Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪,

দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা প্রশ্নে কোভিড-১৯

রায়হান আহমেদ তপাদার

জুন ১৪, ২০২০, ১০:১৫ পিএম


দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা প্রশ্নে কোভিড-১৯

২০২০ সামাজবিজ্ঞানীদের জন্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ বছর। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অব্যবহিত পরে স্প্যানিশ ফ্ল শুরু হয়। এই ইনফ্লুয়েঞ্জা জ্বরের স্থায়িত্ব কাল ছিলো ১৯১৮ থেকে ১৯২০ সাল পর্যন্ত।

মিলিয়ন মানুষ তখন মারা যায় এবং ম্যাক্স ওয়েবারকে ও সেই পরিণতি ভোগ করতে হয়। ওয়েবারের বয়স ছিলো মাত্র ৫৬ বছর। বেশ কিছু দেশের এমন বিপর্যয় ঘটে যাতে সামাজিক ও রাজনৈতিক অচলাবস্থা তৈরি হয়।

ব্রিটিশ উপনিবেশ পশ্চিম সামোয়ার ৯৫ শতাংশ মানুষ ওই ভাইরাসে আক্রান্ত হয় এবং প্রায় ২২ শতাংশ মানুষ মৃত্যুবরণ করে। নানা ক্ষতির মধ্যে ডেমোগ্রাফিক ক্ষতিটি ছিলো তাৎপর্যপূর্ণ। বয়স্ক কিংবা শিশুরা বেশি মারা যায়নি।

ওই ভাইরাসের শিকার ছিলো যুবসমাজ, যাদের বয়সের ব্যাপ্তি ছিলো ১৫-৪০ এর মধ্যে। ওয়েবার যখন মারা যান, ওই সময়ে তিনি তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘ইকোনমি অ্যান্ড সোসাইটি’ নিয়ে কাজ করছিলেন।

অভিযোগ উঠেছে, কোনো সমাজতাত্ত্বিকই ওই ফ্লুয়ের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব নিয়ে কাজ করেননি। ওয়েবার তার জীবদ্দশার শেষ বছরে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অর্থনৈতিক প্রভাব নিয়ে লিখেছিলেন; কিন্তু কিছুই লিখেননি মহামারির অর্থনৈতিক প্রত্যাঘাত নিয়ে। কাজেই সামাজবিজ্ঞানীদের কাছ থেকে আমরা লক্ষাধিক মানুষের দুর্ভাগ্য মৃত্যু এবং তদজনিত স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক শক নিয়ে তেমন কিছু জানি না।

কিন্তু ভাইরাসের সাথে পুঁজিবাদের বস্তুগত সম্পর্ক কি কিংবা থাকতে পারে কি-ইহজাগতিক দুনিয়ায় পুঁজিবাদের আত্মবিনাশী উপাদানগুলো কি-তা আমরা ওয়েবারের অন্তর্ধানের আগে কিংবা পরে তার সদুত্তর দেখি না। পুঁজিবাদ বড়ই নির্মম, এটি নিজ অন্তঃদ্বন্দ্বে জ্বলে পুড়ে যায় এবং তাই পুঁজিবাদী সমাজ অবিনাশী নয়।

নিকট ভবিষ্যতে আমরা দেখবো, করোনা প্রভাবে বাংলাদেশসহ সারা দুনিয়ার স্টক মার্কেট, শ্রমবাজার, উৎপাদন, বণ্টন এবং জিডিপি কিভাবে ধস নামে তা সময় বলে দেবে। সেদিক থেকে কোভিড-১৯ পুঁজিবাদের জন্য সার্বিকভাবে দুর্যোগ।

স্বাস্থ্য আগে না অর্থনীতি আগে— এই বিতর্ক পুঁজিবাদী দুনিয়াকে থমকে দিয়েছে। একবার লকডাউন আরোপ করা, আবার তুলে নেয়া পুঁজিবাদী জগতকে ধাঁধাঁয় ফেলে দেয়। বাংলাদেশের মতো দেশে ‘ছুটি’ ঘোষণা করে অপ্রকাশ্যে লকডাউন বলে। সারা দেশ নয়— ভাসুরের নাম না নেবার মতো। একটাই কারণ অর্থনীতি যেনো থমকে না যায়।

সেই জন্য গার্মেন্টস খোলা না, আবার বন্ধও না এই আলো আধারী খেলা চলে। ম্যাক্স ওয়েবার সম্ভবত তৎকালীন বুর্জোয়া সমাজে স্প্যানিশ ফ্লুয়ের ওই অন্তর্দ্বন্দ্ব বলতে চাননি।

কিন্তু তার ধর্মতত্ত্বে মৃতদেহের করুণ সৎকারের উল্লেখ নেই। পুঁজিবাদ এতই সঙ্কটাপন্ন যে, স্পেন, জার্মান, ইটালি এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিশেষত নিউইয়র্কে করোনা মৃত্যুজনিত লাশের সৎকার হয় না; গণকবরে লাশ পুঁতে ফেলা হয়।

কে জানে, আমার দেশেও আমি বা আমরা লাশ হয়ে ওই করুণ পরিণতির দিকে ধাবিত হচ্ছি কি-না? ম্যাক্স ওয়েবার নিজের জীবন দিয়ে পুঁজিবাদের নির্মমতার বলি হয়েছেন।

যে পুঁজিবাদকে তিনি বন্দনা করেছেন; সমাজতন্ত্রের বিপরীতে অবিনাশী সমাজ বলে প্রশস্তি গেয়েছেন— তিনি নিজেই তার ছোবল থেকে রক্ষা পাননি। মৃত্যুর পর ওয়েবারকে দাহ করা হয়েছিল।

১৯২০ সালে জার্মানিতে প্রটেস্টান্টদের দাহ করা খুবই অপ্রচলিত ছিলো। আর ক্যাথোলিকদের ক্ষেত্রে তো নিষেধই ছিলো। অনেকেই বলেন, ম্যাক্স ওয়েবারের মৃতদেহ দাহ করার মধ্য দিয়ে প্রকৃতিতে কার্বন-ডাই অক্সাইড যুক্ত হয়েছে— মৃত্যু আরেকভাবে জীবনকেই চালু রেখেছে।

কিন্তু বর্তমান করোনা মহামারি মোকাবিলায় সর্বজন গ্রহণযোগ্য জননীতি তৈরির ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিজ্ঞানী ও রাজনীতিবিদদের সম্পর্কের মধ্যেও সুবিশাল পরিবর্তন আসন্ন।

এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের যেমন অত্যন্ত যোগ্যতাসম্পন্ন বিজ্ঞানীর প্রয়োজন, তেমনি এ ধরনের মহামারি পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য যোগ্যতাসম্পন্ন রাজনৈতিক নেতার দিকনির্দেশনারও প্রয়োজন।

স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাওয়ার আগে আমাদের বেশ কিছু প্রশ্নের জবাব খুঁজে পেতে হবে। আর এই জবাবগুলো দেবে বিজ্ঞান, চিকিৎসাবিজ্ঞান এবং তাদের ব্যবহার ও প্রয়োগ। বাস্তবতা হচ্ছে, ভাইরাস যে গতিতে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে সেই একই গতিতে এই মহামারি মোকাবিলায় কাজ করে চলেছেন বিজ্ঞানীরা ব্রিটিশ বিজ্ঞানী সম্প্রদায় ভাইরাস মোকাবিলায় দ্রুত সাড়া দিয়েছে।

সরকারি অর্থায়ন সংস্থা ইউকে রিসার্চ অ্যান্ড ইনোভেশন-মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিল নতুন তহবিল প্রদান প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এর নামকরণ করা হয়েছে ওয়েলকাম ট্রাস্ট।

একে সহযোগিতা করতে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে গেটস ফাউন্ডেশন (বিল ও মিলেন্ডা গেটসের দাতব্য সংস্থা)। যুক্তরাজ্যের ক্যান্সার গবেষণায় সাহায্য করছে তারা। কোভিড-১৯ ক্যান্সারের চিকিৎসায় কী বিঘ্ন ঘটাচ্ছে সেটাই খুঁজে দেখছে তারা। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইমপেরিয়াল কলেজ অব লন্ডন গত সপ্তাহে তাদের নতুন টিকার কথা জানিয়েছে।

একই সঙ্গে ভাইরাসের নতুন কয়েকটি কাঠামোগত গঠনও প্রকাশ করেছে তারা। ওষুধ তৈরি এবং নতুন টিকা আবিষ্কার নিয়ে কাজ করছে গ্ল্যাক্সোস্মিথক্লেইন, আসট্রাজেনেকা ও সানোফির মতো কোম্পানিগুলো। ভাইরাসের পরীক্ষার জন্য সুবিশাল গবেষণাগার প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ছোট গবেষণাগারগুলো কাজ করছে বাণিজ্যিক পরীক্ষার কাজে।

আসলে অনেকটা হঠাৎ করেই ভিন্নভাবে কাজ করতে শুরু করেছে বিজ্ঞান। বিজ্ঞানীরা গবেষণার কাজে নাটকীয় পরিবর্তন এনেছেন। বহু ক্ষেত্রেই এই পরিবর্তিত গবেষণা চালিয়ে যেতে আর্থিক সমর্থনও পাচ্ছেন না তারা। তার পরও কাজ থেমে নেই। এসব গবেষণার ফলাফল তারা জানাচ্ছেন একই কাজের সঙ্গে যুক্ত অন্য বিজ্ঞানীদের।

আগে গবেষণা সাময়িকী প্রকাশিত হতো প্রতি মাসে বা বছরে। এখন তা হচ্ছে প্রায় প্রতিদিন বা প্রতি সপ্তাহে। বিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রের মধ্যে যে সীমানাপ্রাচীরগুলো ছিলো, তা দ্রুত ভেঙে পড়ছে। উন্নত ও ব্যবহারযোগ্য উপযোগ তৈরির সঙ্গে মৌলিক আবিষ্কারের গবেষণার যে প্রথাগত পার্থক্য বা বিভেদ রয়েছে, তা এখন আর নেই।

মৌলিক জীববিজ্ঞান গবেষকরা এখানে কাজ করছেন চিকিৎসাবিজ্ঞানের গবেষকদের সঙ্গে। কাজেই কোভিড-১৯ যুক্তরাজ্যে হানা দেয়ার পর এই ইনস্টিটিউটের গবেষকরা খুব সহজেই তাদের অন্য কাজ বাদ দিয়ে এই ভাইরাস নিয়ে গবেষণায় মনোযোগ দেন।

তাদের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা নতুন নতুন ধারণা নিয়ে কাজ করার ব্যাপারে উৎসাহ জোগায়। ‘প্রথাগত ধারণার বাইরে গিয়ে’ চিন্তা করার অবকাশ তাদের খুঁজতে হয়নি। ফলে তিন সপ্তাহেরও কম সময়ের মধ্যে কোনো সরকারি সমর্থন ছাড়াই ইউসিএল হাসপাতাল ফাউন্ডেশন ট্রাস্ট এবং রোগ নির্ণয়কারী প্রতিষ্ঠান হেলথ সার্ভিস ল্যাবরেটরিজের সহযোগিতায় ক্রিক গবেষণাকাজে একটি দল গঠন করতে সক্ষম হয়।

স্থানীয়ভাবে সংগঠিত হয়ে এই দলটি ভাইরাস পরীক্ষার কাজে অংশ নেয়। তারা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে নমুনা সংগ্রহ করে, গবেষণাগারে বিশ্লেষণের পর প্রাপ্ত ফলাফল সংশ্লিষ্ট হাসপাতালগুলোতে সরবরাহ করে। ফলে স্বাস্থ্যকর্মীদের পক্ষে আক্রান্তদের শনাক্ত করা সহজ হয়েছে।

একই সঙ্গে হাসপাতালগুলো নিরাপদ হয়েছে এবং কোভিড-১৯ আক্রান্ত ছাড়া অন্য রোগীদের পক্ষে হাসপাতালে যাওয়া ও চিকিৎসা নেয়া সহজ হয়েছে। এগুলো স্থানীয়ভাবে নেয়া পদক্ষেপ হলেও এর মাধ্যমে বড় গবেষণাগারগুলো উপকৃত হয়েছে। তবে বড় গবেষণাগারগুলোকেও আমাদের মতো সংকটের মোকাবিলা করতে হচ্ছে।

যেমন— এনএইচএসের (ব্রিটেনের জাতীয় স্বাস্থ্য সংস্থা) নির্দেশনায় বলা হয়েছে, সম্মুখ কাতারের স্বাস্থ্যকর্মীদের লক্ষণ না থাকলেও নিয়মিত কোভিড-১৯ পরীক্ষা করতে হবে।

কারণ লক্ষণ ছাড়াও তারা আক্রান্ত হয়ে থাকতে পারে। এই সিদ্ধান্তের কারণে সরকার প্রতিদিন এক লাখ পরীক্ষা করার যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে তার একটা বড় অংশই চলে যাবে স্বাস্থ্যকর্মীদের পরীক্ষায়।

এই মহামারি মোকাবিলায় সর্বজন গ্রহণযোগ্য জননীতি তৈরির ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিজ্ঞানী ও রাজনীতিবিদদের সম্পর্কের মধ্যেও সুবিশাল পরিবর্তন আসন্ন। এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

আমাদের যেমন অত্যন্ত যোগ্যতাসম্পন্ন বিজ্ঞানীর প্রয়োজন, তেমনি এ ধরনের মহামারি পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য যোগ্যতাসম্পন্ন রাজনৈতিক নেতার দিকনির্দেশনারও প্রয়োজন।

যেসব রাজনৈতিক নেতা নির্বাচনের আগে পরে গলা ফাটিয়ে দেশ উদ্ধার করেন তাদের অনেকেই এখন বিস্ময়কর রকম নীরব। আমরা এখনো নেতাদের বলতে শুনিনি, ‘আসুন, কোভিড নির্মূল করি।

এগুলো হয়তো নির্বাচনি প্রচারে বলা চলে। তবে বর্তমান পরিস্থিতির মতো সংকটে এসব ফাঁপা বুলি অচল। করোনা মহামারি হয়তো বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে রাজনীতিবিদদের নতুন ধরনের পরিণত এক সম্পর্কের জন্ম দেবে, যা বিশ্বের নেতৃত্বকে আরো শক্তিশালী করবে।

পরিশেষে বলতে চাই, করোনা ভাইরাসের বর্তমান এই সংকট শুধু ভাইরাস থেকেই মুক্তি দেবে না। বরং যোগ্যতার প্রমাণ না দিয়েও যেসব রাজনীতিক জনপ্রিয়তার শীর্ষে অবস্থান করছেন, তাদের হাত থেকেও বিশ্ব পরিত্রাণ পাবে এটাই সবার প্রত্যাশা।

লেখক : গবেষক ও কলাম লেখক

আমারসংবাদ/এসটিএম