মহিউদ্দিন রাব্বানি
মার্চ ৯, ২০২২, ০৭:৫০ পিএম
এক সময় বার্তা আদান-প্রদানের অন্যতম প্রধান মাধ্যম ছিল চিঠিপত্র। চিঠির সঙ্গে বাঙালির আত্মার সম্পর্ক রয়েছে। মহাদেব সাহার আরজি : করুণা করে হলেও চিঠি দিও, ভুলে গিয়ে ভুল করে একখানি চিঠি দিও খামে। ‘চিঠি লিখেছে বউ আমার ভাঙা ভাঙা হাতে’— মুনির খানের বিখ্যাত এ গানের চিঠি প্রযুক্তির জোয়ারে ভেসে গেছে। তদস্থলে যুক্ত হয়েছে সেলফোন, ম্যাসেজ, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম।
তবে এখন মানুষ জীবনঘনিষ্ঠ প্রয়োজনীয় অনেক কাজ সারেন ডাক বিভাগের মাধ্যমে। বিশেষ করে সরকারি চিঠিপত্র, দাপ্তরিক ডকুমেন্ট, নিয়োগপত্র, বরখাস্ত আদেশ, পদোন্নতির আদেশসহ যাবতীয় পত্রাদি ডাকযোগে প্রেরণ করে। ডাক বিভাগ নতুন নতুন সব সেবা নিয়ে সাধারণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিচ্ছে নানান সেবা। যোগাযোগব্যবস্থাকে এক ধাপ এগিয়ে নেয়ার লক্ষ্যে স্বাধীনতা-উত্তর ১৯৭১ সালের ২০ ডিসেম্বর থেকেই তৎকালীন ঢাকা জিপিও ভবনের কয়েকটি কক্ষ নিয়ে ডাক অধিদপ্তরের যাত্রা শুরু।
তীব্র স্থান সংকটের মধ্যে স্বাধীনতার পর থেকেই ঢাকার গুলিস্তানে অবস্থিত ‘ঢাকা জিপিও ভবন’-এর তৃতীয় তলায় ডাক অধিদপ্তরের প্রশাসনিক সদর দপ্তরের কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে আসছে। এ ভবনটি প্রায় ৬০ বছরের পুরোনো হয়ে যাওয়ায় ভবনটির ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণ সম্ভব নয়।
এদিকে স্থান সংকুলান না হওয়ায় দাপ্তরিক কাজের পরিবেশ ও কাজের ধারাবাহিকতা বিঘ্নিত হচ্ছিল। এ অবস্থায় ডাক অধিদপ্তরের সদর দপ্তর হিসেবে একটি ভবন স্থাপন করা জরুরি ছিল। এ সংকট নিরসনে ঢাকার শেরেবাংলা নগরে ডাক অধিদপ্তরের সদর দপ্তর হিসেবে একটি স্বতন্ত্র ভবন ‘ডাক ভবন’ স্থাপন করা হয়।
ডাক অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয় স্থানান্তরের প্রাক্কালে গুলিস্তানের জিপিওর এই জায়গায় সবুজ উদ্যান গড়ে তোলার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গত বছর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) এক সভায় দেশের জরাজীর্ণ ডাকঘরগুলোর সংস্কার প্রকল্প অনুমোদনের সময় তিনি এ নির্দেশনা দেন। সভা শেষে সংবাদ সম্মেলনে পরিকল্পনামন্ত্রীও এ বিষয়ে সাংবাদিকদের অবহিত করেন। শেরেবাংলা নগরের এনইসি সম্মেলন কক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে একনেকের এ সভা অনুষ্ঠিত হয়।
এদিকে বর্তমান জিপিও ভবন ভেঙে এই ১৪ একর জায়গায় সবুজ উদ্যান করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এসব প্রকল্পের জন্য বরাদ্দও অনুমোদন দেয়া হয়েছে একনেক সভায়। অথচ এখনও জিপিও ভবনে ডাক বিভাগের কাজ চলছে। জিপিওর জায়গা খালি করা হবে, নাকি আগের মতোই তাদের দাপ্তরিক কাজ চলবে— এ বিষয়টি সবাইকে বিভ্রান্ত করছে। এ ভবনে কী হবে— এ নিয়ে অনুন্ধানে গেছেন এই প্রতিবেদক।
জিপিওর সিনিয়র পোস্ট অফিসার খন্দকার শাহনুর সাব্বির জানান, ডাক অধিদপ্তর আগে জিপিও ভবনেই ছিল। গত বছরের মাঝামাঝিতে অধিদপ্তর ডাক ভবনে স্থানান্তর করা হয়। তিনি বলেন, অধিদপ্তর শুধু মন্ত্রণালয়ের দাপ্তরিক কাজ করে আর আমরা ‘ডাক’ সেবা দিয়ে থাকি। এছাড়াও দেশে চারটি জিপিও রয়েছে। ঢাকা জিপিও তার একটি। এছাড়া তিনি জিপিওর স্থলে উদ্যানের বিষয়টি অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, উদ্যানের ব্যাপারে কোনো ফোরামেই কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
এদিকে ডাক অধিদপ্তরের কয়েকজন পরিচালকের সাথে কথা বলে জানা যায়, একসময় তারা সবাই জিপিওতে অফিস করতেন। পুরাতন জিপিও ভবনে উদ্যান হবে, নাকি জিপিওর দাপ্তরিক কাজ চলবে— জানতে চাইলে প্রত্যেকেই এ বিষয়ে কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন। অবস্থা এমন যেন তারা কিছুই জানেন না। আসলে জিপিওতে কী হতে যাচ্ছে, জিপিও কী সরানো হবে? আর সরানো হলেও কোথায় স্থানান্তর হবে, জিপিওর ঠিকানা কোথায়? এছাড়া নতুন ভবনে যেতে কেন এত সময় নেয়া হচ্ছে। এরকম নানা প্রশ্ন অনুসন্ধানী মনে।
এর আগে জিপিওর বড় একটি অংশ আগারগাঁওয়ের নতুন ভবনে যেতে চায় না বলেও অভিযোগ উঠেছিল। তাহলে এ কারণেই কী জিপিও অফিস ছাড়া হচ্ছে না? আর এ কারণেই কী উদ্যান তৈরির কাজ পিছিয়ে পড়ছে?
এদিকে ডাক বিভাগ সূত্র বলছে, নতুন ভবনে পুরো জিপিও যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কারণ, অধিদপ্তর ও জিপিও আলাদা সেকশন। সেখানে একটি ১৪ তলা ভবনে প্রায় তিন হাজার কর্মীর স্থান সংকুলান হবে না। এছাড়া আনসারসহ বেশকিছু কর্মীর আবাসন সুবিধাও দেয়া যাবে না।
এদিকে মহাপরিচালকের দপ্তরেই রয়েছেন ৬০ জন বিসিএস ক্যাডারসহ প্রায় ৩০০ কর্মকর্তা-কর্মচারী। ডাক অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, ডিজির দপ্তর, মেট্রোপলিটন সার্কেল ও ঢাকা সার্কেলের সঙ্গে জাদুঘর এবং সেন্ট্রাল সার্ভার নতুন ডাক ভবনে স্থানান্তর করা হলে বাকিরা, অর্থাৎ আরও ১১টি অপারেশনাল ডিভিশন কোথায় যাবে।
অন্যদিকে ২০০২ সালে বিজ্ঞান এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের নাম পরিবর্তন হয়। ২০১৪ সালে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এবং ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়কে একীভূত করে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় সৃষ্টি করা হয়। মন্ত্রণালয়গুলো বিন্যাসের ফলে কাজ, দায়িত্ব ও দপ্তর নিয়ে ধোঁয়াশায় পড়েন অনেকেই।
জিপিও সূত্র জানায়, জিপিও ভবনে এখনও ডাক অধিদপ্তরের একটি ইউনিট কাজ করে। তারা ডাকটিকিট ও স্ট্যাম্প বিলি ও বিক্রি করে থাকে। অন্যদিকে ডাকটিকিট ও স্ট্যাম্প ছাপানো হয় জিপিও থেকে। এছাড়াও টেলিযোগাযোগের একটি ইউনিটও রয়েছে জিপিও ভবনে। ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের ১০টি বিভাগ আছে।
এগুলো হলো : বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন, ডাক অধিদপ্তর, বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানি লিমিটেড, বাংলাদেশ সাবমেরিন কেবল কোম্পানি লিমিটেড, টেলিটক বাংলাদেশ লিমিটেড, টেলিফোন শিল্প সংস্থা লিমিটেড, বাংলাদেশ কেবল শিল্প লিমিটেড, টেলিযোগাযোগ অধিদপ্তর, মেইলিং অপারেটর ও কুরিয়ার সার্ভিস লাইসেন্সিং কর্তৃপক্ষ, বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেড। এর মধ্যে ‘ডাক’ নিয়ে কাজ করে মাত্র একটি বিভাগ।
১৮৯৮ সালের পোস্ট অফিস অ্যাক্টের মাধ্যমে স্বাধীনতা-উত্তর ডাক অধিদপ্তরের কার্যক্রম শুরু হয়। ঢাকার গুলিস্তানে ১৯৬২-৬৩ সালে ডাক বিভাগের কার্যক্রম পরিচালনার লক্ষ্যে নির্মাণ করা হয় তিনতলা জিপিও ভবন, যার পাশেই ছিল ডাক অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয়। আন্তর্জাতিক পোস্ট অফিস অ্যাক্ট অনুযায়ী যে কোনো এলাকার ঠিকানা নির্ধারণ করা হয় পোস্ট কোড দিয়ে।
ডাক অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, দেশে চারটি জিপিও, ৬৮টি প্রধান ডাকঘর, ৪২০টি উপজেলা ডাকঘর, ৯২৩টি সাব-পোস্ট অফিস, ১১টি বিভাগীয় শাখা অফিস রয়েছে। দেশে এজেন্সি পোস্ট অফিস রয়েছে আট হাজার ৪৬০টি, যার মধ্যে অবিভাগীয় সাব-পোস্ট অফিস ৩২২টি এবং অবিভাগীয় পোস্ট অফিস আট হাজার ১৩৮টি। সব মিলিয়ে ৯ হাজার ৮৮৬টি ডাকঘরের মাধ্যমে দেশব্যাপী পোস্টাল সেবা প্রদান করে আসছে ডাক অধিদপ্তর।
উল্লেখ্য, গত বছরের ২৭ মে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে ৯১ কোটি ৭৩ লাখ টাকা ব্যয়ে ১৪ তলা ভবনটি নির্মাণ করে ডাক অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয় স্থানান্তর করা হয়।