Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪,

জলবায়ু বিপর্যয়ে উদ্বিগ্ন বিশ্ব

রায়হান আহমেদ তপাদার

অক্টোবর ২৩, ২০২০, ০৮:০১ পিএম


জলবায়ু বিপর্যয়ে উদ্বিগ্ন বিশ্ব

বিশেষ কোনো দেশ বা জনগোষ্ঠী নয়, জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাবের মুখে পড়েছে সারা বিশ্বের মানুষ। বিশেষত গত ২০ বছরে এই প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছে এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা থেকে অ্যামেরিকা মহাদেশেও। আগামী দিনে বিশ্বের জন্য ভয়ঙ্কর জলবায়ু বিপর্যয়ের বিপদ আসছে। গ্রিনল্যান্ড ও অ্যান্টার্কটিকার বরফ অত্যন্ত দ্রুত হারে গলছে।

মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা জানিয়েছে, এরকম চলতে থাকলে ২১০০ সালের মধ্যেই সমুদ্রের জলস্তর উঠে আসতে পারে ৩৮ সেন্টিমিটার বা ১.২৫ ফুট। এর আগেও ‘ইন্টার-গভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ ২০১৯-এর স্পেশাল রিপোর্টে এই বিষয়ে দাবি করা হয়েছিল।

গবেষণা থেকে জানা যাচ্ছে, সমুদ্রের জলস্তর বৃদ্ধির মোট পরিমাণের এক-তৃতীয়াংশ বরফ গলে যাওয়ার জন্যই হচ্ছে। আইপিসিসির রিপোর্ট অনুযায়ী, কেবল গ্রিনল্যান্ডের বরফ গলার জন্য ২১০০-এর মধ্যে সমুদ্রের জলস্তর ৮ থেকে ২৭ সেন্টিমিটার বাড়বে। আর অ্যান্টার্কটিকার বরফ গলার জন্য জলস্তর বাড়তে পারে ৩ থেকে ২৮ সেন্টিমিটার।

তাদের মতে, বাতাসের তাপমাত্রা বাড়ার জন্যই মেরু অঞ্চলের বরফ গলছে। এছাড়া সমুদ্রের তাপমাত্রাও দ্রুত বাড়ছে। ফলে সমুদ্র সংলগ্ন হিমবাহগুলো গলছে। এ কারণগুলো আরও উদ্বেগের সৃষ্টি করছে। আর গ্রিনল্যান্ডের বরফ চাঙরগুলো ভাঙছে বলে উদ্বেগের মাত্রা আরও বাড়ছে।

বাফেলো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সোফি নোউইকি জানাচ্ছেন, আগামীদিনে সমুদ্রের জলস্তর কতটা বাড়বে তা নির্ভর করছে মেরু অঞ্চলের বরফ কত দ্রুত গলবে তার ওপর। তাই ভবিষ্যতের পরিস্থিতি খুবই উদ্বেগজনক।

এমনকি আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই ঘনিয়ে আসছে বড় বিপদ। আধুনিকায়নের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে উষ্ণ হচ্ছে পৃথিবী। পরিবর্তিত হচ্ছে জলবায়ু। কোনো এলাকা বা ভৌগোলিক অঞ্চলের ৩০-৩৫ বছরের গড় আবহাওয়াই হচ্ছে জলবায়ু। এই জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পৃথিবীর তাপমাত্রা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা বৈশ্বিক উষ্ণতা নামে অধিক পরিচিত।

বৈজ্ঞানিক ভাষায় একে ‘গ্রিনহাউস প্রভাব’ বলা হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের শুধু একটি কারণ নয়, অনেকগুলো কারণ বিদ্যমান। কার্বন-ডাই-অক্সাইড, মিথেন, ক্লোরোফ্লোরো কার্বনসহ বিষাক্ত গ্যাসের নিঃসরণ। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রধান কারণ, গ্রিনহাউস গ্যাস ও মানব সৃজিত কর্মকাণ্ড দ্বারা পরিবেশদূষণ।

যেমন— পারমাণবিক বিস্ফোরণ, শিল্পকারখানার বর্জ্য, কলকারখানা ও গাড়ি থেকে নির্গত কালো ধোঁয়া, বেশি বেশি ফসল পাওয়ার জন্য জমিতে সার ও কীটনাশক প্রয়োগ, গাছ কেটে সবুজ ধ্বংস, অপরিকল্পিত নগরায়ন, শিল্পকারখানা স্থাপন, ইটের ভাটা, জ্বালানি ইত্যাদি। পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে নানা প্রকারের দুর্যোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে।

যেমন— অতি বৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, আকস্মিক বন্যা, খরা, জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড় ইত্যাদি। ফলে জান ও মালের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। এ কারণে প্রতিবছর নষ্ট হচ্ছে কোটি কোটি টাকার সম্পদ। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে সৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সমগ্র বিশ্বের প্রাকৃতিক পরিবেশের ওপর মারাত্মক বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিচ্ছে। এই পরিবর্তনের ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উষ্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং আবহাওয়ার মৌসুমি ধারাবাহিকতা বিঘ্নিত হচ্ছে। বিশ্বজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে থাকা অন্যান্য বহু দেশের মতো বাংলাদেশও।

জলবায়ু পরিবর্তনের ব্যাপারটি কোনো সাহায্যের আবেদন নয়, এটা সতর্কতা। কারণ, অন্য অনেক দেশ জলবায়ু সংকটের কম ঝুঁকিতে থাকলেও তারা এর বিধ্বংসী শক্তি বেশিদিন এড়িয়ে যেতে পারবে না। আমার দেশের চেয়ে বেশি ভাগ্যবান দেশগুলোর ভালো করে দেখা উচিত আমরা কীসের সঙ্গে লড়ছি। গবেষণা অনুসারে, এই শতকের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে বাড়তে থাকা সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা লাখ লাখ মানুষকে নিচু উপকূলীয় শহরগুলো ছেড়ে যেতে বাধ্য করবে।

বৈশ্বিক সমপ্রদায় কি এই বিপর্যয় এড়ানোর জন্য যথাসময়ে পদক্ষেপ নেবে? আমাদের জলবায়ু সংকট ও কোভিড-১৯ বৈশ্বিক হুমকি। উভয়ই অননুমেয়, আমরা এগুলোর ঝুঁকি কমাতে আরও অনেক কিছু করতে পারতাম, করা উচিত ছিলো।

কিন্তু এখন সংকটগুলো আমাদের ধরে বসেছে। এখন এগুলো মোকাবিলায় আমাদের সবচেয়ে ভালো উপায়, নিশ্চিতভাবেই সমন্বিত আন্তর্জাতিক পদক্ষেপ। জলবায়ু সংকট ও করোনা মহামারি উভয়ই অনেক শাখা-প্রশাখাসংবলিত জটিল সমস্যা। সামগ্রিকভাবে এগুলোর না করলে, একেবারেই করা হবে না। করোনা মহামারি অন্যত্র বাড়তে দিয়ে, কেবল এক দেশের জন্য শতশত কোটি ডলার খরচ করে কোভিড-১৯-এর টিকা নিশ্চিত করা অহেতুক হবে।

একইভাবে, সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ তাদের কার্বন নির্গমন কমালে, আরও টেকসই অর্থনীতি গড়লেও কোনো লাভ হবে না, যদি বিশ্বের বড় কার্বন নির্গমনকারীরাও একই পদক্ষেপ না নেয়। বৈশ্বিক গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমনের ৮০ শতাংশের জন্য দায়ী জি-২০ সদস্য দেশগুলো।

নিচের দিকের ১০০ দেশগুলো থেকে নির্গমন হয় মাত্র ৩.৫ শতাংশ গ্যাস। সকলের একত্রিত পদক্ষেপ ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তন সফলভাবে মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। বৈশ্বিক উষ্ণতা নিয়ন্ত্রণ ও এর সবচেয়ে অনিষ্টকর প্রভাব সীমিত করার ক্ষেত্রে এখনো আমাদের সবচেয়ে বড় সম্ভাবনা হচ্ছে ২০১৫ প্যারিস জলবায়ু চুক্তি। এখন অবধি ১৮৯টি দেশ এই চুক্তির প্রতি সমর্থন জানিয়েছে এবং বৈশ্বিক উষ্ণতা দুই ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড থেকে কম রাখতে, শিল্প-পূর্ববর্তী পর্যায়ে নিতে ও সম্ভব হলে ১.৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে রাখার চেষ্টা করতে সামগ্রিকভাবে কার্বন নির্গমন কমানোর অঙ্গীকার করেছে।

সর্বশেষ, আরও উচ্চাকাঙ্ক্ষী একটি লক্ষ্যের প্রস্তাব উপস্থাপন করেছে ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরাম (সিভিএফ)-বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়বে বাংলাদেশসহ এমন ৪৮টি দেশের একটি সংস্থা, যেটির সভাপতি আমি। সিভিএফ সদস্য দেশগুলো জলবায়ুর সঙ্গে খাপ খাওয়ানো ও জলবায়ু পরিবর্তনের একেবারে সম্মুখভাগে রয়েছে।

দেশগুলো ঘূর্ণিঝড়ের বিরুদ্ধে শক্তিশালী আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি থেকে উপকূলীয় জনগোষ্ঠীকে রক্ষা করতে ম্যানগ্রোভ বনায়নের মতো পদক্ষেপের প্রচারণা চালাচ্ছে।

এই গুরুত্বপূর্ণ কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে এসব পদক্ষেপ ছড়িয়ে দিতে চলতি মাসে ঢাকায় একটি কার্যালয় খুলতে যাচ্ছে গ্লোবাল সেন্টার অন অ্যাডাপশন। বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্র ও জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলো আমাদের পক্ষের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছে।

এছাড়া সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট রিপোর্ট ২০২০ অনুসারে, আফ্রিকার ৪৩টি এবং এশিয়া ও লাতিন আমেরিকাজুড়ে আরও অনেক দেশ আমাদের জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় গৃহীত লক্ষ্য অর্জন করেছে। ধনী বিশ্ব তা করেনি। জলবায়ু অভিযোজনের জন্য যতটুকু প্রয়োজন, আন্তর্জাতিক অর্থায়নের পরিমাণ তার চেয়ে অনেক কম।

এছাড়া আরও বড় নেতৃত্ব, বিশ্বসেরা প্রযুক্তি, অগ্রণী গবেষণা, যেগুলো আজ অবধি বহু চমৎকার সমাধান দিয়েছে, সেগুলো ব্যতিত জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় নতুন, আরও উচ্চাকাঙ্ক্ষী পদক্ষেপ সফল হওয়ার সম্ভাবনা কম।

আমরা যদি প্রয়াস না বাড়াই, তাহলে সবাই হেরে যাবো। বিশ্বের যথাসম্ভব দেশ ও প্রতিষ্ঠানের উচিত নিম্ন-কার্বন সমাধান ও জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি কমানোর প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করা। আরও টেকসই, কার্যকর ও প্রতিযোগিতামূলক অর্থনীতি গড়ার সেরা উপায় এটি।

নিম্ন-কার্বন স্থিতিস্থাপক কোনো বিশ্বের বাণিজ্যিক সহযোগীর মাধ্যমে আমরা সবাই লাভবান হবো। নিশ্চিতভাবেই এর বিকল্প কেউ চায় না— ভঙ্গুর একটি বৈশ্বিক শৃঙ্খলা, যেখানে ধনী দেশগুলোও জলবায়ু পরিবর্তনের ধ্বংসাত্মক শক্তি দিয়ে জীর্ণ হয়ে পড়বে।

জলবায়ু সংকট, কোভিড-১৯ ও এর অর্থনৈতিক প্রভাব মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক নেতৃত্ব ও সহযোগিতা অপরিহার্য। এমন সময়ে বিশ্বের কোনো দেশেরই বাকি দেশগুলো থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়া উচিত নয়। পরবর্তী ‘ইউএন ক্লাইমেট চেঞ্জ কনফারেন্স অব দ্য পার্টিস’-এ দেশগুলোকে তাদের জাতীয় পরিসরে নির্ধারিত পদক্ষেপ বৃদ্ধির অঙ্গীকার করতে হবে এবং চূড়ান্তভাবে।

সামপ্রতিক সময়ে ২০২০ সালের মতো বিপর্যয় বোধহয় আর কোনো বছর দেখায়নি। দেশজুড়ে ছড়িয়েছে করোনা ভাইরাসের আতঙ্ক। সেইসঙ্গে নতুন উপদ্রব পঙ্গপাল।

এছাড়াও রয়েছে উত্তর-পূর্ব ভারতের বন্যা এবং হড়পা বান, উত্তর ও মধ্য ভারতের তাপপ্রবাহ, পশ্চিমবঙ্গ এবং ওড়িশায় হওয়া সুপারসাইক্লোন উমফান। প্রকৃতির তাণ্ডবলীলায় বিপর্যস্ত গোটা দেশ। এর মধ্যেই বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, এবছর গরমকালে যে হারে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে তাতে এটা বলাই যায় যে, ২০২০ সাল উষ্ণতম হতে চলেছে। ভাঙতে চলেছে তাপমাত্রার সমস্ত রেকর্ড।

২০২০ সালের শুরু থেকেই একদল আবহাওয়াবিদ ভারতের জলবায়ুর বিভিন্ন পরিবর্তন লক্ষ্য করেছেন এবং তা নিয়ে গবেষণা করেছেন। তাদেরও ধারণা যে ২০২০ সালই হতে চলেছে সামপ্রতিক সময়ের মধ্যে উষ্ণতম।

বিখ্যাত ব্রিটিশ দৈনিক ‘দ্য গার্ডিয়ান’-এর একটি রিপোর্টেও বলা হয়েছে, জলবায়ু গবেষকদের অনুমান, চার বছর আগে তাপমাত্রা বৃদ্ধির যে রেকর্ড হয়েছিল ২০২০ সালে সেটা ভেঙে যাওয়ার ৫০ থেকে ৭৫ শতাংশ সম্ভাবনা রয়েছে।  

এছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ওসানিক অ্যান্ড অ্যাটমোসফেরিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশনও তাদের ২০২০ গ্লোবাল অ্যানুয়াল টেম্পারেচার রযঙ্কিং আউটলুকে বলেছে যে, যেদিন থেকে এই তাপমাত্রার রেকর্ড পরিমাপ করা হচ্ছে ততদিনের রেকর্ড ভেঙে দেবে ২০২০ সালের তাপমাত্রা। অন্তত ৭৪ শতাংশ তেমনটাই সম্ভাবনা রয়েছে বলে দাবি বিশেষজ্ঞ মহলের।

লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট

আমারসংবাদ/এসটিএম