Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪,

স্মৃতিভরা বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়ি

মাহমুদুল হাসান কবীর

আগস্ট ১৮, ২০২০, ০৭:৪৬ পিএম


স্মৃতিভরা বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়ি

ঢাকার ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়কের বাড়িটি ইতিহাসখ্যাত ও সুপরিচিত। এটি শুধু বাড়ি নয়, সময়ের পরিক্রমায় ছিলো গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ঘটনাসমূহের সাক্ষী ও আশ্রয়স্থল। হাজারো স্বপ্নের চাষাবাদ হতো এখানে, অনেক স্বপ্ন অঙ্কুরোদগমের আগেই চোখের লোনা পানিতে সমুদ্রে বিলীনও হয়েছে। এখানে যেমন মধুর স্মৃতি রয়েছে তেমনি রয়েছে বেদনার স্মৃতি। স্বপ্নের ঘনঘটার মতোই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িটি তৈরি করতে ও সাজাতে পাড়ি দিতে হয়েছে নানা চড়াই উতরাই।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার লেখা ‘স্মৃতি বড় মধুর স্মৃতি বড় বেদনার’ নিবন্ধ থেকে জানা যায়, ১৯৬১ সালে দ্বিতল এ বাড়িটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। তিনটি কক্ষ বসবাসের সামান্য উপযোগী হলেই পয়লা অক্টোবর বাড়িতে উঠা হয়। বঙ্গবন্ধু জীবনের চার হাজার ৬৮২ দিন জেলে কাটিয়েছেন।

যার দরুন সংসারের পুরো দায়িত্ব ছিলো বঙ্গমাতার ওপর। বঙ্গমাতা ধীরে ধীরে টাকা জমিয়ে ও হাউজ বিল্ডিংয়ের লোন নিয়ে এ বাড়ির কাজ সম্পূর্ণ করেন। শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব সংসারে অগ্রণী ভূমিকা রাখার পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক কাজেও সর্বদায় সহযোগিতা করেছেন।

তিনি বঙ্গবন্ধু কারাগারে থাকার সময় পার্টির কর্মসূচি ও আন্দোলনে খরচের টাকাও যোগান দিতেন। ১৯৬৬ সালের শুরুর দিকে বাড়ির দু’তলার কাজ শেষ হয়। তখন থাকার জন্য সবাই দুতলায় উঠে যান, নিচতলা হয়ে উঠে রাজনৈতিক আলোচনাস্থল। পরিপাটি গোছানো দোতলা বাড়িজুড়ে শোবার ঘরের পাশাপাশি ছিলো লাইব্রেরি, ড্রেসিং রুম, ইস্ত্রি করার কক্ষ, আচার, চাল রাখার সেলফ কক্ষসহ বিভিন্ন ছবিতে সাজানো ছিলো দেয়াল।   

এ বাড়িতেই ১৯৬৪ সালের অক্টোবরে নিচতলায় শেখ হাসিনার ঘরে শেখ রাসেলের জন্ম। রাসেলের জন্মের সাথে সাথে বাড়িতে আনন্দের জোয়ার বয়। রাসেলের আগমনী বার্তায় শেখ হাসিনা, কামাল, জামাল, রেহানারা বাড়িতে আনন্দ উল্লাস করে। ভাই বোন আত্মীয় স্বজনদের সাথে এ বাড়িতে হয়েছে লুকোচুরি খেলা, হাসি, গল্প, আড্ডা, খুনসুটি। আত্মীয় স্বজনের সমাগম হলে মাটিতে ঢালাও বিছানা করা হতো আর বারান্দায় চুলা বসিয়ে রান্না হতো।

এ বাড়িতে যেমন রয়েছে পারিবারিক সুমধুর বন্ধনের ইতিহাস, তেমনি রয়েছে রাজনৈতিক, আন্দোলন, সংগ্রাম, বেদনাহত ও ইতিহাসের কলঙ্কজনক অধ্যায়ের ইতিহাস। ১৯৬১ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত এ বাড়িতে হয়েছে পাহাড়চুম্বী গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সভা। ১৯৬২ সালের আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে শেখ হাসিনার ফুপাত ভাই শেখ ফললুল হক মনি এ বাড়িতে থেকেই নির্দেশ ও পরামর্শ দিতেন। ১৯৬২ সালে এ বাড়ি থেকেই রাতে বঙ্গবন্ধু গ্রেপ্তার হয়ে প্রায় পাঁচ-ছয় মাস জেলে থাকেন।

ছাত্ররা গ্রেপ্তার হলে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের অনেক নেতা বাড়িতে গোপনে এসে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা নিতেন ও আলোচনা করতেন। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের আগে ১৯৬৪ সালে ঢাকায় হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা হলে বহু মানুষ এ বাড়িতে আশ্রয় নেন। ১৯৬৬ সালে ছয় দফা আন্দোলনের সভা, আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সভাও এ বাড়িতে হয়েছে।

নারায়ণগঞ্জে ছয় দফা দাবির বাস্তবায়নে জনসমাবেশ শেষে রাতে বঙ্গবন্ধু বাড়িতে ফেরেন। রাত দেড়টার দিকে তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। প্রত্যেক গ্রেপ্তারের সময়ই পরিবারের সদস্যরা চোখের পানি মুছে, বোবা কান্নায় বিদায় দিয়েছেন। সাথে দিয়েছেন কাপড় চোপড়, তামাকের কৌটা, কাগজ, কলম, বইপত্র ও প্রয়োজনীয় সামগ্রী।  

১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি জনগণের চাপে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্তি দিলে বাড়ির সামনে মানুষের ঢল নেমেছিল। এসব মানুষের ঢল বহমান ছিলো ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পর্যন্ত। দেশি-বিদেশি সাংবাদিকরাও এই বাড়িতে ভিড় করেছেন ’৭১-এর যুদ্ধকালীন সময়ে। ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের রূপরেখাটি বঙ্গবন্ধু এই বাড়ির কনফারেন্স টেবিলে বসেই তৈরি করেছিলেন।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাত সাড়ে ১২টায় লাইব্রেরি ঘরের দক্ষিণের দরজার পাশে টেলিফোন সেটের পাশে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু  স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। তা ওয়্যারলেসের মাধ্যমে চট্টগ্রাম পৌঁছে দেয়া হয়। এই খবর পাকিস্তান সেনাদের কাছে পৌঁছালে রাত দেড়টায় তারা বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে বাড়ি থেকে।

২৬ মার্চ আবার বাড়িতে সেনারা আক্রমণ চালালে দেয়াল টপকে পাশের বাসায় আশ্রয় নেন বঙ্গমাতা, রাসেল, জামাল ও কামাল। দীর্ঘ ৯ মাস যুদ্ধচলাকালে এ বাড়ি লুট হতে থাকে এবং ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীদের পরাজিত করে বাংলাদেশের বিজয় অর্জিত হয়।

স্বাধীনতাউত্তর যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে সোনার বাংলায় রূপ দিতে মরিয়া বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। স্বাধীনতা লাভের পর বঙ্গবন্ধু যখন স্বাধীন দেশের রাষ্ট্রপতি তখনো তিনি এই বাড়িটি থেকে রাষ্ট্রীয় কাজকর্ম পরিচালনা করতেন। তিনি বাংলার মানুষের দুঃখ-দুর্দশা লাঘবে যখন ব্যস্ত এমনই মুহূর্তে এক কলঙ্কজনক অধ্যায় সূচিত হয়।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করার মধ্য দিয়ে এখানেই ঘটেছে বাঙালি জাতির ইতিহাসের জঘন্যতম ঘটনা। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ধানমন্ডির এ বাড়িতে বঙ্গবন্ধু, তার পরিবারের সাতজন সদস্য, কর্নেল জামিল ও দেহরক্ষী ঘাতকের নির্মম বুলেটে নিহত হন। ঘাতকের বুলেট বঙ্গবন্ধুকে নিষ্প্রাণ করলেও তিনি রয়ে যাবেন প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে।

বঙ্গবন্ধু হত্যার পরে বাড়িটি সিলগালা করা হলে কেউ প্রবেশ করতে পারেনি। যার কারণে ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৮১-এর ১১ জুন পর্যন্ত এ বাড়ি বন্ধ ছিলো। ১৯৮১ সালে শেখ হাসিনা জেনারেল জিয়াউর রহমানকে বাড়িটি খুলে দিতে বললে তিনি তা খুলে দেননি। বাড়িতে প্রবেশের অনুমতি না পেয়ে রাস্তায় মিলাদ পড়া হয়েছিল।

পরে জিয়া সরকারের পক্ষ থেকে শেখ হাসিনাকে থাকার প্রস্তাব দিলেও শেখ হাসিনা একজন স্বৈরাচারের হাত থেকে কিছু নিতে অস্বীকার করেন। জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সাত্তারের নির্দেশে ১৯৮১ সালের ১২ জুন এই বাড়ির দরজা খুলে দেয়া হয়।

জঙ্গলে আচ্ছাদিত, বিধ্বস্ত, লণ্ডভণ্ড, রক্তামাখা, গুলিতে ঝাঁজরা, লুট করা বাড়িতে প্রবেশ করে শেষ হাসিনা নারকীয় পিশাচের হিংস্র উল্লাসের কথা স্মরণ করে কষ্টে ভেঙে পড়েন। মনকে মানিয়ে তিনি প্রতিদিন ছয় ঘণ্টা করে ছয়দিন কাজ করে চোখের পানিতে নিজ হাতে বাড়িটি পরিষ্কার করেন। ১৯৮৩ সালের ২১ জানুয়ারি শেখ হাসিনা বাড়ির চত্বরে দাঁড়িয়ে মার্শাল‘ল’র বিরোধিতা করেন।

১৯৮৭ সালে এরশাদ গৃহবন্দি করে রেখেছিল শেখ হাসিনাকে। এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের কর্মসূচি প্রণয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ এই বাড়িতেই নেয়া হয়েছে। শেখ হাসিনাকে ১৯৯০ সালের ২৭ নভেম্বর গ্রেপ্তার করে এই বাড়িতে আনা হলে ৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত এই বাড়িতে গৃহবন্দি থেকে রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করেন এবং ১৯৯১ সালের নির্বাচনের কাজ এ বাড়িতেই করা হয়।

তিলে তিলে গড়া স্মৃতিভরা ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িটি ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে তা আজ মিউজিয়াম হয়ে জনগণের সম্পদে পরিণত হয়েছে। ১৯৮১ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার কাছে বাড়িটি হস্তান্তর করা হয়। শেখ হাসিনা বাড়িটিকে জাদুঘরে রূপান্তরের জন্য বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্টের কাছে হস্তান্তর করেন।  বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্ট বাড়িটিকে জাদুঘরে রূপান্তরিত করে এবং নাম দেয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর। ১৯৯৪ সালের ১৪ আগস্ট জাদুঘরটি উদ্বোধন করা হয়।

ধানমন্ডি এলাকার লেকসার্কাসের পশ্চিম পাশে ধানমন্ডি লেকের পাড়ে এই জাদুঘরটির অবস্থান। মূল ভবনের পেছনে চারতলা ভবন নির্মাণ করা হয়েছে, তাতে একটি লাইব্রেরি ও অডিটোরিয়াম রয়েছে। বর্তমানে বঙ্গবন্ধুর এই বাড়ির নম্বর ১০, সড়ক নম্বর ১১, আগে ছিলো ৩২। সড়কের নামেই এ বাড়িটি পরিচিতি।

লেখক : সাংগঠনিক সম্পাদক, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টার্স ইউনিটি  

আমারসংবাদ/এসটি