Amar Sangbad
ঢাকা বৃহস্পতিবার, ১৫ মে, ২০২৫,

কিশোর অপরাধের কারণ ও প্রতিকার

প্রিন্ট সংস্করণ॥মোমিন মেহেদী

আগস্ট ৩০, ২০১৯, ০৭:৪০ পিএম


কিশোর অপরাধের কারণ ও প্রতিকার

দেশ সর্বোচ্চ পদস্খলনের রাস্তা অগ্রসর হচ্ছে প্রতিদিন। নতুন নতুন নির্মমতা আর অপরাধের রাজত্ব তৈরির চেষ্টায় অবারিত যেন তৈরি হচ্ছে ছাত্র-ছাত্রীদের একটা বড় অংশ। বিদ্যালয়ে যাচ্ছে ঠিক কিন্তু তারা জ্ঞানের পরিবর্তে তৈরি করছে অন্যায়ের পাঠ।

যে কারণে কথায় কথায় বাড়ছে খুন-ধর্ষণ মাদকাসক্তি-সন্ত্রাসসহ অহরহ অপরাধ প্রবণতা। দীর্ঘদিনের সাংবাদিকতা, লেখালেখি, শিক্ষা-সাহিত্য সাংস্কৃতিক-সমাজিক ও রাজনৈতিক কর্মযজ্ঞে গড়ে ওঠা আমার ব্যক্তিগত ধারণা হলো- বিচারহীনতার হাত ধরে অপরাধ বাড়ে।

যেমনটি তনু, নুসরাত, মিতু, রিফাত, সর্বশেষ কমলাপুর রেল স্টেশনের পরিত্যক্ত বগীতে আসমা হত্যার মধ্য দিয়ে প্রমাণিত। তবু বাংলাদেশকে ভালোবাসি বলে ঘুরে দাঁড়াবার স্বপ্ন নিয়ে লিখছি-শিখছি বলছি এবং চলছি সাহসের রাস্তা ধরে।

যার কিছু নেই, তার হারাবার ভয় নেই। আমারও নেই। যে কারণে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ আর মানুষ মানচিত্রের প্রতি ভালোবাসা থেকে গঠনমূলক সমালোচনা অবহত রেখে এগিয়ে চলছি ছাত্র জীবন থেকেই।

সেই ধারা অব্যাহত আছে বলেই যখন দেখেছি পত্রিকার- ‘ভোলার দৌলতখানে ৮ পিস ইয়াবা ও ১০ হাজার টাকাসহ উম্মে হাবিবা ও আইরিন নামের দুই স্কুল শিক্ষার্থীকে আটক করেছে পুলিশ।

দৌলতখান বাজারের উত্তরমাথা থেকে এদের আটক করা হয়। আটক উম্মে হাবিবা উপজেলার দলিল উদ্দিন খায়ের হাট এলাকার খাদিজা খানম মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্রী ও চর খলিফা ৭ নম্বর ওয়ার্ডের মো. আলাউদ্দিনের মেয়ে।

আইরিন দৌলতখান সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্রী ও একই এলাকার আব্দুল হাইয়ের মেয়ে। পুলিশ জানায়, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে পুলিশের একটি টিম দৌলতখান বাজারে অভিযান চালায়।

এ সময় বাজারের উত্তরমাথা থেকে ৮ পিস ইয়াবা ও নগদ ১০ হাজার টাকাসহ তাদেরকে আটক করা হয়। দৌলতখান থানার ওসি মো. এনায়েত হোসেন আটকের ঘটনা নিশ্চিত করে বলেন, এরা দুজন দীর্ঘদিন ধরে স্কুল শিক্ষার আড়ালে মাদক ব্যবসা ও অসামাজিক কাজে লিপ্ত রয়েছে।

এদের বিরুদ্ধে মাদক আইনে মামলা দায়ের করা হয়েছে।’ তখন দায়বদ্ধতা থেকে কলম তুলে নিয়েছি হাতে। লিখতে গিয়ে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে মাত্রারিক্ত কিশোর অপরাধের চিত্র। মনে হয়েছে- একটু গভীরে যাওয়া প্রয়োজন।

চেষ্টার সূত্রতায় জানতে পারি- দেশে চলমান অপরাধের রাজত্ব তৈরির কসরতে কিশোর অপরাধীর সংখ্যা শতকরা ৩৪ জন। এই সংখ্যাটি ২০০০ সালেও ছিলো শতকরা ৭। আর এখন তা চলে এসেছে ৩৪।

কারণ অনেক, প্রথমত রাষ্ট্রযন্ত্র্র বিচারহীনতার সংস্কৃতি তৈরি করেছে, দ্বিতীয়ত কিশোর অপরাধের সংখ্যা কমাতে নেই কোনো মনিটরিং সেল, তৃতীয়ত নেই কার্যত কিশোর অপরাধ সংশোধনাগার, নেই সন্তানদের প্রতি অভিভাবকদের ‘ প্রকৃত মানুষ’ করার প্রবণতা; যা আছে তা হলো তথাকথিত ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার বা ব্যরিস্টার বানানোর নোংরা চাপ; চতুর্থত সন্তানের মেধা বিকাশের কথা না ভেবে পাঠ্যবই কেন্দ্রিক পড়ালেখায় বেশি চেষ্টা করা, তার ওপর পরিবার-সমাজ ও রাষ্ট্রযন্ত্রের পদস্খলনের মুখোমুখি করা হয় কিশোরদের; যেমন বাবা সিগেরেট খায়, সন্তানকে দিয়ে আনায়।

কিশোর অপরাধ দমন করতে যে রাস্তায় অগ্রসর হতে হয়; সে রাস্তায় নেই আমাদের পুলিশ প্রশাসন। যে কারণে নিরাপত্তার চাদরে ঢাকা কমলাপুর রেলস্টেশনে পরিত্যক্ত বগির টয়লেট থেকে উদ্ধার মাদ্রাসাছাত্রী আসমা আক্তারকে (১৭) হত্যার আগে ধর্ষণ করা হয়েছিল বলে গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল মর্গে তার ময়নাতদন্ত হয়। ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক জানিয়েছেন, ধর্ষণের পর শ্বাসরোধে হত্যার আলামত মিলেছে। নির্যাতনের চিহ্নও পাওয়া গেছে। এদিকে পুলিশ ও নিহতের পরিবারের সন্দেহের তীর আসমার প্রেমিক বাঁধনের দিকে।

আসমার লাশের ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক ঢামেকের ফরেনসিক বিভাগের প্রভাষক ডা. প্রদীপ বিশ্বাস গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, মেয়েটির শরীরে নির্যাতনের চিহ্নও রয়েছে। ধর্ষণের পর শ্বাসরোধে হত্যার আলামতও মিলেছে। তবে গণধর্ষণের বিষয়টি নিশ্চিত হতে কয়েকটি পরীক্ষার জন্য আলামত সংগ্রহ করে পরীক্ষাগারে পাঠানো হয়েছে। নিহতের গলায় কালো দাগ, বুকে ক্ষত ও নাকে জখমের চিহ্ন পাওয়া গেছে।

কমলাপুর রেলস্টেশনের বলাকা কমিউটার ট্রেনের পরিত্যক্ত বগির টয়লেট থেকে আসমার গলায় ওড়না প্যাঁচানো লাশটি উদ্ধার করে কমলাপুর রেলওয়ে পুলিশ। ব্যাগে থাকা মোবাইল নম্বর থেকে তার পরিচয় শনাক্ত করা হয়। আসমা পঞ্চগড় জেলা সদরের কনপাড়া গ্রামের ভ্যানচালক আবদুর রাজ্জাকের দ্বিতীয় মেয়ে। সে স্থানীয় খান বাহাদুর মখলেছুর রহমান মাদ্রাসা থেকে এবার দাখিল পাস করেছে।

পরিবারের আর্থিক অনটনে তাকে আর কলেজে ভর্তি করা হয়নি। পাশের গ্রামের ভুট্টোর ছেলে বাঁধনের সঙ্গে আসমার প্রেমের সম্পর্ক ছিলো। তারা দু’জনই একই মাদ্রাসায় একই ক্লাসে পড়াশোনা করত। আমাদের ধারণা, বাঁধনই তাকে ফুসলিয়ে ঢাকায় নিয়ে হত্যা করেছে। আসমার বান্ধবীরা গণমাধ্যমকে জানিয়েছে, ৮ম শ্রেণিতে পড়ার সময় একই ক্লাশের বাঁধনের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে আসমার।

সকালে মা-বাবা কাজের জন্য বাইরে যাওয়ার সুযোগে আসমা বাসা থেকে নিখোঁজ হয়। তার প্রেমিক বাঁধনও একই সময় নিখোঁজ হয়। আর রেলওয়ে পুলিশের ঢাকা সার্কেলের এএসপি ওমর ফারুক রেলওয়ের সীমানায় নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হলেও ঠিকই গণমাধ্যমকে দেখে খই ফুটিয়ে বলেছেন, কমলাপুরে আসমাকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে, না কোনো চক্রের খপ্পরে পড়ে আসমা খুন হয়েছে তা বাঁধনকে গ্রেপ্তার করা গেলেই উন্মোচন হবে।

তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে এ হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের খুঁজে বের করার চেষ্টা চলছে।’ পঞ্চগড়-১ আসনের এমপি মজাহারুল হক প্রধান, ডিসি সাবিনা ইয়াসমিন ও পুলিশ সুপার মোহাম্মদ ইউসুফ আলী আসমার বাড়ি গিয়ে সমবেদনা জানিয়েছেন।

তার ওপর আবার পুলিশ সুপার মোহাম্মদ ইউসুফ গণমাধ্যমকে বলেছেন, নিয়মানুযায়ী জিআরপি থানায় মামলা হয়েছে। তারাই তদন্ত করবে। যেহেতু নিহতের বাড়ি পঞ্চগড়, এ জন্য তদন্তের সময় আমাদের সহায়তার প্রয়োজন হতে পারে। আমরা ছায়া তদন্ত শুরু করেছি। কিছু আলামতও পাওয়া গেছে।

তদন্তের স্বার্থে তা প্রকাশ করা যাচ্ছে না।’ নতুন প্রজন্মের রাজনীতিক হিসেবে বাংলাদেশের রাজনীতি-শিক্ষা সাহিত্য-সাংস্কৃতিক অঙ্গণে নিবেদিত থাকার সুবাদে দেখার চেষ্টা করেছি ছাত্রছাত্রীদের বর্তমান অবস্থা। কিশোর অপরাধ নিয়ে একমাত্র ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ করছে একটি জাতীয় দৈনিক। তাদের বিভিন্ন জেলা ভিত্তিক প্রতিবেদনের সূত্রতায় ভোলা জেলার প্রতিবেদনটি চোখে পড়ে আমার।

যেখানে উল্লেখ করা হয়েছে- ‘ঢাকায় যাওয়ার জন্য ভোলার দৌলতখান উপজেলা লঞ্চঘাটে তাকে এগিয়ে দিতে আসেন তার মেয়ে ও স্ত্রী। রাতে লঞ্চ ছাড়ার আগ মুহূর্তে তিনি খবর পান, ওই ঘাট থেকে তার মেয়েকে (নবম শ্রেণির ছাত্রী) তুলে নিয়ে যাবে ‘০০ নাইন’ গ্রুপ (কিশোর গ্যাং-আকাশ)। উপায়ান্তর না দেখে মোহন মিয়া তৎক্ষণাৎ সাহায্য চান এক যুবলীগ ও ছাত্রলীগ নেতার। ওই যাত্রায় রক্ষা পায় মেয়েটি।

এছাড়া রাস্তায় দল বেঁধে কিশোরদের সিগারেট টানা ও ধোঁয়া ছাড়ার বদ অভ্যাস ত্যাগ করার উপদেশ দেয়ায় দৌলতখান বাজারের প্রথিতযশা ডাক্তার বাদল প্রিয় সরকার ও তার পিতা প্রবীণ ডাক্তার বিরেন ঘোষালকে দোকানের মধ্যেই পিটিয়ে রক্তাক্ত করা ছাড়াও তাদের ওষুধের দোকানটি ভাঙচুর করা হয়।

ওদিকে গত বিজয় দিবসের অনুষ্ঠান চলছিল দৌলতখান উপজেলা মিলনায়তনে। ছিলেন ইউএনওসহ উপজেলার গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের প্রায় সবাই। ঠিক ওই সময় স্কুলছাত্রীদের উত্ত্যক্ত করছিলো কিশোর গ্যাং লিডার। অবস্থা বেগতিক দেখে মঞ্চ ছেড়ে এগিয়ে যান স্বয়ং উপজেলা নির্বাহী অফিসার।

গ্যাং লিডারের গালে কষে এক চড় বসিয়ে দেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠছিলো কিশোররা। পরিস্থিতি বুঝতে পেরে শেষ পর্যন্ত তারা রণে ভঙ্গ দিয়ে কেটে পড়েন।’ শুধু কি এখানেই শেষ! না।

প্রতিবেদন অনুযায়ী- ‘প্রতিদিনই তিন বেলা করে সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রবেশ পথে সাইরেন বাজিয়ে মোটরসাইকেলের মহড়া দেয়া, প্রকাশ্যে মাদক সেবন ও বিক্রি করা, স্কুলছাত্রীদের উত্ত্যক্ত করা, সর্বশেষ গত ২৪ জুলাই দৌলতখান আবু আবদুলাহ কলেজে ঢুকে ভাঙচুর করা ও স্নাতক শ্রেণির ছাত্রদের মারধরের ঘটনায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে গোটা এলাকায়। এমন অসংখ্য ঘটনা ঘটিয়েছে নবী নেওয়াজ আকাশ ও তার ‘০০ নাইন গ্রুপ’।

দৌলতখান সরকারি বালক উচ্চবিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্র আকাশ। নবম শ্রেণির সঙ্গে মিল রেখে আকাশ তার গ্রুপের নাম রেখেছেন ‘০০ নাইন’। আকাশের পিতা ভোলার দৌলতখান পৌরসভার মেয়র জাকির হোসেন তালুকদার।

পৌর পিতার এই ছেলের অপকর্ম নিয়ে অনেকেই প্রকাশ্যে মুখ খুলতে সাহস পান না। নাম প্রকাশ না করার শর্তে অনেকেই আকাশের বাহিনী নিয়ে কথা বলেছেন। বলা হয়েছে- ‘০০ নাইন’ ফার্স্ট ইন কমান্ড হচ্ছে তানজিব রনজু।

কাগজপত্রে কলেজছাত্র হলেও আকাশের দলেই তার অবস্থান। তার বিরুদ্ধেও মেয়ে অপহরণের অভিযোগ রয়েছে। তাদের আরেক দোসর হচ্ছেন আদালী বংশের সাকিল। তাদের প্রশ্রয় দাতা হিসেবে রয়েছেন এক যুবলীগ নেতা।

এই অবস্থায় আমাদের কি সচেতন হওয়ার প্রয়োজন নেই! প্রয়োজন নেই ঘুরে দাঁড়াবার! যদি প্রয়োজন মনে হয়, তাহলে ঘুরে দাঁড়ান দেশের জন্য-আপনার সন্তানের অগত সময়ের জন্য। যেখানে নির্মমতার রাজনীতি থাকার পরিবর্তে থাকতে পারে আলোকিত সময়ের সুবাতাস।

যে সুবাতাস সকল অন্যায়কে ধুয়ে মুছে সাফ করে আনতে পারে প্রত্যয়ের পথ, শান্তি-সমৃদ্ধির বাংলাদেশ। যে বাংলাদেশে শুধু কিশোর অপরাধ নয়; থাকবে না কোনো প্রকার অপরাধের লেশ, চাই তেমন বাংলাদেশ-বিজয় বাংলাদেশ...।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট