Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪,

ইউপি সচিবদের বেতন-বৈষম্য

অধ্যাপক মু. নজরুল ইসলাম তামিজী

নভেম্বর ২৩, ২০১৯, ১০:৩০ পিএম


ইউপি সচিবদের বেতন-বৈষম্য

ত্রিশ লাখ মানুষের আত্মত্যাগ আর দুই লাখ মা— বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে আমরা অর্জন করেছি স্বাধীনতার লাল সূর্য ও পবিত্র সংবিধান। স্বাধীনতা অর্জনের মূলমন্ত্র ছিলো শ্রেণি-বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত স্বাধীনতাত্তোর সরকারের প্রতিটি পদক্ষেপেই এই মূলমন্ত্র নিহিত ছিলো।

বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সুশাসন, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ন্যায়বিচার— এ অর্থে সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে পবিত্র সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার মধ্য দিয়ে অসাম্প্রদায়িক বৈষম্যহীন প্রগতিশীল রাষ্ট্র ও বিশ্ব মানবিক চেতনার প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায়। সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে গণতান্ত্রিক স্বচ্ছ জবাবদিহিতামূলক শক্তিশালী করার বিকল্প নেই— এই চিন্তা, মহান স্বাধীনতার স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার অনুসারীদের মস্তিষ্কে ছিলো।

এ লক্ষে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো হয়েছিল। কিন্তু ঊনিশ পঁচাত্তর সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তির অপতৎপরতায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তার পরিবার ও জাতীয় চার নেতার নৃশংস হত্যার মধ্য দিয়ে সকল সাম্য-সমতা ও মানবতার পথ রুদ্ধ হয়।

সোনার বাংলা গড়ার লক্ষে সোনার মানুষ তৈরির প্রচেষ্টাও স্তব্ধ হয়। রুদ্ধ দুয়ার খুলে দীর্ঘ একুশ বছরের বহু রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষশক্তি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে সোনার বাংলা পুনঃপ্রতিষ্ঠার সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়ে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে অধিকতর শক্তিশালী করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে।

কিন্তু ২০০১ সালে এ পথ ফের রুদ্ধ হয়। ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা দর্শন ডিজিটাল বাংলাদেশ দর্শনে রূপান্তরিত হয়ে প্রযুক্তি নির্ভর কল্যাণমূলক রাষ্ট্র গঠনের লক্ষে সরকার গৃহীত বহুবিধ কার্যক্রমের মধ্যে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা স্বচ্ছ জবাবদিহিতামূলক তথা শক্তিশালী করণের প্রক্রিয়াটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব্যাপক প্রশংসিত হয়।

বর্তমান সরকার ‘আমার গ্রাম, আমার শহর’ প্রতিপাদ্যে গ্রাম-উন্নয়নকে রাষ্ট্রের উন্নয়নের চাবিকাঠি বিবেচনায় এনে কার্যক্রম শুরু করে। এ কার্যক্রম বাস্তবায়নে স্থানীয় সরকার কাঠামোর মৌলিক স্তর ইউনিয়ন পরিষদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানসহ পরিষদের কর্মরত জনবল সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাস্তবায়নের ভিত্তি বলে নিরুপিত হয়। ইউনিয়ন পরিষদের কর্মরত জনবলের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, ইউনিয়ন পরিষদ সচিব।

ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে ক্রমবর্ধমান কাজের পরিধিতে ইউপি সচিবের দায়িত্ব ও কর্তব্য বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। সাচিবিক দায়িত্ব ছাড়াও বিভিন্ন কমিটির দায়িত্ব পালন, উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের প্রাক-প্রাক্কলন তৈরি, বাজেট প্রণয়ন, অফিস ব্যবস্থাপনা, হিসাব সংরক্ষণ, রাজস্ব আদায়, ত্রাণ বিতরণ, মাস্টার রোল তৈরি, গ্রাম আদালত পরিচালনা, উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বেও নিয়োজিত থাকেন।

এছাড়াও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় বিভিন্ন ভাতাভোগী নির্বাচন ও তালিকা প্রণয়ন যেমন : বয়স্ক-বিধবা, প্রতিবন্ধী, মাতৃত্ব ভাতা, হরিজন ভাতাসহ ভিজিডি, ভিজিএফ কার্ডের সুবিধাভোগীদের নির্বাচনসহ নীতি-নির্ধারণ, তালিকা প্রণয়নেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হয়। এখানেই সচিবের কাজ শেষ নয়। নাগরিক সনদ, জন্মমৃত্যু সনদ, ওয়ারিশ সনদসহ বিভিন্ন প্রকার সনদ প্রদানের দায়-দায়িত্বও সচিবের ওপর বর্তায়।

মূল কথা, সরকারের প্রায় সকল মন্ত্রণালয়ের প্রায়োগিক বিষয়গুলোও প্রান্তিক পর্যায়ে বাস্তবায়নে ইউপি সচিবের দায়-দায়িত্বের পরিধি অস্বীকার করার সুযোগ নেই। খাটো করে দেখারও উপায় নেই। উল্লিখিত দায়িত্ব পালন করেও ইউপি সচিবগণের বেতন স্কেল ১৪তম গ্রেড।

ইউনিয়ন পরিষদ (পরিষদের কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগ ও চাকরির শর্তাবলী) বিধিমালা, ২০১১ অনুযায়ী সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে ইউপি সচিবগণের শিক্ষাগত যোগ্যতা স্নাতক এবং বেতনস্কেল ১০২০০-২৪৬৮০/- । ইউনিয়ন পরিষদে ০৩ (তিন) ক্যাটাগরির কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছে। ইউনিয়ন পরিষদের কর্মকর্তা ও কর্মচারীগণের সচিব পদে শিক্ষাগত যোগ্যতা স্নাতক- ১৪তম গ্রেড, হিসাব সহকারী কাম-কম্পিউটার অপারেটর পদে শিক্ষাগত যোগ্যতা এইচএসসি- ১৬তম গ্রেড, দফাদার পদে শিক্ষাগত যোগ্যতা এইসএসসি, মহল্লাদার পদে শিক্ষাগত যোগ্যতা অষ্টম শ্রেণি।

স্থানীয় সরকার কাঠামোর অন্যান্য স্তর যথা : পৌরসভা, উপজেলা পরিষদ, জেলা পরিষদে একই যোগ্যতা সম্পন্ন পদের বেতন গ্রেড-কাঠামো-স্কেলে ভিন্নতা রয়েছে। পৌরসভার পৌর সচিব (ক-শ্রেণি) পদে শিক্ষাগত যোগ্যতা স্নাতকোত্তর- ১৬৫০-৩০২০ (০৯ম গ্রেড), পৌর সচিব (খ-শ্রেণি) পদে শিক্ষাগত যোগ্যতা স্নাতকোত্তর- ১০০০-২২৪০ (১১তম গ্রেড), পৌর সচিব (গ-শ্রেণি) পদে শিক্ষাগত যোগ্যতা স্নাতকোত্তর- ৯০০-২০৭৫ (১২তম গ্রেড)।ইউনিয়ন পরিষদে ১০ম গ্রেড বা তদুর্ধ্ব কোনো কর্মচারী নেই। ইউনিয়ন পরিষদ (পরিষদের কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগ ও চাকরির শর্তাবলী) বিধিমালা, ২০১১/এর বিধি ১৩/এ তফসিলের বিধানাবলী সাপেক্ষে কোনো কর্মচারীকে পরবর্তী উচ্চতর পদে পদোন্নতির জন্য বিবেচনা করা যেতে পারে মর্মে উল্লেখ রয়েছে। তবে ইউপি সচিবগণ পদোন্নতি পান না।

ইতোমধ্যে ইউপি সচিবগণের বেতন কাঠামো ১০ম গ্রেডে উন্নীত করার দাবি নানা পর্যায়ে উত্থাপিত হয়েছে। আমার জানা মতে, এ বিষয়টি মানবাধিকারকর্মী, জনপ্রতিনিধি ও আইন প্রণেতাদের নজরে এসেছে। ইউপি সচিবগণের দায়িত্ব, কর্তব্য, পদোন্নতি প্রভৃতি বিষয় বিবেচনান্তে সার্বিক পর্যালোচনায় ইউনিয়ন পরিষদে কর্মরত সচিবগণের বেতন কাঠামো-স্কেল-গ্রেড পুনঃমূল্যায়নের দাবি রাখে।

১০ম গ্রেডভুক্ত বিভিন্ন পদের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই কৃষি দপ্তরে উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তার শিক্ষাগত যোগ্যতা কৃষি ডিপ্লোমা প্রাথমিক ও গণশিক্ষা দপ্তরে প্রধান শিক্ষকের শিক্ষাগত যোগ্যতা স্নাতক, স্বাস্থ্য দপ্তরে নার্সের শিক্ষাগত যোগ্যতা নার্সিং ডিপ্লোমা, স্থানীয় সরকার (উপজেলা পরিষদ) দপ্তরে প্রশাসনিক কর্মকর্তার শিক্ষাগত যোগ্যতা এইসএসসি, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পুলিশের এসআই-এর শিক্ষাগত যোগ্যতা স্নাতক, স্বাস্থ্য দপ্তরে উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসারের শিক্ষাগত যোগ্যতা ডিপ্লোমা, সিটি করপোরেশনে প্রশাসনিক কর্মকর্তার শিক্ষাগত যোগ্যতা স্নাতক, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় (একটি বাড়ি একটি খামার) দপ্তরে উপজেলা সমন্বয়কারীর শিক্ষাগত যোগ্যতা স্নাতক, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ফিল্ড অফিসারের শিক্ষাগত যোগ্যতা স্নাতক, ভূমি দপ্তরে ইউনিয়ন সহকারী ভূমি কর্মকর্তার শিক্ষাগত যোগ্যতা এইসএসসি, মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সহকারী শিক্ষক, শরীরচর্চা শিক্ষক কর্মকর্তার শিক্ষাগত যোগ্যতা স্নাতক। এ কথা অনস্বীকার্য যে, স্থানীয় সরকার কাঠামোর মৌলিক স্তর হলো ইউনিয়ন পরিষদ।

ইউনিয়ন পরিষদের অন্যতম চালিকা শক্তি ইউপি সচিবগণ। আমরা যদি ইউপি চেয়ারম্যানকে নায়ের মাঝির সাথে তুলনা করি তবে ইউপি সচিব এই মাঝির নাও। এ নায়ের যাত্রী ইউনিয়নে বসবাসরত সকল নাগরিক। যেহেতু স্থানীয় সরকারের মৌলিক ভিত্তি ইউনিয়ন পরিষদের উপরই দেশের মৌলিক উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রা নির্ভর করছে। তাই ইউপি সচিবগণের মর্যাদা ও বেতন কাঠামো ১০ম গ্রেড বা তদুর্ধ্ব গ্রেডে উন্নীত করা আবশ্যক।

এ পর্যায়ে ইউপি সচিবগণের সার্বিক দায়িত্ব-কর্তব্যবোধ এবং কর্মপরিধির দিকটি বিবেচনায় এনে পদবির নাম সচিব পরিবর্তন করে প্রধান নির্বাহী নামকরণ মূল্যায়নের দাবি রাখে। তবে এক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে যে, সচিবদের ক্ষমতা যেন স্বচ্ছ ও জবাবদিহিতামূলক হয়। মনে রাখতে হবে, আইন সবার জন্য সমান।

লেখক : চেয়ারম্যান, জাতীয় মানবাধিকার সোসাইটি, উপদেষ্টা (বাপসা), প্রেসিডেন্ট, ঢাবি সোস্যাল থিংকিং রিচার্স সেন্টার