বলেন, অনেক অভিযোগের সমাধানও দিয়েছে ভোক্তা অধিদপ্তর। সে ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে যোগাযোগ না থাকলে এটা সম্ভব হতো না। কিন্তু গ্রাহকের টাকা ফেরত দিতে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। তা ছাড়া দেশের ভেতরে অবস্থান করা অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানের পরিচালক ও কর্মকর্তারা যেন পরবর্তীতে বিদেশে পালিয়ে যেতে না পারেন, সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারেনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।