Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪,

কৃষকের ধানে ধনী ধোঁকাবাজ চক্র

বিশ্বজিত রায়

জুন ৮, ২০২০, ০৩:০৯ এএম


কৃষকের ধানে ধনী ধোঁকাবাজ চক্র

হাওরে বৈশাখী দাওয়া গত হয়েছে বেশ কিছুদিন হয়ে গেল। এই তো কদিন আগে নতুন ধান আর শুকনো খরের মৌ মৌ গন্ধে মাতোয়ারা ছিলো সমগ্র হাওর পারের প্রকৃতি ও পরিবেশ।

এ বছর কাঙ্ক্ষিত ফলনে স্বপ্ন পূরণ হয়েছে কৃষকের। করোনাকালের দুর্যোগ দুশ্চিন্তা মাথায় নিয়ে এবার হাওরে খেলা করেছিল পাকা ধানের সোনালি ঢেউ। সেই স্বর্ণাভ ঢেউয়ে সাঁতার কেটেছে অসংখ্য কৃষক। বিরামহীন ব্যস্ততায় এগিয়েছে তাদের চার হাত-পা।

প্রায় মাসখানেকের অক্লান্ত মেহনত শেষে দেশ ও দশের দুশ্চিন্তা ঘুচিয়ে নেয়া কৃষক এখন অনেকটাই তৃপ্ত। তাদের মুখে প্রকৃতি বদান্যতার শিকার্য ভাষা জানান দিয়েছে বিগত এক দশকের মধ্যে এবারকার বৈশাখটা ছিলো অন্যরকম। এ যাত্রায় মন ভরিয়ে দেয়া বৈশাখ হাসিয়েছে গোটা হাওর তথা পুরো কৃষক পরিবারকে।

তবে এর মাঝে একটা কথা না বললেই নয়, কথাটা হচ্ছে, এই কৃষকের ধানেই ধনী হচ্ছে ধোঁকাবাজ চক্র। নানা দুর্যোগের সাথে নিত্য যুদ্ধ করা কৃষক এবার করোনা নামক বাড়তি শঙ্কা নিয়েই সোনালি ফলনে ঝাঁপ দিয়েছিলেন।

অবশেষে ফলনে টইটুম্বুর হাওরের কর্মব্যস্ত জমিন মাড়িয়ে এখন গোলাভরা আনন্দে আত্মহারা কৃষক। তবে হাওর পারে স্বস্তির দাপাদাপি টের পাওয়া গেলেও কি জানি এক অস্বস্তি কাজ করছে কৃষকের মনে।

আর সেটা হলো ঘামছোটা ধানে ফঁড়িয়াদের হানা। সরকার করোনা বিপর্যয়ের কথা চিন্তা করে কৃষকদের কাছ থেকে ন্যায্য মূল্যে ধান ক্রয়ের যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাতে কৃষক যতটা না লাভবান হবে তার চেয়ে বেশি লাভ গুনবে হাওর পারের এই অসাধু গোষ্ঠী।

এদের আটকানো না গেলে করোনা জয় করা কৃষক ফের ফড়িয়া আক্রান্ত হবেন। করোনার কবলে খাদ্য নিরাপত্তা যখন হুমকির মুখে তখন কৃষক একাই কাঁধে তুলে নেয় খাদ্য সুরক্ষিত বৃহৎ বোঝাটি।

আপদকালীন এ মুহূর্তে দেশের খাদ্যগুদাম ভরিয়ে দেয়া এই কৃষকই সরকারি সংগ্রহ সুবিধাপ্রাপ্তি থেকে প্রায় বঞ্চিত হচ্ছেন। ধান সংগ্রহ ডামাডোলে সুবিধা নিচ্ছে সুযোগসন্ধানীরা।

এ করোনাকালে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতের পুরস্কারস্বরূপ কৃষক সম্প্রদায়কে ন্যায্য মূল্যে ধান বিক্রির সুযোগ করে দিয়েছে সরকার। এটা ভাগ্যবিড়ম্বিত কৃষকের জন্য বড্ড উপকারই বটে। ধানের বাজার মূল্য যেখানে (প্রতি মণ) ছয়শ থেকে সাতশ টাকা সেখানে সরকার কৃষকের কাছ থেকে ধান ক্রয় করছে এক হাজার ৪০ টাকা দরে।

আর এই প্রক্রিয়া পরিচালনা করা হচ্ছে লোকদেখানো লটারির মাধ্যমে। যেখানে বিক্রয় উপযোগী গুটিকয়েক কৃষকের নাম থাকলেও বাকিসব বিক্রয় অনুপযোগী কৃষক। কারণ অনুপযোগী বললাম এ জন্য, তাদের কৃষি কার্ড থাকলেও অনেকের জমি নেই, কারো জমি পত্তনি দেয়া, কেউ কেউ জমি করেছেন ঠিক তবে তা যথেষ্ট নয়।

এমন কৃষকের নামও লটারিতে ভেসে উঠেছে। তাহলে অনুপযুক্ত এই কৃষকের ধান কে দেবে? ধান বিক্রয় অযোগ্য এ কৃষকেরা হয়তো ফঁড়িয়াদের কাছ থেকে সামান্য সুযোগ নিয়ে ধান বিক্রির সার্টিফিকেট তাদের হাতে ধরিয়ে দেবে। আর এদের জন্যই ধান বিক্রয়যোগ্য অনেক কৃষকেরা নিজ গোলা থেকে সরকারের গোলায় ধান দিতে পারবে না।

উপরোল্লিখিত কথাগুলোর সত্যতা নিশ্চিত করতে নিজ এলাকার উদাহরণ তুলে ধরা প্রয়োজন। আর এ উদাহরণটা তুলে ধরছি সুনামগঞ্জ জেলার জামালগঞ্জে বসে। সেখানকার একজন স্থানীয় সাংবাদিক হিসেবে আমার নিজ ইউনিয়নকেই আমি পর্যবেক্ষণ করেছি।

পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, মেম্বার-চেয়ারম্যান ও তাদের নিকটাত্মীয় এবং ঘনিষ্ঠজনদের নামই লটারিতে বেশি প্রাপ্ত হয়েছে। অতীতে কারসাজি করে সরকারি গুদামে ধান দেয়ার অভিযোগও রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে।

এছাড়া ওই মেম্বার-চেয়ারম্যানদের মতো আরও কত অসাধুজন আছে যারা কৃষকের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে অবাধে নিজেদের আখের গুছিয়ে নিচ্ছে। এ নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছেন হাওর পারের একেকজন মানুষ। তাদের দাবি কৃষকের বদলে এতে লাভবান হবে মিল মালিক ও ফঁড়িয়া গোষ্ঠী।

তাহলে সরকারের এই বাগাড়ম্বর আয়োজন কি বিফলে যাবে? আপাত দৃষ্টিতে তাই মনে হচ্ছে। এ জন্য সরকারকে আরও কঠিন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

কৃষক বাছাইয়ে অনিয়ম রোখার পাশাপাশি লটারিপ্রাপ্ত প্রকৃত কৃষক সরকারি গুদামে ধান দিচ্ছে কি-না সে বিষয়টি খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। শুধু লটারি দিয়েই স্বচ্ছতা আনার চেষ্টা করলাম আর এর ফাঁকে অবৈধ জুচ্চোরেরা কৃষকের স্বপ্ন চুরি করে নেবে তা মানা যায় না।

এই করোনাকালেও থেমে নেই অবৈধ পন্থা অবলম্বনকারী ওই ধোঁকাবাজরা। কৃষকের কষ্ট আর ঘামে ফলা ধান নিয়ে ধান্দাবাজি অব্যাহত রেখেছে ওরা। একদিকে প্রাণনাশা করোনার ভয় অন্যদিকে ধান দালালদের দৌরাত্ম্য।

এমতাবস্থায় প্রশ্ন উঠছে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবেন কৃষক। করোনা নামক অদৃশ্য ভাইরাসটি পুরো পৃথিবীকে মৃত্যুর দিকে ধাবিত করেছে। করোনার করুণ ছুঁবলে বিশ্বে মানব মৃত্যুর দিকে নজির সৃষ্টি করেছে। বিপজ্জনক এ ভাইরাসে বিশ্বে প্রায় অর্ধ কোটিরও বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছে। এক কথায় এক অঘোষিত যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে পৃথিবী। আর আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশ এর প্রভাবে সর্বাবস্থায় নতজানু হবে এটাই স্বাভাবিক।

তবে কৃষি খাত ব্যতীত দেশের ছোট-বড় শিল্প খাতসহ সকল সেক্টরে অচলাবস্থা বিরাজ করছে। দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা কৃষক মরণব্যাধি করোনাকে তাদের কাছেই ঘেঁষতে দেয়নি। করোনার বর্তমান নাজুক পরিস্থিতিতে আবারো সফলতা দেখিয়েছে আমাদের গর্বিত চাষা সম্প্রদায়। তাদের অক্লান্ত পরিশ্রমে ভর করে দেশ খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে।

আর তাদের ভাগ্য নিয়েই জোয়া খেলা শুরু করেছে হাওর পারের একটা স্বার্থান্ধ গোষ্ঠী। এই অপতৎপরতা প্রতিহত করতে হবে। আমাদের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি হচ্ছে কৃষি, রেমিট্যান্স ও পোশাক শিল্প।

এই তিন অর্থনীতির দুটোই উল্টে ফেলা কচ্ছপের মতো ঘুরে দাঁড়ানোর মরণপণ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। একমাত্র কৃষিই আশা জাগিয়েছে। দেশে দেশে যখন খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে কথা উঠছে তখন বাংলাদেশ তা নিশ্চিত করে ফেলেছে। একমাত্র কৃষকের জন্য সেটা সম্ভব হয়েছে। এর মাঝে সরকারের সহযোগিতাও উল্লেখ করার মতো।

খাদ্যে স্বয়সম্পূর্ণতার মূল নায়ক কৃষক সম্প্রদায়কে সুবিধা দিতে নানাভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছে সরকার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কৃষকের জন্য ৪ শতাংশ সুদে পাঁচ হাজার কোটি টাকা প্রণোদনার ব্যবস্থা করেছেন। কৃষি খাতকে সচল রাখতে ইতোমধ্যে নানা পদক্ষেপ গ্রহণসহ কৃষিকে যান্ত্রিকীকরণের পথে অনেক দূর এগিয়ে গেছে কৃষি মন্ত্রণালয়।

এ ছাড়াও আগামী বাজেটে কৃষি খাতে আরও বেশি বরাদ্দ বাড়ানো হবে জানিয়েছেন পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান। করোনা পরিস্থিতিতে খাদ্য মন্ত্রণালয় থেকে এরই মধ্যে ২৬ টাকা কেজি দরে ছয় লাখ টন ধান এবং ৩৬ টাকা কেজি দরে ১০ লাখ টন চাল কেনার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।

কৃষকের জন্য সরকারের সাহায্য-সহযোগিতার এই ইতিবাচক ফল গিলে খাচ্ছে একটা অসাধু চক্র। কৃষকের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলা এই ধূর্ত গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে হবে। এ জন্য সরকারকে কঠিন থেকে আরও কঠিন হতে হবে।

দেশের খাদ্য নিরাপত্তায় হাওর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আমাদের হাওরাঞ্চল দেশের প্রায় অর্ধেকেরও বেশি খাদ্য জোগান দিয়ে থাকে।

কৃষি সমপ্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, এ বছর বোরো উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা হলো দুই কোটি চার লাখ ৩৬ হাজার মেট্রিক টন। আমাদের সারা বছরের মোট উৎপাদনের প্রায় ৫৫ ভাগের জোগান দেয় বোরো ধান।

বিবিএসের তথ্যানুযায়ী, ২০১৮-১৯ সালে দেশে মোট ধান উৎপাদন হয়েছিল ৩ দশমিক ৬৪ কোটি টন। তার মধ্যে বোরো থেকে এসেছিল শতকরা ৫৪ ভাগ, আমন থেকে ৩৪ ভাগ আর আউশ থেকে এসেছিল ৮ ভাগ।

সবকিছু মিলে হাওরাঞ্চলের একফসলি বোরোই দেশের বৃহৎ খাদ্য চাহিদা পূরণ করে চলেছে। প্রাকৃতিক বিপর্যয় এড়িয়ে সঠিক ব্যবস্থাপনায় ধান ঘরে উঠানো গেলে এবং সরকারের বাজার ব্যবস্থাপনায় কড়া নজরদারি থাকলে আগামী কমপক্ষে ছয় মাস খাদ্য সঙ্কটের চিন্তা থাকবে না মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

তবে প্রাকৃতিক বিপর্যয় কাটিয়ে কৃষক ধান গোলায় তুলতে পারলেও ন্যায্য প্রাপ্তি কি জুটবে কৃষকের কপালে, সে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। প্রকৃতি ও করোনা দুই দুর্যোগের কবলে পড়া কৃষক উচ্চ হারে শ্রমিক খাটিয়ে যদি ন্যায্য মূল্য না পায় তাহলে তাদের বেলায় সেই মাঠেমরা অবস্থাই হবে। করোনাকালীন বিপর্যয় সামাল দিতে কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি ধান ক্রয় করবে সরকার। মাঠপর্যায়ে এর কার্যক্রম শুরু হয়ে গেছে।

কিন্তু কতটা উপকৃত হবে কৃষক? সরকার তো প্রতি বছরই ধান ক্রয় করে। সেই ধান কৃষকের বদলে সরকার দলীয় নেতাকর্মী এবং এক শ্রেণির অসাধু চক্র কৌশলে সরকারি গুদামে দিয়ে নিজেদের আখের গুছিয়ে নিচ্ছে। এই সুযোগসন্ধানী কৃষকখেকো দলটিকে আটকাতে হবে। প্রকৃত কৃষকরা যাতে তার উৎপাদিত ধান সরকারি গুদামে দিতে পারে সেই ব্যবস্থা করতে হবে। নইলে দেশে খাদ্য স্বয়ংসম্পূর্ণতার প্রধান নায়ক সেই কৃষকই বঞ্চিত হবেন।

তাই কৃষকের কথা চিন্তা করে কৃষি খাতকে আলাদা গুরুত্ব দিতে হবে। এই বঞ্চিত শ্রেণিটা যাতে আর বঞ্চিত না হন। মনে রাখতে হবে, কৃষকই বাঁচায় প্রাণ, কৃষকই বাঁচায় দেশের মান। কৃষককে বাঁচিয়ে রাখলে দেশটাই যে বেঁচে যাবে। সেই চিন্তাটা মাথায় রেখে সামনে এগুতে হবে।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

আমারসংবাদ/এসটিএম