Amar Sangbad
ঢাকা বুধবার, ১৬ জুলাই, ২০২৫,

চতুর্থ শিল্পবিপ্লব এবং বাংলাদেশ

প্রিন্ট সংস্করণ॥মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন

জুন ২৮, ২০১৯, ০৭:২৯ পিএম


চতুর্থ শিল্পবিপ্লব এবং বাংলাদেশ

মানবসভ্যতা তিনটি বিপ্লবের সাক্ষী হয়েছে। একটি হলো- প্রথম শিল্প বিপ্লব যার উত্থান ঘটে ১৭৮৪ সালে বাস্পীয় ইঞ্জিন আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে। দ্বিতীয় শিল্প বিপ্লব যা ঘটে ১৮৭০ সালে বিদ্যুৎ এবং বৈদ্যুতিক যন্ত্র আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে।

এ দুটি শিল্প বিপ্লবের সুফল কমবেশি সবাই ভোগ করেছে। এর পরেই চলে আসে তৃতীয় শিল্প বিপ্লব বা তথ্য বিপ্লব যা ইলেকট্রনিকস এবং ১৯৬৯ সালে ইন্টারনেট আবিষ্কারের মাধ্যমে ব্যাপক বিস্তৃতি লাভ করে।

ইন্টারনেটের মাধ্যমে বিস্তৃতি লাভ করা এই তথ্য বিপ্লবে অবস্থানকালীন সময়ে আমাদের মাঝে আরেকটি শিল্প বিপ্লব হাতছানি দিয়ে ডাকছে। যাকে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব নামে অভিহিত করা হচ্ছে।

চতুর্থ শিল্প বিপ্লব হচ্ছে ইন্টারনেট ভিত্তিক বিপ্লব। যেখানে মানুষের স্বাভাবিক জীবন যাপনের সাথে একান্ত সঙ্গী হয়ে যাবে প্রযুক্তি। পোশাকে, গায়ে থাকবে প্রযুক্তি।

আই ও টি বা ইন্টারনেট অব থিংস এর মাধ্যমে প্রত্যেক বস্তুতে থাকবে ইন্টারনেট। একে ডিজিটাল শিল্প বিপ্লব নামেও অভিহিত করা হচ্ছে।

চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের আলোচিত প্রযুক্তিসমূহ হবে:- কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও মেশিন লার্নিং, উন্নত মানের রোবোটিক্স ও অটোমেশন, ইন্টারনেট অব থিংস, ব্লকচেইন প্রযুক্তি, থ্রি-ডি প্রিন্টিং, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং, উন্নত মানের জিন প্রযুক্তি, নতুন ধরনের শক্তি, সুইজারল্যান্ডের শহর দাভোস।

সেখানে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) বার্ষিক সম্মেলনে একটি আলোচনা সভার আলোচনার অন্যতম বিষয় হচ্ছে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব। ডিজিটাল শিল্প বিপ্লবকে নিয়ে সেখানে এখন চলছে আলোচনা- সমালোচনা ও বিশ্লেষণ।

ডব্লিউইএফের প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী প্রধান ক্লাউস শোয়াব চতুর্থ শিল্প বিপ্লব নিয়ে নিজের লেখা একটি প্রবন্ধে বলেছেন, ‘আমরা চাই বা না চাই, এত দিন পর্যন্ত আমাদের জীবনধারা, কাজকর্ম, চিন্তাচেতনা যেভাবে চলেছে সেটা বদলে যেতে শুরু করেছে।

ডিজিটাল বিপ্লব সম্পর্কে বহুজাতিক মোবাইল অপারেটর ডিজিসেলের চেয়ারম্যান ডেনিস ও ব্রায়েন বলেন, ‘চতুর্থ শিল্প বিপ্লব হিসেবে ডিজিটালাইজেশন আমাদের কাজের সব ক্ষেত্রে ইতোমধ্যে বিশাল পরিবর্তন নিয়ে এসেছে, তবে এই পরিবর্তনকে আমি দেখি সূচনা হিসেবে।

আগামী ১০ বছরে ডিজিটাল বিপ্লবের ফলে আমরা এমন সব পরিবর্তনের মুখোমুখি হতে যাচ্ছি, যা এর আগে ৫০ বছরে সম্ভব হয়নি।’ সময় যত যাচ্ছে যুগ পরিবর্তনের হাওয়া তত জোরে বইছে।

এক সময় মানুষ কোনোকিছু জানতে অন্য মানুষের দ্বারস্থ হত, চিঠি পাঠাত মনের ভাব প্রকাশ করতে। কিন্তু বিশ্বব্যাংকের ২০১৬ সালের ওয়ার্ল্ড ডেভেলপমেন্ট রিপোর্টে দেখানো হয়েছে কিভাবে মানুষের জীবনধারার পরিবর্তন হয়েছে।

রিপোর্টে উঠে এসেছে বর্তমান বিশ্বে ইউটিউব দেখা হয় দৈনিক ৮৮০ কোটি বার, ই-মেইল পাঠানো হয় ২০ হাজার ৭০০ কোটি, আর গুগল সার্চের সংখ্যা ৪২০ কোটি। এটি বদলে যাওয়া পৃথিবীর জীবন যাপনের চলমান চিত্র মাত্র।

এই পরিবর্তনের ফলে বিশ্বব্যাপী অর্থনীতি, সমাজ, বাণিজ্য, কর্মসংস্থান ইত্যাদির ওপর যে বিশাল প্রভাব পড়বে, তার একটা পর্যালোচনা করেছেন ক্লাউস শোয়াব তার ‘দ্য ফোর্থ ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভুল্যশন’ গ্রন্থে।

এই নতুন শিল্প বিপ্লবের পক্ষে বিপক্ষে পরস্পরবিরোধী মতও রয়েছে। সবচেয়ে বড় মতটি কর্মসংস্থান বিষয়ক। বিপ্লবটি হলে অনেক কিছু বদলাবে। প্রথাগত অনেক কর্মসংস্থান বিলুপ্ত হবে আবার অনেক কর্মসংস্থান তৈরিও হবে।

শোয়াবের মতে সম্ভাবনা দুই দিকেই সমান। কিন্তু, মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্ত যারা আছে অথবা যারা এই পরিবর্তন এর সাথে খাপ খাওয়াতে পারবে না তারা এগিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে অনেকখানি পিছিয়ে যাবে।

কারণ হিসেবে তিনি দেখিয়েছেন নিম্ন মধ্যবিত্ত দেশ অর্থাভাবে চাইলেও প্রযুক্তিপণ্য নির্মাণ এবং সরবরাহের দিকে মনোযোগ দিতে পারবে না। এতে করে এই বিপ্লবের সাথে তাল মেলানো তাদের জন্য অনেক কঠিন হবে।

যে সকল দেশ প্রযুক্তিপণ্য নির্মাণ সরবরাহের দিকে দৃষ্টি দিচ্ছে তারাই আগামীর বিপ্লবে সামনের সারিতে থেকে নেতৃত্ব দিবে। সময় পরিবর্তন হয়েছে। তৃতীয় শিল্প বিপ্লবের সম্পূর্ণ সুফল না পেলেও সময়ের স্রোতে ভাসতে ভাসতে আমরা চলে এসেছি চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের দ্বারপ্রান্তে।

কিন্তু নিম্ন মধ্যবিত্ত দেশ হিসেবে আমাদের প্রস্তুতি কতটুকু সেটাই দেখার বিষয়। আমরা একটু পাশের দেশ ভারতের দিকে তাকালে দেখব তারা একাডেমিক শিক্ষার পাশাপাশি বৃত্তিমূলক এবং প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষাব্যবস্থার ওপর জোর দিয়েছে।

আর আমেরিকা, কানাডা, ব্রিটেনসহ অন্যান্য দেশের দিকে তাকালে এই বিষয়টি আরো বেশি পরিষ্কার বোঝা যায়। তারা প্রথাগত শিক্ষার পাশাপাশি কী চমৎকারভাবে কারিগরি এবং প্রযুক্তিগত শিক্ষায় জোর দিচ্ছে।

১৯৭১ সালে জন্ম নিয়ে কিছুদিনের মধ্যে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে নিম্ন মধ্যবিত্ত দেশ হিসেবে স্বীকৃতি প্রাপ্তি বাংলাদেশের অনেক বড় অর্জন। অর্জন যত বড় হয় দায়িত্ব তত বেড়ে যায়।

আমাদের স্মরণে রাখতে হবে, স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উত্তরণের পাশাপাশি শুরু হয়েছে এই নতুন শিল্প বিপ্লব। প্রথমটিকে টেকসই করার জন্য এবং দ্বিতীয়টির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার জন্য প্রথাগত শিক্ষার বাইরেও জোর দিতে হবে বৃত্তিমূলক ও প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষাব্যবস্থার ওপর। এটি নিশ্চিত করা না গেলে এই নতুন শিল্প বিপ্লবের সুফল আমরা ঘরে তুলতে পারব না।

২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের জনসংখ্যা হবে ৮০০ কোটি। পরের ২০ বছরে বাড়বে আরও ১০০ কোটি। এর ফলে সামগ্রিক চাহিদা বাড়বে। কিন্তু উন্নত দেশসহ বিশ্বের বেশির ভাগ দেশে জন্মহার কমছে বলে বার্ধক্যে উপনীত হওয়া জনশক্তিকে প্রতিস্থাপন করার মতো পর্যাপ্ত সংখ্যক তরুণ কর্মী বাহিনী থাকবে না।

ফলে সামগ্রিক চাহিদা বাড়লেও বেশিসংখ্যক অবসরপ্রাপ্ত মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমবে, কমে যাবে বাড়ি- গাড়ির মতো মূল্যবান সামগ্রীর খাতে বড় অঙ্কের ব্যয়ের ক্ষমতা, ফলে সঞ্চয় ও বিনিয়োগ কমে যেতে পারে।

কিন্তু বাংলাদেশ এখন এমন একটা সময়ে অবস্থা করছে যা যে কোনো দেশের জন্য একটা কাঙ্ক্ষিত সময়। গত ১০০ বছরে এরকম সময় আসেনি। দেশের অধিকাংশ জনসংখ্যা তরুণ- যাদের অধিকাংশই নিজে থেকে কিছু করতে চায়।

অবশ্যই এটি একটি প্রোডাক্টিভ দিক। এর সাথে যদি চতুর্থ শিপ্ল বিপ্লব এর ধারণাকে মিশিয়ে দেওয়া যায় এবং বৃত্তিমূলক ও প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষাব্যবস্থার ওপর জোর দেওয়া যায় তাহলে প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য চতুর্থ বিপ্লব বোঝা সহজ হবে এবং এর সাথে তাল মিলিয়ে সামনে এগোনোর প্রস্তুতি নেওয়া যাবে।

আর এই দুই বিপ্লবের জোয়ার দেশের অভ্যন্তরে চালু হলে স্বল্পোন্নত বাংলাদেশ একদিন সমৃদ্ধ বাংলাদেশ হয়ে বিশ্বের সামনে মাথা উঁচু করে নেতৃত্ব দিবে। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা রুপান্তরিত হবে বঙ্গবন্ধু কন্যার ডিজিটাল বাংলাদেশে।

লেখক : শিক্ষার্থী (১ম বর্ষ) দর্শন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়