Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই, ২০২৫,

বাংলাদেশের গর্বিত সন্তান স্যার ফজলে হাসান আবেদ

প্রিন্ট সংস্করণ॥নূরুল আমিন চৌধুরী

ডিসেম্বর ২১, ২০১৯, ০৭:৪৭ পিএম


বাংলাদেশের গর্বিত সন্তান স্যার ফজলে হাসান আবেদ একজন বাঙালি, একজন বাংলাদেশি, ফজলে হাসান আবেদ। যিনি তার জীবনের সর্বোচ্চ ত্যাগ, নিষ্ঠা, দেশপ্রেম ও দেশের আর্থসামাজিক তথা দেশের সাধারণ মানুষের জীবনমান উন্নয়নে, দারিদ্র্যমুক্তি, শিক্ষারপ্রসার ও স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে নিজ দেশেতো বটেই, বিশ্বের ১১টি দেশের ১২০ মিলিয়ন মানুষের মধ্যে সেবাকর্ম সম্প্রসারণ করে দৃষ্টান্তমূলক এক অনবদ্য উদাহরণ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এই সক্ষমতা ও পারঙ্গমতার জন্যে বিশ্বের সব চেয়ে সন্মানসূচক পুরষ্কার ব্রিটেনের রাণীর হাতে প্রদত্ত স্যার উপাধিসহ দেশ-বিদেশের বহু সন্মাননা, পুরষ্কার ও উপাধি লাভ করে নিজে যেমন ধন্য হয়েছিলেন, তেমনি বাংলাদেশকেও গৌরবান্বিত করেছেন। তিনি কেবল দেশেরই নয়, বিশ্বের সর্ববৃহৎ ক্ষুদ্র ঋণ প্রকল্প ব্র্যাক ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা ইমেরিটাস চেয়ার। ৮৩ বছরের বর্ণাঢ্য ও গর্বিত জীবনযাপন শেষে দেশ, সমাজ ও মানবতার সেবায় অনন্য অবদান সমাপ্ত করে তার পরলোক গমণে দেশ, জাতি ও বিশ্ব একজন সফল ও কৃতি মানুষকে হারিয়েছে। মহান মুক্তিযুদ্ধের পর যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের তৃণমূলের মানুষের সেবা করতে গিয়ে ব্র্যাক প্রতিষ্ঠা করেন ফজলে হাসান আবেদ। তিনি ছিলেন একজন নির্মোহ মানুষ। তিনি চাইলে ব্যক্তিগতভাবে অনেক সম্পদের মালিক হতে পারতেন। কিন্তু তার লক্ষ্য ছিলো দরিদ্র মানুষদের পাশে দাঁড়ানো। নিজের সম্পদের পেছনে ছুটলে তার জীবনের ব্রত থেকে দূরে সরে যাবেন বলে নিজের সম্পদের দিকে ছুটেননি তিনি। একবার এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি ব্র্যাক থেকে বেতন নিই। কিন্তু আমার নিজের কিছু নেই। আমার নিজের বাড়ি নেই, ভাড়া করা ফ্ল্যাটে থাকি। যখন ব্র্যাক প্রতিষ্ঠা করি, তখনই নিজের জন্য কিছু করব না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। কারণ নিজের সম্পদ গোছানোর ব্যবসা করতে গেলে গরিবদের সাহায্য করতে পারব না।’ সামাজিক ক্ষমতায়নের জন্য সাধারণ মানুষকে জেন্ডার সমতা, নারী ও শিশুদের অধিকার এসব বিষয়ে সচেতন করে তুলতে কাজ করেছেন তিনি। তাদের সামর্থ্য ও দক্ষতা বাড়াতে বিভিন্ন ধরনের কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন। যেসব সামাজিক কর্মকাণ্ডে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়িয়ে তোলা যায়, তার ওপর বিশেষ জোর দিয়ে কাজ করেছেন তিনি। তার প্রতিষ্ঠিত এনজিও ব্র্যাককে বিশ্বের বৃহত্তম বেসরকারি সংস্থায় পরিণত করতে নেতৃত্ব দিয়েছেন সামনে থেকে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য নিয়ে যেমন কাজ করেছেন, তেমনি গড়ে তুলেছেন ব্র্যাক ব্যাংক, বিকাশ ও আড়ংয়ের মতো ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান। ব্র্যাকের এই প্রাণপুরুষ প্রতিষ্ঠানটির দায়িত্ব তুলে দিয়েছেন নতুন নেতৃত্বের হাতে। বাংলাদেশে এ এক অনন্য নজির। তিনি বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ এবং বিশ্বের অন্য যে দেশগুলোতে আমরা কাজ করছি, সেখানে ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় নতুন ও উদ্ভাবনী সমাধান বের করতে হবে। আর এই কাজে তরুণ প্রজন্মের অমিত সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হবে।’ ২০০১ সালে ৬৫ বছর পূর্ণ করার পরই তিনি ঠিক করেন ব্র্যাকের নেতৃত্ব অন্যদের কাছে হস্তান্তর করতে হবে। তিনি তার কথামতো তরুণ নেতৃত্বকে সামনে এনেছেন। বাংলাদেশের অগ্রযাত্রার ইতিবাচক স্বপ্ন দেখতেন তিনি। তার বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে তার ইঙ্গিত দিয়ে গেছেন। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘আগামী ১০ বছরে আমরা আমাদের কাজের প্রভাব পৃথিবীর আরও বেশি মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে চাই। ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের ২৫০ মিলিয়ন মানুষের কাছে ব্র্যাক যেন পৌঁছে যায়, সেটিই আমার প্রত্যাশা। আমি স্বপ্ন দেখি, ব্র্যাক ভবিষ্যতে আরও বড় হবে, নতুন উদ্ভাবন চালিয়ে যাবে এবং নতুন দিনের প্রয়োজনে নতুন সমাধান নিয়ে এগিয়ে আসবে।’ তিনি ছিলেন আধুনিক মনমানসিকতা ও প্রযুক্তিবান্ধব চিন্তাধারার প্রবর্তক এক বিশেষ বৈশিষ্ঠসম্পন্ন অগ্রগণ্য ব্যক্তিত্ব। তিনি বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার সঙ্গে প্রযুক্তির সমন্বয় করার বিষয়টিকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখেছেন সব সময়। গত বছরের মার্চে ক্রেডিট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ফোরামের এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, ক্ষুদ্রঋণদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রযুক্তিভিত্তিক আর্থিক সিস্টেমের দিকে যেতে হবে। কারণ আগামী এক দশকে ঋণ কার্যক্রম পুরোপুরি বদলে যাবে। ঋণের পরিমাণ ও পদ্ধতির বিষয়গুলো নির্ধারণ করে দেবে প্রযুক্তি। এতে সময় ও শ্রম বাঁচবে। মানুষের জীবনে অভীষ্ঠ লক্ষ্যে পৌঁছতে অটল থাকতে পারলে এবং কঠোর পরিশ্রম করলে সফলতা আসে। তারই এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্যার ফজলে হাসান। ২০১৫ সালে দারিদ্র্য বিমোচনে অবদান রাখায় ওয়ার্ল্ড ফুড পুরস্কার পান তিনি। ওই সময় তিনি নিজের লক্ষ্য পরিষ্কার করে বলেন, ‘বাংলাদেশে আমরা যা করেছি, তা একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য থেকেই করেছি। আমাদের লক্ষ্য ছিলো দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে দারিদ্র্যসীমার মধ্যে থেকে বের করে আনা। কারণ আমরা অনুভব করি যে, দারিদ্র্য অমানবিক রূপ নেয়। অতিদরিদ্র অবস্থা থেকে মানুষকে বের করা সম্ভব। এ জন্য বিশ্বের প্রতিটি দেশের অঙ্গীকার প্রয়োজন।’ ২০৩০ সাল নাগাদ কেমন বাংলাদেশ কল্পনা করেন? এমন এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেন, ‘আগামী এক দশকে বাংলাদেশে দরিদ্র মানুষ কমে যাবে। তবে আমরা খুব বেশি ধনী হয়ে যাব না। আমাদের গড় আয় বেড়ে যাবে।’ বাংলাদেশকে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত দেখার জন্য পরিশ্রম করে গেছেন এই মহান ব্যক্তিটি। বাংলাদেশের উন্নয়নের ক্ষেত্রে আমাদের নিজস্ব উদ্ভাবনা ও অর্জিত অভিজ্ঞতা অন্য একটি দেশের মানুষের জীবনমান উন্নয়নে কীভাবে কাজে লাগতে পারে, সে লক্ষ্যেও কাজ করে গেছেন আমৃত্যু। ভবিষ্যতের যেকোনো পরিস্থিতির জন্য ফজলে হাসান আবেদ সব সময় প্রস্তুত থেকেছেন। তিনি ছিলেন প্রবল বাস্তববোধসম্পন্ন দূরদর্শী নেতৃত্বগুণের অধিকারী। এই চূড়ান্ত মুহূর্তটির জন্য আমাদের তিনি সর্বতোভাবে প্রস্তুত করে গেছেন। দীর্ঘ সময় ধরে সুনিপুণ পরিকল্পনার মাধ্যমে ব্র্যাকের নেতৃত্বের সুষ্ঠু পালাবদল সম্পন্ন করেছেন। তার জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই তার সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার ছিলো ব্র্যাক, ব্র্যাকের কর্মী এবং যাাদের নিয়ে ব্র্যাক কাজ করে সেই সব মানুষের প্রতি। তিনি তার শারীরিক অসুস্থতার কথা জানিয়ে কর্মীদের কোনোভাবেই বিচলিত করতে চাননি। যতদিন সম্ভব এবং যতটা সহজভাবে সম্ভব, তিনি স্বাভাবিক জীবনযাপন চালিয়ে যেতে চেয়েছেন। এমনকি, গুরুতর শারীরিক পরিস্থিতির মধ্যেও তিনি যথাসম্ভব অফিসে আসতে চেষ্টা করেছেন। ব্র্যাকের ভবিষ্যৎ কর্মকৌশল চূড়ান্ত করার কাজে সময় দিয়েছেন। ব্র্যাকের বৈশ্বিক পরিচালন কাঠামোর পরিকল্পনা করেছেন। ‘ওয়ান ব্র্যাক’ পরিচয়ে আমাদের কাজের প্রভাব কীভাবে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়া যায়, তার জন্য দিকনির্দেশনা প্রস্তুত করেছেন। ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির নতুন ক্যাম্পাসের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের জন্যও সময় দিয়েছেন। কর্তব্য ও কর্মের প্রতি তার আত্মনিবেদন, কর্মনিষ্ঠা এবং সুদৃঢ় নৈতিক অবস্থান তাকে ব্র্যাক পরিবারের সর্বশ্রদ্ধেয় ‘আবেদ ভাই’ করে তুলেছে। মানুষকে মর্যাদা দেওয়ার বিষয়টি ছিলো তার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সততা, বিনয় এবং মানবিকতার এক বিরল দৃষ্টান্ত ছিলেন তিনি। তার এসব গুণই ব্র্যাকের প্রাতিষ্ঠানিক মূল্যবোধ গড়ে ওঠার ভিত্তি রচনা করেছে। তিনি এমনভাবে ব্র্যাককে গড়ে তুলতে সমর্থ হয়েছেন, যাতে তা কখনোই ব্যক্তিনির্ভর কোনো প্রতিষ্ঠান হয়ে থাকেনি। বরং বহু মানুষের সমন্বিত শক্তিই ব্র্যাকের মূল চালিকাশক্তি হয়ে উঠেছে। কর্মীদের ওপর ছিলো তার অগাধ আস্থা। তিনি বিশ্বাস করতেন, ব্র্যাকের নিবেদিত কর্মী দল তার স্বপ্নের সেই পৃথিবী গড়ে তুলবে, যেখানে সব মানুষ তার সম্ভাবনা বিকাশের সমান সুযোগ পাবে। যে মূল্যবোধ তিনি আমাদের মধ্যে সঞ্চারিত করেছেন, তা আমাদের জন্য ভবিষ্যতের পথনির্দেশক হয়ে থাকবে। ৩৬ বছর বয়সে ব্র্যাক প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে তিনি নিজেকে আমূল বদলে ফেলেছিলেন। সেই দিন থেকে শুধু তার নিজের জীবন নয়, পৃথিবীজুড়ে লাখোকোটি মানুষের মধ্যে নিজেদের জীবন বদলে ফেলার বিশ্বাস তিনি জাগিয়ে তুলেছেন। তার মৃত্যু পুরো ব্র্যাক পরিবারকে শোকে স্তব্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু পরিস্থিতি যতই প্রতিকূল হোক, সামনে এগিয়ে যাওয়ার মন্ত্র তিনিই সবাইকে শিখিয়েছেন। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত যে মর্যাদাবোধ, সাহস আর সহানুভূতির দৃষ্টান্ত তিনি স্থাপন করেছেন, সেই প্রেরণা নিয়ে তার অসম্পূর্ণ কাজগুলোকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। স্যার ফজলে হাসান আবেদের অসম্পূর্ণ স্বপ্ন বাস্তবায়নের দায়িত্ব এখন তার প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানসমূহের কাঁধে বর্তেছে। নিরলস প্রচেষ্টার মাধ্যমে ব্র্যাক পরিবারের প্রতিটি সদস্য তার উত্তরাধিকারকে বহন করে নিয়ে যাবে, এটাই হোক ব্র্যাক পরিবারের সবার অঙ্গীকার। লেখক : সাবেক কলেজ অধ্যক্ষ, গবেষক ও কলামিস্ট এসটিএমএ