Amar Sangbad
ঢাকা রবিবার, ০৬ জুলাই, ২০২৫,

বৃদ্ধাশ্রম হোক সন্তানের ঘর

রায়হান আহমেদ তপাদার

ডিসেম্বর ২৭, ২০১৭, ১০:১৮ পিএম


বৃদ্ধাশ্রম হোক সন্তানের ঘর

সমাজের একটি প্রচলিত প্রবাদবাক্য, যদি কিছু শিখতে চাও, তিন মাথার কাছে যাও। আর তা হচ্ছে আমাদের প্রবীণরা, আমাদের শেকড়। দুঃখজনক হলেও সত্য, সমাজের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে আমরা সে শেকড়টি যেন উপড়ে ফেলছি। প্রবীণরা আমাদের অনেকের কাছেই স্রেফ বুড়া- বুড়ি। বাংলাদেশে ষাট বছরের বেশি বয়সী মানুষের সংখ্যা বেড়েই চলছে, অধিকাংশই মহিলা তথা জননী যার পদতলেই সন্তানের স্বর্গ। বাস্তবে এসব জননীকুলের অনেকের অবস্থা খুবই অসহায়, সন্তান পরিত্যক্তা জননী। আমাদের বহুমুখী কর্মব্যস্ততায় পারস্পরিক দায়বদ্ধতা লোপ পাচ্ছে, আর মা-বাবা তথা প্রিয়জনের প্রতি বাড়ছে উপেক্ষা।
আজ যারা বৃদ্ধ তারা নিজেদের জীবনের সবটুকু সময়, ধনসম্পদ বিনিয়োগ করেছিলেন সন্তানের জন্য, নিজের জন্য রাখেননি কিছুই। কিন্তু বৃদ্ধ বয়সে সন্তানের কাছ থেকে এর একটি ক্ষুদ্র অংশও তারা পাচ্ছেন না। কখনো দেখা যায়, সন্তান তার নিজের পরিবারের খরচ জোগাতে হিমশিম খাচ্ছে, তাই বাবা- মাকে মনে করছে বোঝা। নিজে স্ত্রী- সন্তান নিয়ে একটু ভালো থাকার জন্য বাবা- মার ঠাঁই করে দিয়েছেন বৃদ্ধাশ্রমে। আবার এমনো দেখা যায়, সন্তানের টাকা- পয়সার অভাব নেই, কিন্তু বাবা- মাকে নিজের কাছে রাখার প্রয়োজন বোধ করছে না, বা বোঝা মনে করছে। হয় নিজেই পাঠিয়ে দিচ্ছে বৃদ্ধাশ্রমে, নয়তো অবহেলা ও দুর্ব্যবহার করে এমন অবস্থার সৃষ্টি করছে- যেন তাদের বাবা- মা নিজেরাই সরে যান তার সাধের পরিবার থেকে। বৃদ্ধাশ্রম থেকে এক মায়ের ভাষা; খোকা, ভালো আছিস নিশ্চয়! তোকে এভাবে লিখব, অমন সাহস করিনি কখনো। কিন্তু কেন জানি আজ মুখ ফেরাতে পারছি না। প্রতিক্ষণ মনে পড়ছে তোকে। জানি, বিরক্ত হবি। তবুও একটু সাবধানের জন্যই সাহস করে লিখতে চাইছি। খোকা জানিস, কাল রাতে তোকে নিয়ে বাজে একটি খোয়াব দেখেছি। অমন সর্বনাশা খোয়াব দেখার পর কেমন আছিস, খুব জানতে ইচ্ছে করছে। তুই আমাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে যাওয়ার পর, নিত্যরাতে তোর ছবিটি বুকে নিয়ে ঘুমাই। আমার বুকের ধন তো এটিই, তাই না?
মা হয়ে কেউ ছেলের ছবি অন্য কোথাও রাখতে পারে, বল? এটি আমার কথা নয়, বৃদ্ধাশ্রমে থাকা এক মায়ের আর্তনাদ। আমাদের মনে রাখতে হবে, এখন যারা বৃদ্ধ তারা নিজেদের জীবনের সব সময়, ধন-সম্পদ বিনিয়োগ করেছিলেন সন্তানের জন্য, নিজের জন্য রাখেননি কিছুই। কিন্তু বৃদ্ধ বয়সে সন্তানের কাছ থেকে এর একটি ক্ষুদ্র অংশও তারা পাচ্ছেন না। পৃথিবীর প্রথম বৃদ্ধাশ্রম প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল প্রাচীন চীনে। ঘর ছাড়া অসহায় বৃদ্ধ- বৃদ্ধাদের জন্য আশ্রয় কেন্দ্রের এই উদ্যোগ ছিল শান রাজ বংশের। খ্রিষ্টপূর্ব ২২০০ শতকে পরিবার থেকে বিতাড়িত বৃদ্ধদের জন্য আলাদা এই আশ্রয়কেন্দ্র তৈরি করে ইতিহাসে আলাদা জায়গাই দখল করে নিয়েছে এই শান রাজ বংশ। পৃথিবীর প্রথম প্রতিষ্ঠিত সেই বৃদ্ধাশ্রমে ছিল বৃদ্ধ- বৃদ্ধাদের আরাম- আয়েশের সব রকম ব্যবস্থাই। ছিল খাদ্য ও বিনোদন ব্যবস্থা। কিন্তু এখন বিষয়টি এমন হয়েছে যে, একবার বাবা- মাকে বৃদ্ধনিবাসে পাঠাতে পারলেই যেন সকল দায়মুক্তি। এভাবে নানা অজুহাতে পিতা- মাতাকে দূরে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। অনেক নামিদামি বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, শিক্ষক, চাকরিজীবী যারা এক সময় খুব বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী ছিলেন, বৃদ্ধ বয়সে এসে নিজের সন্তানের দ্বারাই অবহেলা ও বঞ্চনার শিকার হয়ে বৃদ্ধাশ্রমের স্থায়ী বাসিন্দা হতে বাধ্য হচ্ছেন। অনেক সন্তান বা আত্মীয়স্বজন আর তাদের কোনো খবরও নেন না। তাদের দেখতে আসেন না। এমনকি প্রয়োজনীয় টাকা পয়সা বা জিনিসপত্রও পাঠান না। বাড়িতে কোনো অনুষ্ঠানে বা ঈদের আনন্দের সময়ও পিতা- মাতাকে বাড়িতে নেন না। এমনও শোনা যায়, অনেকে পিতা বা মাতার মৃত্যুশয্যায় বা মারা যাওয়ার পরও শেষবার দেখতে যান না। বৃদ্ধাশ্রম অবহেলিত বৃদ্ধদের জন্য শেষ আশ্রয়। তাদের সারা জীবনের অবদানের যথার্থ স্বীকৃতি, শেষ সময়ের সম্মান ও নিরাপত্তা দেওয়া হয় এসব বৃদ্ধাশ্রমে। এখানে তারা নির্ভাবনায়, সম্মানের সঙ্গে, আনন্দের সঙ্গে বাকি দিনগুলো কাটাতে পারেন। প্রয়োজনে অনেক বৃদ্ধাশ্রমে চিকিৎসারও সুন্দর ব্যবস্থা করা আছে। কিন্তু সব প্রাপ্তির মাঝেও এখানে যা পাওয়া যায় না তা হলো নিজের পরিবারের সান্নিধ্য। বৃদ্ধ বয়সে মানুষ তার সন্তান, নাতি- নাতনিদের সঙ্গে একত্রে থাকতে চান। তাদের সঙ্গে জীবনের আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে চান। সারা জীবনের কর্মব্যস্ত সময়ের পর অবসরে তাদের একমাত্র অবলম্বন এই আনন্দটুকুই। বলা যায়, এর জন্যই মানুষ সারা জীবন অপেক্ষা করে থাকে। বৃদ্ধাশ্রমে আশ্রয় পাওয়া যায়, সঙ্গী সাথীও পাওয়া যায়, বিনোদন পাওয়া যায়, কিন্তু শেষ জীবনের এই পরম আরাধ্য আনন্দটুকু পাওয়া যায় না যার জন্য তারা এই সময়টাতে প্রবল মানসিক যন্ত্রণা আর ভারাক্রান্ত হৃদয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে ওঠেন। তাছাড়া বিভিন্ন উৎসবে, যেমন ঈদের দিনেও যখন তারা তাদের সন্তানদের কাছে পান না, সন্তানের কাছ থেকে একটি ফোনও পান না, তখন অনেকেই নীরবে অশ্রুপাত করেন আর দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন। বাংলাদেশের অধিকাংশ প্রবীণ সাধারণ পরিবারে বসবাস করেন এবং তাদের ভরণপোষণ, চিকিৎসা ইত্যাদির ভার সন্তানদের ওপর বর্তায়। কিন্তু বর্তমানে সামাজিক, মানসিক ও অর্থনৈতিক নানা পরিবর্তনের কারণে যৌথ পরিবারে ভাঙন দেখা দিয়েছে। এতে করে প্রবীণরা তাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধিকার অর্থাৎ আশ্রয় ও বাসস্থান হারাচ্ছেন। এক জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশের শতকরা ৮৮ ভাগ প্রবীণেরই কোনো না কোনো সন্তান বাইরে থাকে। অর্থাৎ এদের সঙ্গে পিতা মাতার যোগাযোগ খুব কম হয়। এতে করে বৃদ্ধ পিতা মাতারা আর্থ সামাজিক সমস্যায় ভোগেন। বাংলাদেশে শতকরা ২০ জন হয় একাকী থাকেন অথবা স্বামী- স্ত্রী একসঙ্গে থাকেন। বর্তমান সরকার প্রবীণদের জন্য বয়স্ক ভাতা চালু করেছে। এ কার্যক্রমের আওতায় ১৭ লাখ দরিদ্র প্রবীণ সাহায্য পাচ্ছে। এছাড়াও সহায়- সম্বলহীন প্রবীণদের জন্য সরকার ৬টি বিভাগে ৬টি বৃদ্ধাশ্রম প্রতিষ্ঠা করেছে। বেসরকারি পর্যায়ে বৃদ্ধাশ্রম চালু করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। আমরা মনে করি, আজ যিনি সন্তান, তিনিই আগামী দিনের পিতা কিংবা মা। বৃদ্ধ বয়সে এসে মা- বাবারা যেহেতু শিশুদের মতো কোমলমতি হয়ে যায়, তাই তাদের জন্য সুন্দর জীবনযাত্রার পরিবেশ তৈরি করাই সন্তানের কর্তব্য। আর যেন কখনো কোনো পিতা- মাতার ঠিকানা বৃদ্ধাশ্রম না হয়, সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। উল্লেখ্য যে বাবা মা একসময় নিজে না খেয়ে সন্তানকে মুখে তুলে খাইয়ে দিতেন, তারা আজ কোথায়, কেমন আছেন, সেই খবর নেয়ার সময় যার নেই, তার নিজের সন্তানও হয়তো একদিন তার সঙ্গে এমনই আচরণ করবে। আমাদের মনে রাখা উচিত আজ যিনি সন্তান, তিনিই আগামী দিনের পিতা কিংবা মা। বৃদ্ধ বয়সে এসে মা বাবারা যেহেতু শিশুদের মতো কোমলমতি হয়ে যায়, তাই তাদের জন্য সুন্দর জীবনযাত্রার পরিবেশ তৈরি করাই সন্তানের কর্তব্য। কোনো পিতা মাতার ঠিকানা বৃদ্ধাশ্রম যাতে না হয়, সে ব্যাপারে আমাদের দায়িত্বশীল ও আন্তরিক হতে হবে। প্রত্যেক বাবা মা’র জন্য তৈরি করতে হবে একটি নিরাপদ ও সুন্দর পৃথিবী। অসহায় মা বাবাকে অবজ্ঞা করা উচিত নয়, কারণ মানুষ মাত্রই জীবনের কোনো না কোনো সময় অসহায়ত্বের স্বীকার হতে হবে। আপনারও ছেলে আছে, কিংবা আপনি এখন বিয়ে করেছেন আপনারও ছেলে হবে, সে যে আপনাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসবে না সেটার কী কোনো নিশ্চয়তা আছে? দুনিয়ার সব মা- বাবার জন্যে শুভ কামনা, কোনো মা বাবার স্থান যেন বৃদ্ধাশ্রম না হয়। বৃদ্ধাশ্রম হয় যেন সন্তানের ঘরে এই কামনাই করি।