Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ১৫ আগস্ট, ২০২৫,

সংবাদ ও সংবাদপত্র’র অজানা কিছু কথা

প্রিন্ট সংস্করণ॥জিয়া উল ইসলাম

ফেব্রুয়ারি ১২, ২০১৮, ০৬:৫৮ এএম


সংবাদ ও সংবাদপত্র’র অজানা কিছু কথা

চতুর্দশ শতাব্দীতে নিউ শব্দের বহুবচন হিসেবে নিউজ বা সংবাদ শব্দটি বিশেষভাবে ব্যবহার করা হতো। মধ্যযুগীয় ইংরেজি হিসেবে নিউজ শব্দটির সমার্থক ছিল নিউইজ ফরাসি শব্দ নোভেলেজ এবং জার্মান শব্দ নিউয়ে এবং লোকমুখে ‘নিউজ’ শব্দটিকে বিশ্লেষণ করা হয় এ ভাবে এন (নর্থ), ই (ইস্ট), ডব্লিউ (ওয়েস্ট) এবং এস (সাউথ)। একটি সংবাদপত্র সাধারণত চারটি মানদ- পূরণ করে ১) প্রচার: এর বিষয়বস্তু জনসাধারণের জন্য যুক্তিসঙ্গতভাবে প্রবেশযোগ্য। ২) পর্যায়বৃত্তি: এটি নির্দিস্ট সময় অন্তর নিয়মিতভাবে প্রকাশিত হয়। ৩) প্রচলন: এটির তথ্য প্রকাশনার সময়সূচি হিসেবে হালনাগাদকৃত থাকবে। ৪) সার্বজনীনতা: বিষয়ের একটি পরিসীমা এটি কভার করবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ঐতিহ্যগতভাবেই অধিকাংশ বৃহৎ শহরে সকাল এবং বিকালে সংবাদপত্র প্রকাশিত হতো। প্রচারমাধ্যমের সম্প্রসারণ এবং সংবাদের ক্ষেত্র অসম্ভবরকমভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় অধিকাংশ বিকালের সংবাদপত্রের প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায়। মূলত: সংবাদের গুণগত মান ও দৃষ্টিভঙ্গিই এতে সম্পৃক্ত। সাধারণত: সংবাদ ৫টি ডব্লিউ’র ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয়। হু, হুয়াট, হোয়েন, হোয়ার, হুয়াই ছাড়াও আরও একটি ডব্লিউ (হাউ) রয়েছে। এগুলোকে ভিত্তিমূল হিসেবে ধরে যে-কোনো বিষয় বা ঘটনা নিয়ে সংবাদ তৈরি করা সম্ভব। এ শব্দগুলোর মাধ্যমে সংবাদ অনুসন্ধান কার্যক্রমের পর আর কোনো প্রশ্ন বাকী থাকে না। প্রথম পৃষ্ঠায় সাধারণত: গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ উপস্থাপন ও তথ্য পরিবেশনকে সবিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়। এর ফলে ব্যস্ত পাঠকেরা স্বল্প সময়ের মধ্যেই তাদের অভিষ্ট সংবাদের বিষয়বস্তু সম্পর্কে জেনে যায়।
ইতিহাস:-
সপ্তদশ শতকের শুরুর দিকে সংবাদপত্রের সূচনা ঘটে। এর পূর্বে সংক্ষিপ্ত সরকারি ঘোষণা বা ইস্তেহার এবং রাজার আজ্ঞা প্রধান প্রধান নগরগুলোতে প্রকাশিত হতো। প্রথম লিখিতভাবে সংবাদ বা খবরের ব্যবহার মিশরে সু-সংগঠিতভাবে প্রবর্তন হয়েছিল। খ্রিস্ট-পূর্ব ২৪০০ বছর পূর্বে ফারাও শাসন আমলে বর্তমানকালের জনপ্রিয় সংবাদ মাধ্যম কুরিয়ার সার্ভিসের আদলে রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রসারণের উদ্দেশ্যে ডিক্রি বা আদেশনামা প্রচারের ব্যবস্থা করা হতো। প্রাচীন রোমের এক্টা ডিওরনা বা সরকারের তরফে জুলিয়াস সিজার কর্তৃক ঘোষিত ইস্তেহার জনগণের উদ্দেশ্যে তৈরি করতেন। এগুলো ধাতব পদার্থ অথবা পাথরের সাহায্যে জনগণের সম্মুখে প্রচার করা হতো। চীনের সরকারশাসিত প্রথমদিককার সময়ে সংবাদ শিট আকৃতিতে তৈরি করা হতো। এটি টিপাও নামে পরিচিত ছিল। দ্বিতীয় ও তৃতীয় শতাব্দীতে হ্যান রাজবংশের শেষদিককার সময়কালে আদালতের জন্য প্রচারের ব্যবস্থা করা হতো। ৭১৩ থেকে ৭৩৪ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে ত্যাং রাজবংশের আমলে কাইয়ুয়ান ঝা বাও রাজকীয় দৈনিক পত্রিকা (আদালতের ইস্তেহার) নামে সরকারিভাবে সংবাদ প্রকাশ করা হয়েছিল। এটি সিল্কের উপর হস্তলিখিত ছিল। সরকারি কর্মীরাই এটি প্রচারের উদ্দেশ্যে পড়ার জন্য অনুমতিপ্রাপ্ত ছিল। ১৫৮২ সালে মিং রাজত্বকালের শেষদিকে ব্যক্তিগতভাবে সংবাদ প্রকাশের প্রথম তথ্যসূত্র প্রয়োগের উল্লেখ করা হয়। আধুনিক ইউরোপের শুরুর দিকে আন্ত:সীমান্ত এলাকায় পারস্পরিক সম্পর্ক বৃদ্ধিকল্পে তথ্য বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে হস্তলিখিত সংবাদের কাগজ ব্যবহার করা হয়েছিল। ১৫৫৬ সালে ভেনিস প্রজাতন্ত্রীয় সরকার প্রথমবারের মতো মাসিক নটিজি স্ক্রিট প্রকাশ করে। এর মূল্য ছিল এক গেজেটা। মুসলমান রাজত্বকালে ভারতবর্ষে সংবাদপত্রের প্রচলন ছিল। অবশ্য তখন সংবাদপত্র মুদ্রিত হত না, সমস্ত রাজনৈতিক বিষয়ক সংবাদ হাতে লেখা হত এবং তা দেশের রাজকর্মচারীর নিকট প্রেরিত হত। সমস্ত বিভিন্ন বিভিন্ন প্রদেশের সংবাদ একত্র করে সম্রাটের কাছে যেত। এরূপ সংবাদ সংগ্রহের জন্য আলাদা বিভাগ ছিল।
কানুন এ-জং নামক প্রাচীন পারস্য গ্রন্থে লেখা আছে যে, পানিপথের প্রথম যুদ্ধে (১৫২৬ খ্রি:) বাবর শাহ শিবিরে বসে সংবাদপত্র পাঠ করছিলেন এমন সময়ে হিন্দু রাজারা এসে সন্ধির প্রস্তাব করেন। আবুল ফজল আইন-ই-আকবরী গ্রন্থে লিখেছেন, সম্রাট আকবরের সময় প্রতি মাসে গভর্নমেন্ট গেজেটের মত রাজকীয় সমাচারপত্র প্রচলিত ছিল। শাজাহান আগ্রার মহরম দরবারে বলেছিলেন, “এলাহাবাদের হিন্দু রাজাদের বিদ্রোহের কথা সমাচার পত্রে পাঠ করে বিস্মিত ও বিষাদিত হলাম” সম্রাট আওরঙ্গজেব ঔরঙ্গাবাদ নামক স্থানে জীবনলীলা সম্বরণ করেন, তাঁর পীড়ার সমাচার ও বিবরণ দিল্লির ‘পয়গম-এ-হিন্দ্’ নামক ফারসি সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছিল। তবে ১৬০৫ সালে প্রকাশিত রিলেশন অলার ফুর্নেমেন আন্ড গেডেনঙ্কুরডিগেন হিস্টোরিয়েনকে বিশ্বের ১ম সংবাদপত্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে।
উপমহাদেশে সংবাদপত্র:-
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের আগে এই উপমহাদেশে সংবাদপত্র প্রকাশের কোনো ঐতিহাসিক প্রমাণ মেলে না। ১৭৮০ সালে জেমস অগাস্টাস হিকি স্থানীয় ইংরেজদের জন্য বেঙ্গল গেজেট বা ক্যালকাটা জেনারেল অ্যাডভার্টাইজার নামে দুই পাতার একটি সাপ্তাহিক প্রকাশ করেন। কিন্তু ওয়ারেন হেস্টিংস, তাঁর পতœী ও ইংরেজ বিচারকদের সম্পর্কে সমালোচনামূলক প্রতিবেদন প্রকাশের দরুন এটিও দ্রুত বাজেয়াপ্ত হয়। ১৮১৮ সালের গোড়ার দিকে রাজা রামমোহন রায়ের সহায়তায় শিক্ষক ও সংস্কারক গঙ্গা কিশোর ভট্টাচার্য প্রথম বাংলা সাপ্তাহিক বেঙ্গল গেজেট প্রকাশ করেন।
অতঃপর ১৮১৮ সালের এপ্রিল মাসে ব্যাপ্টিস্ট মিশনারিদের উদ্যোগে শ্রীরামপুর থেকে বাংলা মাসিক পত্রিকা দিগদর্শন প্রকাশিত হয়। ১৮১৮ সালের ২৩ মে বেঙ্গল গেজেট’ প্রকাশের এক সপ্তাহ পর সমাচার দর্পণ প্রকাশিত হয়। রাজা রামমোহন রায় বাংলা সংবাদ কৌমুদী, ইংরেজি ব্রাহ্মিনিক্যাল ম্যাগাজিন ও ফার্সিতে মিরাত-উল-আকবর প্রকাশ করেন এবং তাঁর নেতৃত্বে ভারতীয় ও ইউরোপিয় সম্পাদকদের ঐক্যবদ্ধ চাপে লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক বিদ্যমান সংবাদপত্র আইন শিথিল করতে বাধ্য হন। ১৮৫৮ সালে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বাংলা সাপ্তাহিক ‘সোমপ্রকাশ’ প্রকাশ করেন। ১৮৫৯ সালে ঢাকায় বাংলাযন্ত্র নামে প্রথম বাংলা মুদ্রণালয় প্রতিষ্ঠিত হয়, যেখান থেকে ১৮৬১ সালে ‘ঢাকা প্রকাশ’ প্রকাশিত হয়। এ বছরেই দি জন বুল ইন দি ইস্ট (পরবর্তী নামকরণ দি ইংলিশম্যান) ইউরোপিয়দের ও ভারতে নীলকরদের শক্তিশালী মুখপত্র হয়ে ওঠে। ১৮৬৫ সালে এলাহাবাদ থেকে প্রকাশিত পাইওনিয়র পূর্ণাঙ্গ সংবাদ পরিবেশনের জন্য খ্যাতি অর্জন করে। ১৮৬৮ সালে ঘোষ ভ্রাতৃগণ (শিশির কুমার ঘোষ ও মতিলাল ঘোষ) যশোরের ক্ষুদ্র প্রাম ফুলুয়া-মাগুরা থেকে বাংলা সাপ্তাহিক অমৃত বাজার পত্রিকা প্রকাশ করেন (পরবর্তীকালে কলকাতায় স্থানান্তরিত)। ১৮৮১ সালে যোগেন্দ্র নাথ বসু বঙ্গবাসী প্রকাশ করেন। ১৮৭২ সালে প্রকাশিত বাংলা নীল দর্পণ নাটক ইউরোপিয় নীলচাষীদের নির্মম অত্যাচারের চিত্র তুলে ধরলে সরকারি মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় এবং ফলত সরকার ১৮৭৬ সালে নীলকরদের স্বার্থরক্ষার উদ্দেশ্যে অভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইন পাস করে। অমৃত বাজার পত্রিকা (যশোর)সহ আরও কতিপয় স্থানীয় পত্রিকা নীলচাষীদের পক্ষাবলম্বন করে। ঊনিশ শতক থেকে পত্রিকা নিয়মিতভাবে ছাপা শুরু হয়। তখন বাংলার সমাজ-ধর্ম-শিক্ষা-সংস্কৃতির প্রগতিশীল উন্নয়ন ও সংস্কার সাধনে যারা প্রাগ্রসর ব্যক্তিত্ব রামমোহন, ডিবোজিও, বিদ্যাসাগর প্রমুখ। হিকিকে অনুসরণ করে সংবাদপত্রের জগতে প্রথম অবদান রাখলেন গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য ও হরচন্দ্র রায়। ‘বাঙ্গাল গেজেট’ নামে পত্রিকা প্রকাশ করলেন তারা ১৮১৬ সালে। তারপর ১৮১৮ সালে শ্রীরামপুর মিশন থেকে ‘দিগদর্শন’ ও ‘সমাচার দর্পণ’ নামে দু’টি সাময়িকী প্রকাশের মাধ্যমে বাংলা সংবাদপত্রের ঐতিহাসিক যাত্রা শুরু।
ত্রিশের দশকে এসে বাঙালি হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকেই সংবাদপত্রের ভূমিকা বেশ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। বলা বাহুল্য এক্ষেত্রে হিন্দু সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণ ছিল জোরালো এবং বিস্তৃত। ১৯২২-এ মৃণালকান্তি ঘোষ, প্রফুল্ল কুমার সরকার ও সুরেশ চন্দ্র সরকার মিলিতভাবে প্রকাশ করেন, ‘আনন্দবাজার পত্রিকা।’ এর অনেক পরে বাঙালি মুসলমানদের হাতে পূণাঙ্গ একটি পত্রিকা ‘দৈনিক আজাদ’ ১৯৩৬ সালের ৩১ অক্টোবর প্রকাশ পেলো। উপমহাদেশের সংবাদপত্র শিল্পের শীর্ষ ব্যক্তিত্ব মওলানা আকরম খাঁর উদ্যোগে ও সম্পাদনায় ‘বাংলা ও আসামের মুসলমানদের মুখপত্র’ হিসেবে এটি প্রকাশিত হয়। আট পৃষ্ঠার পত্রিকাটি তখন নিজস্ব রোটারি মেশিনে ছাপা হতো। এ সময় বার্তা সম্পাদক ছিলেন, সাহিত্যিক মোহাম্মদ মোদাব্বের। দেশ বিভাগের পর ১৯৪৮ সালে পত্রিকাটি ঢাকায় স্থানান্তরিত হয়। পত্রিকাটির ৪৭-এর স্বাধীনতা আন্দোলন এবং তৎপরবর্তী বিভিন্ন রাজনৈতিক আন্দোলনে ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। এর আগে কমরেড মুজাফফর আহমদ এবং এ.কে. ফজলুল হকের সহায়তায় সান্ধ্য দৈনিক ‘নবযুগ’ প্রকাশ পায়। কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন সম্পাদনার দায়িত্বে। নজরুল সৈন্য বাহিনী বৃটিশ কর্তৃক গঠিত ‘বাঙালি পল্টন’ ছেড়ে ১৯২০-এর মার্চে কোলকাতায় আসার মাত্র দুই মাস পর ‘নবযুগ’ প্রকাশ পেলো। ১৯২২ এর ১১ আগস্ট কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর সম্পাদিত ‘ধূমকেতু’ নামে অর্ধ সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। ভারত ভাগের আগে পত্রিকা প্রকাশ এবং ভূমিকা পালনের ক্ষেত্রে মুসলিম জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ ছিল সীমিত। মওলানা আকরম খাঁর ‘দৈনিক আজাদ’ ছিল মূলত মুসলমানদের স্বার্থরক্ষা ও জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধকরণে একটি বলিষ্ঠ মুখপত্র। ৪৭-এর পর পূর্বপাকে কোলকাতা থেকে ঢাকায় স্থানান্তরিত হয়ে মাসিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে ‘কাফেলা’। আবদুল গণি হাজারীর সম্পাদনায় পিপলস পার্টির রাজনৈতিক সাপ্তাহিক মুখপত্র ‘ফরিয়াদ’ এবং কাজী আবদুল মান্নান ও একরামুল হক সম্পাদিত ‘ছাত্রলীগ’ ১৯৪৭-এ প্রকাশ পায়। ১৯৪৮-এ প্রকাশ পায় ‘তওহীদ’, ‘তকবীর’ ও ‘নবনূর’। এছাড়া কথাশিল্পী অধ্যাপক শাহেদ আলী ও এনামুল হক সম্পাদিত এবং প্রিন্সিপাল আবুল কাসেম প্রকাশিত ‘সাপ্তাহিক সৈনিক’ ও মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী প্রতিষ্ঠিত ‘সাপ্তাহিক ইত্তেফাক’ (পরে দৈনিক), আহমেদুল কবীর প্রকাশিত দৈনিক সংবাদ প্রকাশ পায়। আর এভাবে ধীরে ধীরে সংবাদপত্র প্রসারিত হতে থাকে।