Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪,

আমিরাত-ইসরাইল সম্পর্কের খোয়াবনামা ও ফালনামা

হাসান আল বান্না

সেপ্টেম্বর ১২, ২০২০, ০১:৩২ পিএম


আমিরাত-ইসরাইল সম্পর্কের খোয়াবনামা ও ফালনামা

ছোটবেলায় ঢাকায় স্কুলে যাওয়ার পথে প্রায়ই একটি কমন চিত্র দেখতাম, কোন কোন লোক রিকশায় অথবা সাইকেলে মাইক লাগিয়ে কিছু বই বিক্রি করতো যেমন, কি করিলে কি হয়? "খোয়াবনামা ও তার ফালনামা "

অর্থ্যাৎ স্বপ্ন ও তার ফলাফল। দেখতাম এমন ফালতু বইয়ের প্রতি লোকের গ্রাহকও আবার কম নয়। সাধারণত কম শিক্ষিত মানুষ এই বই কিনতো খুবই উৎসাহ ভরে। কালের আবর্তে মানুষ যখন শিক্ষার আলো পাচ্ছে এবং সচেতন হচ্ছে তখন এমন বই হারিয়ে যাচ্ছে। আজকের আলোচনায় আরব ইসরায়ইল সম্পর্কের মিথ্যা খোয়াব এবং তার ফলাফল নিয়ে আলোচনা করবো।

কিছুদিন আগে আরব আমিরাত এবং ইসরাইলের মধ্যে কূটনীতিক চুক্তি সম্পাদিত হয় এবং চুক্তির ২/১ দিনের মধ্যেই ইসরাইলের বিশেষ বিমান আরব আমিরাতে ল্যান্ডিং করে। ইসরাইলের বিমানকে উষ্ণ অভ্যর্থনায় স্বাগত জানায় আরব আমিরাত। এই চুক্তি পরবর্তী মুসলিম বিশ্বে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়।

যে চুক্তি মুসলিম বিশ্বের ইতিহাসে সেরা বিশ্বাসঘাতক চুক্তি হিসেবে বিবেচিত। তবে পৃথিবীর অনেক মুসলিম দেশ সুস্পষ্ট ভাবে জানিয়ে দেয় ইসরাইলের সাথে তারা কোনরূপ কূটনীতিক সম্পর্ক স্থাপন করবে না।

আরব আমিরাত-ইসরাইলের সাথে কূটনীতিক সন্ধি স্থাপন করার কারণ
ক. আধিপত্য বিস্তার : আরব বসন্তের পর মধ্য প্রাচ্যের শাসকদের ক্ষমতা হুমকির মুখে। অনেক আরব রাজাদের পতন ঘটেছে। ফলে  নিজেদের আধিপত্য সুসংহত করতেই এই পথ বেছে নেয় আরব আমিরাত। যদিও এই ভুল পথই হতে পারে আরব আমিরাতের অনিবার্য পতন।

খ. সৌদির প্ররোচণা : সৌদি বর্তমান প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান একজন পশ্চিমাপাচ্ছী ক্ষমতালোভী। সৌদির ক্ষমতা ধরে রাখতেই তিনি মরিয়া। কিন্তু প্রথমেই সৌদি ইসরাইল চুক্তি বেমানান দেখায় তাই প্রতিক্রিয়া বুঝতেই আমিরাত ইসরাইল চুক্তির পিছনে বড় ভূমিকা পালন করে সৌদি।

গ. ট্রাম্পের সফলতা : আজকের পৃথিবীতে আমেরিকা সুপার পাওয়ার। আর আমেরিকাকে নিয়ন্ত্রণ করে ইসরাইল। আমেরিকার বাণিজ্য এবং ক্ষমতার পালাবদল সবই হয় ইহুদীদের কর্তৃক। মূলত আগামী নির্বাচনে পূর্বে ট্রাম্প ইসরাইলের প্রতি কমিউটেড হতেই আরব আমিরাত-ইসরাইল চুক্তিতে ভূমিকা পালন করেন যা ট্রাম্পের সফলতা অর্জন। কেউ কেউ মনে করেন, আরব আমিরাত১-ইসরাইল চুক্তির ফলে আগামী নির্বাচনে ট্রাম্পের পুনরায় ক্ষমতায় আসা অনেকটাই সুনিশ্চিত।

মধ্যপ্রাচ্যে আরব আমিরাত-ইসরাইলের সম্পাদিত চুক্তির মাধ্যমে আরব আমিরাতের বর্তমান প্রিন্স মোহাম্মদ ইবনে জায়েদ যে বিশ্বাসঘাতকতার প্রমাণ দিয়েছে তার এই বিশ্বাস ঘাতকতার ইতিহাস নতুন নয়।

আরেকটি তথ্য দিলেই বুঝা যাবে তার বিশ্বাসঘাতকতার দলিল :

যখন আরব আমিরাত মরুভূমি ছিল, যখন আরব আমিরাতে ভাল কোন ডাক্তার ছিলনা তখন শেখ জায়েদের পুত্ররা অসুস্থ হয়ে পড়লে লিবিয়ার প্রেসিডেন্ট মুয়াম্মার গাদ্দাফি তার নিজের ব্যবহার করা বিমানটি আমিরাত পাঠিয়ে শেখ জায়েদ ও তার পুত্রদের লিবিয়াতে এনে সুুস্থ করে তুলেন। শেখ জায়েদের পুত্ররা বড় হলে গাদ্দাফি ও তার পুত্রদের হত্যা করার জন্য ন্যাটোর কাছে যুদ্ধ বিমান পাঠান। পরিশেষে ত্রীপলি থেকে আত্মগোপন যাওয়া গাদ্দাফি ও তার পুত্রদের বহনকারী গাড়ি বহরে ন্যাটোর বিমান হামলা চালায় এবং তারা মারা যান।

তবে বিশ্বাসঘাতকতা করে সবসময় পার পাওয়া যায় না। ফিলিস্তিন সারা বিশ্বের মুসলমানদের ও শান্তিকামী সকল মানুষের আবেগের জায়গা। ইসরাইল আমিরাত চুক্তি করে মজলুম ফিলিস্তিনের সাথে বেঈমানির খেশারত অপেক্ষা করছে আরব আমিরাতের জন্য।

১৯৪৮ সালের পূর্বে ইসরাইল নামক কোন রাষ্ট্রই পৃথিবীতে ছিলনা। বৃটেনের ষড়যন্ত্রে জাতিসংঘের মোড়কে ইসরাইল নামক এক ভূঁইফোড় সন্ত্রাসী রাষ্ট্রের জন্ম হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের কাছ থেকে ইহুদিরা মার খাওয়ার পর তারা পৃথিবীতে নাম পরিচয়হীন হয়ে যায়।

পরবর্তীতে ইসরাইল নামক অবৈধ রাষ্ট্রের জন্ম লাভের পর তারা সারা পৃথিবীতেই সন্ত্রাস কায়েম করে। বিশেষ করে ফিলিস্তিনের জনগণকে তাদের ভূমিহীন করে প্রতিনিয়ত তাদের উপর জঘন্য কায়দায় হামলা করে আসছে।

আর এসবের ফলে মুসলিম বিশ্ব ইসরাইলের সাথে কোনরূপ কূটনীতিক সন্ধি স্থাপনে আগ্রহী নয়। কিন্তু সকল জল্পনার অবসান ঘটিয়ে আরব আমিরাত ইসরাইলের সাথে চুক্তি করে মুসলিম বিশ্বের নিকট শতাব্দীর সেরা বিশ্বাসঘাতকতার প্রমাণ দিয়েছে।

মূলত পুরো আরব এবং ইউরোপের কিছু অংশ নিয়ে অটোম্যান সাম্রাজ্য ছিল। পশ্চিমা ষড়যন্ত্র ও নিজেদের আভ্যন্তরীণ দুর্বলতায় অটোম্যান সাম্রাজ্যের পতন ঘটে। বিশাল অটোম্যান সাম্রাজ্য হয়ে যায় বর্তমান তুরস্ক। এরমধ্যে ১৯২৩ সালে পশ্চিমাদের সাথে তুরষ্কের একশো বছরের জন্য একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। যার নাম ঐতিহাসিক লুজান চুক্তি। লুজান চুক্তির ফলে অটোম্যান সাম্রাজ্য শেষ হয়ে বর্তমান তুরস্কের জন্ম। আর তুরস্ক হয়ে যায় দুর্বল রাষ্ট্র।

আগামী ২০২৩ সালের পর লুজান চুক্তি শেষ হচ্ছে। ইতোমধ্যে পৃথিবীতে অন্যতম পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভাব ঘটেছে তুরস্কের। ফলে আরব দুনিয়ার গালফের রাজাদের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। লুজান চুক্তি শেষ হলে তাদের সাম্রাজ্যে থাকা মধ্যপ্রাচ্যের অনেক ভূমি এবং পবিত্র মক্বা মদীনা দখলে নিতে পারে তুরস্ক।

পাশাপাশি ইসরাইল-ফিলিস্তিনও নিজেদের রাজ্য হিসেবে দাবি করলেও করতে পারে। ফলে স্বভাবতই ইসরাইল-আরব আমিরাত এবং অন্যান্য আরবও ঐক্যবদ্ধ তুরষ্কের বিরুদ্ধে। যারই ফলাফল আরব আমিরাত-ইসরাইল চুক্তি। তবে এই চুক্তিই শেষ পর্যন্ত আরব আমিরাতের পতন ঘটায় কিনা তা দেখতে মাত্র কয়েকটা বছর অপেক্ষা করতে হবে।

একটু যোগ করতে চাই, বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয়েছে যখন থেকে তখন থেকেই বলিষ্টভাবে আন্তর্জাতিক সব চাপ অগ্রাহ্য করে বঙ্গবন্ধু ইজরাইলের দেওয়া স্বীকৃতি প্রত্যাখান করে বলেছিলেন, আমার ফিলিস্তিন স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত ইসরাইলের স্বীকৃতি প্রয়োজন নেই। পররাষ্ট্রনীতির এই নীতি আর কেউ কখনো চেঞ্জ করার সাহস করেনি। আর করবেও না ইনশাআল্লাহ।

লেখক: কথা সাহিত্যিক ও সাংবাদিক

আমারসংবাদ/এনএমএম/এআই