সুজন হাজং
জুন ১৮, ২০২০, ১২:০০ পিএম
প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক সমরেশ মজুমদার লিখেছেন, মৃত্যু কি সহজ, কি নিঃশব্দে আসে অথচ মানুষ চিরকালই জীবন নিয়ে গর্ব করে যায়।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, ১৪ দলের সমন্বয়ক সাবেক মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের মৃত্যুর পর ১৩ ঘন্টার ব্যবধানে ধর্ম প্রতিমন্ত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট শেখ মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর পর নমুনা সংগ্রহ করে জানা যায় ধর্ম প্রতিমন্ত্রীর করোনাভাইরাস পজিটিভ।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গভীর শোক প্রকাশ করে বলেন, ‘রাজনীতিতে পাশে থেকে যারা সাহস ও সমর্থন দিয়েছেন, তারা একে একে আমাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। নাসিম ভাইয়ের পর শেখ আব্দুল্লাহ ভাইও চলে গেলেন। এটা আমার জন্য খুবই দুঃখজনক।’
দুজনের মৃত্যুর শোক কাটিয়ে না উঠতেই আবার না ফেরার দেশে চলে গেলেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য, সিলেটের সাবেক জনপ্রিয় মেয়র বদরউদ্দিন কামরান। তিনি ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত ১৫ জুন সোমবার ভোর ৩টায় মৃত্যুবরণ করেন।
এভাবে আর কত শোক বহন করবেন প্রধানমন্ত্রী? তার মতো প্রিয়জন হারানোর কষ্ট পৃথিবীর আর কোনো রাষ্ট্রপ্রধান পেয়েছেন বলে মনে হয় না। জীবনে অনেক কিছু হারিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। পঁচাত্তরের পনের অগাস্ট বাবা, মা, ভাই, আত্মীয়স্বজনকে হারিয়ে বুকে পাথর চাপা দিয়ে তিনি আজ বাংলাদেশের দুঃখজয়ী প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু তিনিও একজন রক্তেমাংসে গড়া মানুষ। একজন মা। চোখের ভেতর আর কত অশ্রু তিনি নিরবে লুকিয়ে রাখবেন?
বিভিন্ন সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ১৯ বার হত্যার চেষ্টা করা হয়েছিল। সৌভাগ্যক্রমে তিনি এখনো বেঁচে আছেন, সুস্থ আছেন। দেশের স্বার্থে দেশের মানুষের স্বার্থে প্রধানমন্ত্রীর সুস্থ থাকা খুবই জরুরি। প্রধানমন্ত্রীকে আরো অনেক বেশি সতর্ক থাকতে হবে। আরো অনেক বেশি সচেতন থাকতে হবে। আরো অনেক বেশি নিরাপদে থাকতে হবে।
দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে করোনাভাইরাস সংক্রমণ যেভাবে ছড়িয়ে পড়ছে তা উদ্বেগজনক এবং ভীতিকর। প্রধানমন্ত্রীও করোনাভাইরাসের ঝুঁকি থেকে মুক্ত নন। দেশের সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে। বাদ যাচ্ছে না দেশের রাজনীতিবিদ, এমপি, মন্ত্রী, আমলা এবং প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারাও।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক এবং তার স্ত্রী লায়লা আরজুমান্দ বানু করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। মন্ত্রীর একান্ত সচিব হাবিবুর রহমানও আক্রান্ত হয়েছেন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব মো. আবদুল মান্নানের সহধর্মিণী কামরুন নাহার কোভিড-১৯ সংক্রমণ নিয়ে সিএমএইচে মৃত্যুবরণ করেন।
উল্লেখ্য সম্প্রতি বিশ্বের যেসব দেশের প্রধানমন্ত্রী নভেল করোনাভাইরাসে (কোভিড-১৯) আক্রান্ত হয়েছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন এবং রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী মিখাইল মিশুস্তিন।
পাশাপাশি কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর স্ত্রী সোফি গ্রেগরি ট্রুডো, স্পেনের প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো সানচেজের স্ত্রী বেগোনা গোমেজ আক্রান্ত হয়েছেন। ব্রিটিশ যুবরাজ প্রিন্স চার্লস করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন।
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন গিনি বিসাউয়ের প্রধানমন্ত্রী নুনো গোমেজ না বিয়াম। গিনি বিসাউ উত্তর-পশ্চিম আফ্রিকার একটি দেশ। এটি বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্র দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি। ১৫ লক্ষ জনসংখ্যার এই দেশটি ১৯৭৪ সালে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে পুর্তগালের কাছ থেকে স্বাধীন হয়।
ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বাধ্য হয়েই দ্বিতীয় দফা হোম কোয়ারেন্টিনে ছিলেন। কারণ তার স্বাস্থ্যমন্ত্রী ইয়াকুফ লিৎসম্যান করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ছিলেন এবং তিনি তার সংস্পর্শে এসেছিলেন।
নাইজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ বুহারির ক্ষমতাধর চিফ অব স্টাফ কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। প্রাণঘাতী করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শীর্ষ পর্যায়ের ব্যক্তিসহ অগণিত সাধারণ মানুষ।
বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে। পাশাপাশি মৃত্যুর সংখ্যাও বাড়ছে। জাতীয় সংসদে ২০২০-২০২১ অর্থ বছরের বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে। এবারের প্রস্তাবিত বাজেটের আকার ৫ লক্ষ ৬৮ হাজার কোটি টাকা। প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস মোকাবেলায় ২০২০-২১ অর্থবছরে ১০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে।
করোনাভাইরাস সংক্রমণের বিস্তার প্রতিরোধে দেশের বিভিন্ন এলাকাকে রেড, ইয়েলো এবং গ্রিন জোনে ভাগ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে রাজধানীর পুরান ঢাকার ওয়ারী এবং ধানমন্ডির রাজাবাজার এলাকাকে রেড জোন হিসেবে চিহ্নিত করে লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে।
এর আগে ঢাকার বাইরে কক্সবাজার পৌরসভাকে প্রথম রেড জোন হিসেবে চিহ্নিত করে লকডাউন ঘোষণা করেছেন সেখানকার জেলা প্রশাসক। পাশাপাশি ঢাকার উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৪৫টি এলাকাকে ‘রেড জোন’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে করোনাভাইরাস প্রতিরোধে গঠিত জাতীয় কমিটি।
করোনা মোকাবেলায় সরকারের ব্যর্থটা কিংবা সফলতার হিসেব কষার সময় এখন নয়। ঘরে বসে সরকারের সমালোচনা করার সময়ও এখন নয়। সরকার একা নয় জনগণকে নিয়েই সরকার। জনগণকেও বুঝতে হবে দেশের নাগরিক হিসেবে তার করণীয় কী? তার দায়িত্ব কী? করোনা মোকাবেলায় আমরা নিজেরা কতটুকু সচেতন? আমরা সরকারি স্বাস্থ্যবিধি নিজেরা কতটুকু মেনে চলি?
এই মুহূর্তে স্বাস্থ্যখাতের দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে প্রধানমন্ত্রীকে। দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে নানান অব্যবস্থাপনার অভিযোগ উঠেছে। করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীরা যেন হাসপাতালে সঠিক চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত না হয়। চিকিৎসা সেবা নিতে গিয়ে সাধারণ মানুষ যেন কোনো বিড়ম্বনার শিকার না হয়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমান সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে সারাদেশে আইসিইউ শয্যা আছে ৩৯৯টি। তাদের মধ্যে সরকারি ৩১৮টি এবং বেসরকারি ৮১টি। যা বর্তমানে করোনাভাইরাস রোগীর সংখ্যা বিবেচনায় কোনোভাবেই পর্যাপ্ত নয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক সাবেক আঞ্চলিক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. মাজহারুল বলেন, জনসংখ্যার অনুপাতে দেশে ৩ হাজার ৪০০ আইসিইউ বেড এবং ৫ হাজার ভেন্টিলেটর দরকার।
যেসব করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীর তীব্র শ্বাসকষ্ট হয় তাদের জন্য ভেন্টিলেটর খুব জরুরি। কারণ ভেন্টিলেটরের মাধ্যমেই একজন মুমূর্ষু রোগীর শরীরে অক্সিজেন সরবরাহ করা হয়। তাই দেশের সকল পর্যায়ের হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত ভেন্টিলেটরের ব্যবস্থা করতে হবে।
হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ, ভেন্টিলেটর এবং অক্সিজেনের তীব্র সঙ্কট, এর সমাধান কি সময় সাপেক্ষ ব্যাপার? এটি কি স্বাস্থ্যখাতের সীমাবদ্ধতা নাকি উদাসীনতা? মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সুদৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
হাসপাতালে সাধারণ মুমূর্ষু রোগীরা যেন সহজে ভর্তি হতে পারে তা নিশ্চিত করতে হবে সরকারকে। বর্তমান সরকারের অনেক অর্জন রয়েছে তা যেন স্বাস্থ্যখাতে এসে ম্লান না হয়। সেদিকে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ নজর দিতে হবে। চিকিৎসা ক্ষেত্রে অব্যবস্থাপনা রুখতে প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে কঠোর নির্দেশ দিতে হবে প্রধানমন্ত্রীকে।
২০২০-২১ অর্থবছরে স্বাস্থ্যখাতে ২৯ হাজার ২৪৭ কোটি টাকার বরাদ্দ প্রস্তাব করা হয়েছে। চিকিৎসা ব্যবস্থাকে আরো উন্নত, আধুনিক এবং স্বয়ংক্রিয় করতে প্রয়োজনে স্বাস্থ্যখাতে প্রস্তাবিত বাজেটের বরাদ্দ আরো বাড়াতে হবে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষও যেন তার মৌলিক অধিকার স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত না হয়।
সম্প্রতি ব্যারিস্টার সুমন তার ফেইসবুক লাইভে এসে স্বাস্থ্য মন্ত্রীকে সরিয়ে নেয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে আকুল আবেদন করেছেন। টানা তিনবার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকা ধৈর্য্যশীল, জনপ্রিয় এবং বিচক্ষণ প্রধানমন্ত্রী ইতোমধ্যে স্বাস্থ্য সচিবকে সরিয়ে নিয়েছেন। আমরা জানি না, তিনি হয়তো সময়মতো স্বাস্থ্য মন্ত্রীকেও সরিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা করছেন।
কারণ এর আগে তিনি তিনজন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীকে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে রদবদল করেছেন। সম্প্রতি শ ম রেজাউল করিমকে গৃহায়ন ও গণপূর্ত থেকে মৎস ও প্রাণি সম্পদ এবং মো. আশরাফ আলী খান খসরুকে মৎস ও প্রাণিসম্পদ থেকে সমাজকল্যাণ এবং শরীফ আহমেদকে সমাজকল্যাণ থেকে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে রদবদল করেছেন।
করোনাভাইরাস একটি বৈশ্বিক সমস্যা। একটি বৈশ্বিক মহামারী। বিশ্বের অনেক উন্নত দেশ করোনাভাইরাসে বিপর্যস্ত। বৈশ্বিক এই মহামারীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে প্রয়োজন সচেতনতা। আমরা যদি নিজেরা সচেতন হই তাহলে এই ভয়াবহতা থেকে দেশকে বাঁচাতে পারব। দেশের মানুষকে বাঁচাতে পারব।
বঙ্গবন্ধু কন্যা আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে সামনে আরো কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে। করোনাভাইরাস পরবর্তী দেশের অর্থনীতিকে শক্ত ভিতের উপর দাঁড় করাতে হবে। করোনাভাইরাসের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার করে তাকে নেতৃত্ব দিতে হবে গণমানুষের স্বপ্ন পূরণে। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণে তার দিকে তাকিয়ে আছে দেশের ষোল কোটি জনগণ।