রায়হান আহমেদ তপাদার
আগস্ট ৩০, ২০১৭, ০৬:০৭ এএম
মিলনের সমন্বয়ের সমস্ত সুশৃঙ্খল ধারা ঔপনিবেশিক শক্তির করাল গ্রাসে অধঃপতিত হয়ে সর্বনাশের শেষ পর্যায়ে। উগ্র সাম্প্রদায়িকতা, অপসংস্কৃতির আগ্রাসন, অশুভ শক্তির কালো ছায়া সর্বোপরি সাম্রাজ্যবাদের বিষবাষ্পভ যেভাবে সারাদেশকে আক্রান্ত আর অসুস্থ করে রেখেছে সেই নির্মম শৃঙ্খল থেকে বের হওয়ার উদ্দীপ্ত প্রেরণাই নজরুলের সমাজ চেতনার অনবদ্য পর্যায়। আধুনিক বাংলা কাব্যে কাজী নজরুলই একমাত্র কবি, যিনি একই সঙ্গে হিন্দু ও মুসলমান উভয় ঐতিহ্যকে দক্ষতার সঙ্গে আত্মস্থ ও ব্যবহার করেছেন। ঐতিহাসিক ভাবে দেখলে হিন্দু মুসলিম বাঙালির ধর্মীয় আবদ্ধতা ও গোঁড়ামি এবং চিন্তা চেতনার সীমাবদ্ধতা ও নিশ্চলতার মধ্যে প্রায় এককভাবে জাগৃতিক বেগ ও ব্যাপকতা এনেছিলেন কবি নজরুল ইসলাম। গোটা বাঙালি জাতিকে তিনি জাগিয়ে দিতে চেয়েছিলেন ওই চেতনার প্রোজ্জ্বল শিখায়। তিনি কট্টর মুসলমানদের যেমন সমালোচনা করেছেন, তেমনি কুসংস্কারাচ্ছন্ন গোঁড়া হিন্দুদের প্রতি তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তিনি হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মিলনের অন্যতম বাধা হিসেবে হিন্দুদের ছোঁয়াছুঁয়ির বাছ বিচারকে দায়ী করেছেন। তিনি বলেছেন, এ আমি জোর করে বলতে পারি, এই ছোঁয়াছুঁয়ির উপসর্গটা যদি হিন্দু সমাজ থেকে উঠিয়ে দেওয়া যায়, তবে হিন্দু মুসলমানদের মিলন একদিন হবেই। নজরুল ইসলামের ধারণা, হিন্দু মুসলমান বিরোধের অন্যতম কারণ হিন্দুর ‘ছুৎমার্গ’। তাই তিনি ‘ছুৎমার্গ’ প্রবন্ধে লিখেছেন, হিন্দু হিন্দুই থাক, মুসলমান মুসলমানই থাক, শুধু একবার মহাগগন তলের সীমাহারা মুক্তির মাঝে দাঁড়াইয়া মানব তোমার কণ্ঠের সেই সৃষ্টির আদিম বাণী ফুটাইয়া বল দেখি, আমার ধর্ম মানুষ। অপরদিকে ঔপনিবেশিক শাসনের তীব্র পেষণ, বিবদমান রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর চরম অস্থিরতা, বঙ্গভঙ্গ আর স্বদেশি আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে গড়ে ওঠা সাম্প্রদায়িক দাবানল, সাংস্কৃতিক আগ্রাসনে প্রতিপক্ষ শক্তির দাপট সব মিলিয়ে সমকালীন অঙ্গন বিক্ষুব্ধ, সাংঘর্ষিক এবং হিংসায় উন্মত্ত। তার ওপর আছে ১৯১৪ সালে শুরু হওয়া প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আরম্ভ আর পরিণতির এক ভয়াবহ অধ্যায়। বিদ্রোহী কবি নজরুল শুধু সমকালীন অঙ্গনের উত্তপ্ততায় অস্থির ছিলেন না, পাশা-পাশি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যোগ দেয়া সম্মুখ সমরের এক লড়াকু সৈনিকও বটে। ফলে তাঁর সৃষ্টির দ্যোতনা তাড়িত হয় সময়ের বিক্ষুব্ধ আবহে। তবুও ঠাণ্ডা মাথায়, সুচিন্তিত অভিমতে অন্তর্নিহিত তাগিদে যে গদ্য সাহিত্য আপামর বাঙালিকে উপহার দেন তা যেমন অনবদ্য, একইভাবে প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থারও এক জীবন্ত প্রতিবেদন। সামাজিক প্রতিকূলতার সঙ্গে ব্যক্তিক অস্থিরতার গ্রন্থি বন্ধন তারই সুসংবদ্ধ রূপ কবির ‘দুর্দিনের যাত্রী’। যা ১৯২৬ সালে সংক্ষিপ্ত পুস্তকাকারে প্রকাশ হয়। ক্ষুদ্র এই বইটি মূলত ‘ধূমকেতু’ পত্রিকায় লিখিত কবির কয়েকটি সম্পাদকীয় নিয়ে গ্রথিত হয়। প্রতিটি প্রবন্ধে আছে তারুণ্যের জয়গান। দৃপ্তচিত্তে সামনে এগিয়ে যাবার নবসৃষ্টির আহ্বান। অভিশপ্ত সমাজের সমস্ত জঞ্জালকে নির্মূল করে নতুন ঠিকানায় আশীর্বাদকে বরণ করে নেয়ার করুণ আর্তি। বিংশ শতাব্দীর বিশের দশকের উন্মাদনা যেমন সমাজের প্রতিটি পর্যায়ে প্রভাব বিস্তার করে সেখান থেকে নতুন জোয়ারে অন্য রকম এক মাঙ্গলিক সৃষ্টির বার্তাও গণমানুষকে আলোড়িত করে। নতুন শক্তি আর নবোদ্যমে অন্ধকারের বিস্তীর্ণ প্রলয় থেকে মুক্ত হয়ে রৌদ্র দগ্ধ তপ্ত দিবালোকে প্রবেশের উদাত্ত আহ্বান বিদ্রোহী কবির। একইভাবে ধর্ম সংক্রান্ত ইব্রাহিম খাঁর চিঠির জবাবে নজরুল বলেছেন, যাঁরা মনে করেন আমি ইসলামের বিরুদ্ধবাদী বা তার সত্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছি, তাঁরা অনর্থক এ ভুল করেন। ইসলামের নামে যেসব কুসংস্কার মিথ্যা আবর্জনা স্তূপীকৃত হয়ে উঠেছে তাকে ইসলাম বলে না মানাটা কী ইসলামের বিরুদ্ধে অভিযান? এ ভুল যাঁরা করেন, তাঁরা যেন আমার লেখাগুলো মন দিয়ে পড়েন দয়া করে, এ ছাড়া আমার আর কী বলবার থাকতে পারে। ১৯২৭ সালে অধ্যক্ষ ইব্রাহিম খাঁ-কে লেখা চিঠিতে কবি নজরুল লিখেছেন, হিন্দু মুসলমানের পরস্পর অশ্রদ্ধা দূর করতে না পারলে যে এ পোড়া দেশের কিচ্ছু হবে না, এ আমিও জানি। এবং আমিও জানি যে, একমাত্র সাহিত্যের ভেতর দিয়েই এ অশ্রদ্ধা দূর হতে পারে। তাই তিনি সাহিত্যের ভেতর দিয়েই সাম্প্রদায়িক বিভেদ দূর করার চেষ্টা চালিয়েছেন। গোঁড়া, পরশ্রীকাতর ও কট্টরপন্থি হিন্দুবাদীরাও তাকে নানাভাবে আক্রমণ করেছে। কিন্তু সাম্প্রদায়িক মুসলমান ও হিন্দুদের এই আক্রোশ নজরুলের চিন্তার স্বচ্ছতা, ভাবনার প্রগতিশীলতা ও সমন্বিত সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের দীপ্রতাকে ম্লান করতে পারেনি। এ ব্যাপারে নজরুল বলেছেন, এরা কী মনে করেন হিন্দু দেবদেবীর নাম নিলেই সে কাফের হয়ে যাবে? তাহলে মুসলমান কবি দিয়ে বাংলা সাহিত্য স্রষ্টি কোনোকালেই সম্ভব হবে না, জৈগুন বিবির পুঁথি ছাড়া। বাংলা সাহিত্য হিন্দু মুসলমান উভয়েরই সাহিত্য। এতে হিন্দু দেবদেবীর নাম দেখলে মুসলমানের রাগ করা যেমন অন্যায়, হিন্দুরাও তেমনি মুসলমানের দৈনন্দিন জীবন যাপনের মধ্যে নিত্য প্রচলিত মুসলমানী শব্দ তাদের লিখিত সাহিত্যে দেখে ভ্রু কুঁচকানো অন্যায়। অন্যদিকে সাম্প্রদায়িক ও ধর্মীয় সংকীর্ণতা তাকে কখনই স্পর্শ করতে পারেনি। তাই তো তিনি প্রমীলা দেবীর সঙ্গে প্রণয়াবদ্ধ হতে পেরেছিলেন। বিয়ের পরও প্রমীলার ধর্মীয় স্বাধীনতা অক্ষুণ্ন রেখেছেন। চার ছেলেরই নাম রেখেছেন অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মীয় গোঁড়ামির ঊর্ধ্বে উঠে প্রগতি, ধর্মনিরপেক্ষ ও সমন্বয়ের চেতনা থেকে। তাই তো কবি বলেছেন, গাহি সাম্যের গান, যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা ব্যবধান, যেখানে মিশেছে হিন্দু বৌদ্ধ মুসলিম ক্রীশ্চান। নজরুল ইসলামের এই চেতনা রেনেসাঁসের চেতনা। বঙ্গদেশে যে অপূর্ণ রেনেসাঁসের উদ্ভব হয়েছিল নজরুলের কাব্য সাধনার এই ধারায় তা আরো কিছুটা পূর্ণতাপ্রাপ্ত হয়। ১৯২৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর কলকাতার অ্যালবার্ট হলে বাংলার হিন্দু মুসলমানের পক্ষ থেকে দেওয়া সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে মনুষত্বের সত্যকে তুলে ধরতে গিয়ে নজরুল হিন্দু মুসলমানের ঐক্য কামনা করে বলেছেন, কেউ বলেন, আমার বাণী যবন, কেউ বলেন, কাফের। আমি বলি ও দুটোর কিছুই নয়। আমি শুধুমাত্র হিন্দু মুসলিমকে এক জায়গায় ধরে নিয়ে হ্যান্ডশেক করাবার চেষ্টা করেছি, গালাগালিকে গলাগলিতে পরিণত করার চেষ্টা করেছি। নজরুল, মুসলিম ও হিন্দু উভয় ধর্মের ওপর পড়াশোনা করেছেন। হিন্দু মুসলমান সমস্যা নিয়ে রবীন্দ্রনাথের কিছু যৌক্তিক অভিমত নজরুলকেও তাড়িত করে। মানুষের ভেতরের পশুশক্তি ধর্মের নামে মানুষকে এমন নৃশংস হতে প্ররোচিত করে যা তার শুভশক্তির একেবারে বিপরীত মেরুতে। দুই প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তিকে মেলা তো দূরের কথা একটাকে (পশুশক্তি) একেবারে ছেঁটে ফেলতে না পারলে মানুষ তার পূর্ণ মর্যাদায় দাঁড়াতেও পারবে না। কবি নজরুলের চিন্তা চেতনা এমন ছিল; সমাজের সুস্থ, স্বাভাবিক পরিবেশে মানুষে মানুষে যখন কোন প্রাচীর তৈরি হবে না, অবাধ আর স্বাচ্ছন্দ্য মেলামেশার ভেতরের গহীন অন্ধকার অপসৃত হয়ে যাবে আপন মর্যাদায় নিজেরা যখন এক ও অভিন্ন ধারায় সম্পৃক্ত হবে তখন শুভশক্তি তার সর্বাত্মক প্রচেষ্টায় কল্যাণ আর মঙ্গলকে আবাহন করবে। এভাবে নজরুল মানবতার জয়গান গেয়ে তার সৃজন ভা-ারকে সমৃদ্ধ করেছেন। মানুষের মঙ্গল আর মুক্তির জন্য জীবনভর লড়াই সংগ্রামে যুক্ত হয়েছেন। মানুষের সঙ্গে মানুষের আকাশচুম্বী ফারাককে নিজের অন্তর্নিহিত বোধ আর শক্তি দিয়ে অবদমনের প্রয়াস চালিয়েছেন। বিশেষ করে বৃহৎ দুই ধর্ম হিন্দু আর মুসলমানের মিলিত সম্প্রীতি ছাড়া স্বাধীনতা অর্জন হলেও, ব্রিটিশরা এদেশ ছেড়ে গেলেও সর্বমানুষের সার্বিক মুক্তি আর কল্যাণ কখনও যথার্থ জায়গায় পৌঁছাতে পারবে না। মানুষ হিসেবে মানুষের পাশে দাঁড়াতে না পারলে, বিপদ আপদে সহযোগী শক্তির ভূমিকায় নিজেকে প্রমাণিত না করলে সমাজ, সভ্যতার গতি রুদ্ধ হবে, একটি স্বাস্থ্যকর, কল্যাণমুখী পরিবেশ সুদূর পরাহত হবে। তিনি বলেছিলেন, দেখিব, দশ দিকে সার্বভৌম সাড়ার স্পন্দন কাঁপিয়া উঠিতেছে। মানবতার এই মহাযুগে একবার গন্ডি কাটিয়া বাহির হইয়া আসিয়া বল যে, তুমি মানুষ, তুমি সত্য। এবং নিজের যাপিত সময়ের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় ও রাষ্ট্রিক যন্ত্রণাকে সৃষ্টিকর্মের মধ্যে অঙ্গীভূত করে, নজরুল হয়ে উঠেছিলেন একটি স্বাধীন দেশ, জাতি ও জীবনের রূপকার। তাই তিনি ব্যক্তি হয়েও সমষ্টির। নজরুল সমকালের হয়েও মহাকালের।
লেখক ও কলামিস্ট