Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ২১ জুন, ২০২৫,

ছেঁড়া টাকা যায় কোথায়

এপ্রিল ৪, ২০২২, ০৭:০০ পিএম


ছেঁড়া টাকা যায় কোথায়

রাজধানীসহ সারা দেশের বাজারগুলোতে চোখে পড়ে টাকা কেনাবেচার দৃশ্য। ফুটপাতে পুরোনো ছেঁড়া-ফাটা ও ময়লাযুক্ত টাকা কেনাবেচা চলে। চকচকে নতুন টাকাও বিনিময় হয়। প্রশ্ন আসে এসব ছেঁড়া টাকা আসলে কোথায় যায়? যারা বিনিময় করেন তাদের লাভ কি? ব্যাংকে গেলেই যেহেতু টাকা পাল্টানো যায় তাহলে টাকা বিক্রেতাদের কাছে মানুষ কেন যায়? যেহেতু টাকা পাল্টানো যায় তাহলে মানুষ ছেড়া টাকা নিতে চায় না কেন? সর্বোপরি ব্যাংক এসব টাকা নেয়ার পর কি করে? জনমনে এসব প্রশ্ন থাকে এবং একটু ছেঁড়া থাকলেই কেউ টাকা নিতে চায় না। ছেঁড়া টাকা নিয়ে বিড়ম্বনায় পড়েনি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। কিন্তু এর সঠিক সমাধান আসলে কী? 

উপরোক্ত প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে বাংলাদেশ ব্যাংকে যোগাযোগ করা হলে কর্মকর্তারা জানান, ছেঁড়া টাকা নিয়ে আসলে সমস্যা থাকার কথা না। মূলত ছেঁড়া-ফাটা নোট বদলে নেয়ার বিষয়ে সঠিক ধারণা না থাকার কারণেই ভোগান্তি হয়। অনেক সময় ছেঁড়া বড় নোট বাজারে চলবে কি-না, এই দুশ্চিন্তায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন গ্রাহক। অথচ ঢাকাসহ দেশের যেকোনো স্থানে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর শাখাগুলোতে ছেঁড়াফাটা নোট গ্রহণ করা হয়। ব্যাংকের প্রতিটি শাখায় জনসাধারণের সহজে দৃষ্টিগোচর হয়, এমন স্থানে ‘ছেঁড়াফাটা ও ময়লা নোট গ্রহণ করা হয়’ এমন নোটিস টানানো থাকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে বিষয়টি কঠোরভাবে মনিটরিংও করা হয়। 

এমনকি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সাথে এ বিষয়ে বিশেষ সভা, বিশেষ পরিদর্শন চালায় বাংলাদেশ ব্যাংক। কোনো ব্যাংকের শাখা ছেঁড়াফাটা নোট বদলে না দিলে সেই ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীর (এমডি) বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার ঘোষণাও দেয়া আছে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে। সুবিধা না পেলে গ্রাহক বাংলাদেশ ব্যাংক বরাবর অভিযোগও করতে পারেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, ছেঁড়াফাটা নোট যদি বদলযোগ্য হয়, বাংলাদেশ ব্যাংকে এসেও বদলে নেয়া যায়। অবস্থাভেদে শতভাগ, ৭৫ ভাগ, ৫০ ভাগ রিফান্ড করা হয়। সাধারণত ৫১ শতাংশের কম ছেঁড়া থাকলে নোটের পুরো মূল্যমানই দেয়া হয়। তবে একটি নোটের অর্ধেকেরও কম অংশ থাকলে, তা আর রিফান্ড করা হয় না। এছাড়া দেশের সব বাণিজ্যিক ব্যাংকের যেকোনো শাখায় কয়েকটি বিষয় নিশ্চিত হয়ে অল্প ছেঁড়াফাটা ও ময়লা নোটের বিপরীতে সম্পূর্ণ বিনিময়মূল্য (শতভাগ) দেয়া হয়। গ্রাহকের উপস্থাপিত নোটটির সম্পূর্ণ নোটের তিন-চতুর্থাংশ বিদ্যমান থাকতে হবে এবং আসল নোট হিসেবে শনাক্ত হতে হবে। উপস্থাপিত নোট একাধিক খণ্ডিত হলে দুটি খণ্ডই একই নোটের অংশ হতে হবে। 

একই টাকা প্রমাণ বোঝাতে পেছনে সরু কাগজ দিয়ে জোড়া লাগানো যাবে। তিন-চতুর্থাংশ ছেঁড়া ও ময়লা নোটের ক্ষেত্রে জমা মূল্য সাথে সাথেই দেয়া হয়। অধিক ছেঁড়া, অত্যধিক জীর্ণ, আগুনে পোড়া, ঝলসানো এবং তিন-চতুর্থাংশের কম রয়েছে— এমন নোটের বিনিময়মূল্য বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রাপ্তি সাপেক্ষে দেয়া হয়। এই মূল্য সংগ্রহের জন্য এসব নোট বাংলাদেশ ব্যাংকে প্রেরণের ডাক বা কুরিয়ার মাশুল নোট জমাদানকারী থেকে আদায় করা হয়।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম আমার সংবাদকে বলেন, ‘ছেঁড়াফাটা নোট ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের সুনির্দিষ্ট কার্যক্রম রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক নোট রিফান্ড রেগুলেশন, ২০১২ অনুযায়ী ত্রুটিপূর্ণ (ছেঁড়াফাটা) নোট ব্যবস্থাপনা পরিচালনা করা হয়। ডিপার্টমেন্ট অব কারেন্সি ম্যানেজমেন্টের ২১ মে ২০১৯ সার্কুলার নং-০৩/২০১১ অনুযায়ী নোটসমূহকে বৈশিষ্ট্য অনুসারে অপ্রচলনযোগ্য, ত্রুটিপূর্ণ (ছেঁড়াফাটা), দাবিযোগ্য এবং পুনঃপ্রচলনযোগ্য এ চার ভাগে ভাগ করা হয়। ১. বাংলাদেশ ব্যাংক নোট রিফান্ড রেগুলেশন-২০১২ এর নির্দেশনা অনুসারে বাংলাদেশ ব্যাংকের শাখাসমূহের কাউন্টারের মাধ্যমে ত্রুটিপূর্ণ (ছেঁড়াফাটা) এবং অপ্রচলনযোগ্য নোটের বিনিময়মূল্য সরাসরি দেয়া হয়। 

এছাড়া দাবিযোগ্য নোট কাউন্টারে গ্রহণ করে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে বিনিময়মূল্য পরিশোধের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। ২. তফসিলি ব্যাংক কর্তৃক ত্রুটিপূর্ণ (ছেঁড়াফাটা) এবং অপ্রচলনযোগ্য নোট ডিপার্টমেন্ট অব কারেন্সি ম্যানেজমেন্টের ১৪ জানুয়ারি ২০১৩-এর পরিপত্র না-ইহিশা. ২৩ (পলিসি)/২০১৩-১৫-এর নির্দেশনা অনুযায়ী গ্রহণ এবং এর বিনিময়মূল্য দেয়া হয়। ৩. পরিপত্র অনুযায়ী তফসিলি ব্যাংক ত্রুটিপূর্ণ (ছেঁড়াফাটা) এবং অপ্রচলনযোগ্য নোটের বিনিময়মূল্য কাউন্টারে জমা গ্রহণকালেই পরিশোধ করে এবং দাবিযোগ্য নোট গ্রহণপূর্বক তার মূল্য সংগ্রহের জন্য পরিপত্রে বর্ণিত ব্যবস্থা অনুসরণ করে বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠায়।

তবে এ বিষয়ে সাধারণ মানুষের অভিযোগ, ব্যাংকগুলো নানা অজুহাতে ছেঁড়া নোট পাল্টে দেয় না। তাই রাস্তার পাশে যারা টাকা বিক্রি করে তাদের কাছ থেকে পরিবর্তন করে নেন তারা। টাকা বিক্রির এসব হকারদের কাছে বিনিময় হার শতভাগ টাকায় ৫০-৭০ টাকা। ঝামেলা কম হওয়ায় অল্প দামেই এসব হকারদের কাছে সবাই টাকা বিনিময় করেন। 

নুর মোহাম্মদ নামের একজন বেসরকারি চাকরিজীবী আমার সংবাদকে বলেন, প্রায়ই ছেঁড়া টাকা হাতে আসে এবং ঝামেলায় পড়তে হয়। সাধারণত ১০ টাকা, ১০০ টাকা পরিবর্তন করতে ব্যাংকে যাওয়ার সময় হয় না। আবার দেখা যায় ১০০ টাকা পরিবর্তন করতে ব্যাংকে যাতায়াতেই ১০০ টাকা খরচ হয়ে যায়। অন্যদিক অল্প ছেঁড়া থাকলে ব্যাংক নতুন টাকা দেয় কিন্তু একটু বেশি ছেঁড়া থাকলে আর দিতে চায় না। এসব ঝামেলার কারণে কেউ ব্যাংকে যেতে চায় না।
 
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের কারেন্সি ডিপার্টমেন্টের একজন কর্মকর্তা বলেন, যখন একটি নোট বেশি ছেঁড়া থাকে তখন ব্যাংকগুলো সাথে সাথে ফেরত দিতে পারে না। ওই টাকা বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠাতে হয়। আবার কিছু ক্ষেত্রে ৫০ বা ৭৫ শতাংশ রিফান্ড করা হয়। এসব ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার অনুমোদন নিতে হয়। তাই সাথে সাথে টাকা রিফান্ড করা যায় না। তাই গ্রাহকের কাছে নির্দিষ্ট সময় চাওয়া হয়। 

কিন্তু অধিকাংশ গ্রাহক ধৈর্য ধরতে চায় না, তাই তারা রাস্তায় হকারদের কাছে যায়। হকাররা কিভাবে দেয় এমন প্রশ্নের উত্তরে ওই কর্মকর্তা বলেন, হকাররা নিয়ম মেনেই বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে টাকা রিফান্ড নেয়। সে ক্ষেত্রে যদি গ্রাহকের ৭৫ ভাগ পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে হকাররা তাকে ৪০-৫০ ভাগ পরিশোধ করে। বাকিটা তারা নিয়ম মেনে সময় খরচ করে নেয় এবং ২৫-৩৫ শতাংশ লাভ করে।

টাকা সংগ্রহের পর এসব টাকা বাংলাদেশ ব্যাংক কি করে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের কারেন্সি ডিপার্টমেন্টের ওই কর্মকর্তা জানান, সারা পৃথিবীতে বাতিল নোট ধ্বংস করতে বেশ কয়েকটি প্রক্রিয়া অবলম্বন করা হয়। উন্নত বিশে উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন মেশিনের সাহায্যে চাপ দিয়ে টাকাগুলো দিয়ে রোল তৈরি করা হয়। 

পরবর্তীতে এসব রোল বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করা হয়। এ পদ্ধতি পরিবেশবান্ধব ও পুনরায় ব্যবহারযোগ্য হওয়ায় বেশ জনপ্রিয়। বাংলাদেশে উন্নত মেশিন ও সক্ষমতা না থাকায় রোল পদ্ধতিতে টাকা ধ্বংস করা যায় না। সাধারণত দুটি উপায়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ও এর শাখাসমূহ টাকা ধ্বংস করে। 

প্রথমত পুড়িয়ে ফেলা হয় এবং দ্বিতীয়ত উন্নতমানের শ্রেডিং মেশিনের মাধ্যমে ছোট ছোট টুকরায় পরিণত করে আবর্জনা হিসেবে পরিত্যক্ত স্থানে ফেলে দেয়া হয়। এক টাকার নোট থেকে ৫০ টাকার নোট পর্যন্ত পোড়ানোর নিয়ম। আর বড় নোটগুলো (১০০, ৫০০ ও এক হাজার টাকা) কুচি কুচি করে কেটে বর্জ্য হিসেবে ফেলে দেয়া হয়। বড় নোট পোড়ানো যায় না। বেশি ধোঁয়া হওয়ার কারণে পরিবেশ নষ্ট হয়।

ছেঁড়া টাকায় বিড়ম্বনা কমাতে একটি নোটের কতটুকু অংশ ছেঁড়া বা ফাটা থাকলে তার মূল্যমানের কোনো সমস্যা হবে না বা দোকানপাটে, যানবাহনে বিনা বাধায় নেয়া যাবে, সে সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা দিয়ে গ্রাহক পর্যায় প্রচারণা চালানো উচিত বলে মনে করেন খাত সংশ্লিষ্টরা। যেহেতু ছেঁড়া টাকা ব্যাংক ফেরত নেয়। তাহলে প্রাত্যহিক লেনদেনে দোকানপাটে বা যানবাহনে সামন্য ছেঁড়া টাকা না নেয়ার কোনো যৌক্তিকতা নেই। নোটের বেশি অংশ ছেঁড়া থাকলেই কেবল তার মূল্যমান কমে, সর্বসাধারণের কাছে এ বিষয়টি ব্যাপকভাবে প্রচার করতে পারলে ভোগান্তি কমবে বলে তারা মনে করেন। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে ছেঁড়া টাকা নিয়ে এমন ভোগান্তি নেই বলেও জানান তারা।