Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪,

প্রসঙ্গ: অপরিকল্পিত নগরায়ন

রায়হান আহমেদ তপাদার

ফেব্রুয়ারি ১৯, ২০১৮, ০৯:০৯ পিএম


প্রসঙ্গ: অপরিকল্পিত নগরায়ন

অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলে ঢাকা শহরে তিল পরিমাণ স্থান খুঁজে পাওয়া হয়ে পড়েছে দুষ্কর। সমস্যার অন্ত নেই। বাসস্থানের অভাবের ফলে গড়ে উঠছে ভাসমান মানুষের বস্তি। যার ফলশ্রুতিতে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের সৃষ্টি। ময়লা আবর্জনা দুর্গন্ধ ইত্যাদি নিত্যদিনের সঙ্গি এ শহরে। শহরের বিপুল জনসংখ্যার বাসস্থানের ব্যবস্থা করতে গিয়ে অবৈধ দখলদারিত্ব বেড়ে চলেছে আশংকাজনক হারে। লেক ও নদীর পাড়গুলো দখল করে নিচ্ছে কিছু অসাধু লোক। যার ফলে নদী হারাচ্ছে নাব্যতা, লেক হচ্ছে দূষিত। যার ফলশ্রুতিতে ঢাকা শহরে জলাবদ্ধতার মত সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। খুব সহজ সমীকরণে বলা যায় জনসংখ্যা যত বেশী হবে তাদের দ্বারা সৃষ্ট ময়লা আবর্জনা তত বেশী হবে এবং এই ময়লা আবর্জনা যত্র তত্র নিক্ষেপের ফলে সৃষ্টি হয় অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। পাশাপাশি পরিবেশ দূষণও মারাত্মক আকার ধারণ করে। লেক ও নদীতে ময়লা আবর্জনা ছুঁড়ে ফেলার ফলে পানি হচ্ছে দূষিত এবং এ থেকে বিভিন্ন পানিবাহিত রোগের সৃষ্টি হচ্ছে। শহরের বস্তি এলাকগুলোতে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ সবচাইতে বেশি পরিলক্ষিত হয়। এই অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বিভিন্ন জীবানু থাকে যা আশপাশের পরিবেশকে দূষিত করে এবং এর ফলে মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ে। আমাদের চারপাশই আমাদের পরিবেশ। এই পরিবেশের মাটিদূষণ, পানিদূষণ, বায়ুদূষণ, শব্দদূষণের সঙ্গে আমরা খুব পরিচিত এবং সামান্য হলেও কিছুটা সচেতনতা আমাদের ভেতর এসেছে। মানুষ এসব দূষণ নিয়ে মতবিনিময় থেকে শুরু করে সচেতনতামূলক কাজ করে যাচ্ছে, যা সত্যি প্রশংসার দাবিদার। ঢাকা আমাদের রাজধানী। হয়তো রাজধানী নিজেই হাহাকার করছে তার নিজের সৌন্দর্য হারিয়ে। মুক্তির অপেক্ষায় এই দৃশ্য দূষণ থেকে। গবেষণায় দেখা গেছে, দৃষ্টিনন্দন রং যেমন নীল, সবুজ, গোলাপী, সাদা বেগুনী, ধূসর, হলুদ চোখে আরাম প্রদান করে। বিলবোর্ড পোস্টার বৈদ্যুতিক তার, ইত্যাদি কোথায় স্থাপিত হবে তার জন্য সুপরিকল্পিত নগরায়ন পরিকল্পনা করা দরকার এবং শিল্প যা মানুষকে তার পণ্য বিক্রয় বিজ্ঞাপনের সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশের কথা মনে করিয়ে দিবে। দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা দিলে আমরা সত্যই অনেক বড় জাতির সামনে থেকে পথ ঘুরিয়ে সামনে চলতে পারবো। দৃশ্যদূষণ ব্যাপারে নগরায়ন পরিকল্পনা কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। এই জলাবদ্ধতা ও অতিবৃষ্টির কারণে সাধারণ জনগণের, বিশেষ করে নারীদের ও শিশুদের চলাচল কষ্টকর ও অনিরাপদ হয়ে উঠছে। প্রয়োজনীয় সেবাগুলো, যেমন পানি ও বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যাহত হচ্ছে। ধারণা পত্রে আরও বলা হয়, “শতকরা ৩৪ শতাংশ মানুষ নগরে বসবাস করে। গত ২০/২৫ বছরে নগরায়ন পরিকল্পিত ভাবে হয়নি। যেখানে সেখানে ঘর বাড়ি উঠে যাচ্ছে। আবর্জনা ব্যবস্থাপনায় সমস্যা রয়েছে। একই সঙ্গে দক্ষ প্রশাসন ব্যবস্থার অভাব এবং ভবিষ্যতের কথা বিবেচনা না করে তৈরি অযৌক্তিক ও অনুপযুক্ত নগরায়ন শহরের পরিস্থিতি খারাপ করছে। সঙ্গে যোগ হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন ও দুর্যোগজনিত সমস্যাগুলো। অপরদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে শহরে মাইগ্রেশন বাড়ছে। একইসঙ্গে শহরে সুপেয় পানির ওপর প্রভাব পড়ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে সঠিক পরিকল্পনা মাফিক কাজ না হলে শহর ব্যবস্থাপনা আমাদের জন্য কঠিন হবে। সমস্যা সমাধানে আমাদের স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিয়ে আগাতে হবে। তাছাড়া আগে জলবায়ুর একটা সীমারেখা ছিল। কিন্তু এখন আর সেটা নেই। যেই সময়ে শীত থাকার কথা সেই সময়ে থাকছে না। আমাদের শহর জলবায়ুর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। একশন এইড বাংলাদেশের ধারণাপত্রে বলা হয়, বৈশ্বিক উষ্ণতা ইতোমধ্যে জলবায়ুর স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় যে ভারসাম্যহীনতা তৈরি করেছে, তার প্রভাবে গত দুই দশক ধরে বিশ্ব জুড়ে লাখ লাখ মানুষের ওপর জলবায়ু পরিবর্তন জনিত বিপর্যয়ের মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে। যে কারণে বিশ্বের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলির মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। জলবায়ু পরিবর্তন একটি সমস্যা। তার সঙ্গে যোগ হচ্ছে নগরায়নের বিষয়। এই সমস্যাগুলো সমাধানে সচেতনতা বাড়াতেই হবে। যারা ক্ষমতায় আছেন তাদের দায়িত্ব পালন করতে হবে। গবেষকসহ বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব পালন করতে হবে। জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচি বাংলাদেশের সহকারী কান্ট্রি ডিরেক্টর খুরশিদ আলম বলেন, বাংলাদেশ সমস্যাগুলো খুঁজে বের করেছে। এখন সমন্বিতভাবে সমাধানে কাজ করতে হবে। বিভিন্ন শহরের কর্তাদের বিশেষ করে মেয়রদের রাজনৈতিক ক্ষমতা ও সচেতনা বাড়াতে হবে। যাতে তারা সমস্যা সমাধানে সঠিক উদ্যোগ নিতে পারেন। অনুষ্ঠানে জলবায়ু পরিবর্তন ও নগরায়ন সমস্যা সমাধানে কিছু প্রস্তাব তুলে ধরে একশন এইড বাংলাদেশ। অন্যদিকে অপরিকল্পিতভাবে নগরায়নের থাবা পড়েছে ফসলি জমির ওপর। কমে যাচ্ছে আবাদি বা ফসলি জমি। অনেক শহরে এ অবস্থা আশঙ্কাজনক। গত বারো বছরে শুধু বগুড়ায় আবাদি জমি কমেছে প্রায় ৩৭ হাজার হেক্টর। এ পরিমাণ জমি থেকে উৎপাদন কমেছে আড়াই লাখ টনেরও বেশি। এরকম অবস্থায় আছে আরও বিভিন্ন অঞ্চল। যা আমাদের দেশের জন্য মোটেও সুখকর খবর নয়। এছাড়া জমির দাম দিন দিন জ্যামিতিক হারে বাড়ছে। চাকরি বা নানা কারণে যারা শহরমুখী তাদের বড় একটি অংশই শেষ পর্যন্ত শহরের অধিবাসী হয়ে যান। প্রথমে তারা ভাড়া বাড়িতে থাকেন। তারপর বসতবাড়ি গড়ার জন্য জায়গা কেনেন। একপর্যায়ে বাড়ি নির্মাণ করেন। কেউ ইনস্টলমেন্টে ফ্ল্যাট বাড়ি কেনেন। এর ফলে নগরীতে হালে ডেভেলপারের সংখ্যা বেড়ে গেছে, যারা নগরীর ভেতরে বিভিন্ন পাড়া ও মহল্লা ছাড়াও শহরতলী এলাকা এবং পৌর এলাকার বাইরে জমি কিনে বহুতল ফ্ল্যাট বাড়ি নির্মাণ করছেন। এভাবে সম্প্রসারিত হচ্ছে নগরায়ন প্রক্রিয়া। আর তাই দেশের প্রায় প্রতিটি শহরই এভাবে অপরিকল্পিত নগরায়নের শিকার। আমরা মনে করি, রাজধানী ঢাকাসহ প্রায় প্রতিটি শহরই অপরিকল্পিতভাবে সম্প্রসারিত হচ্ছে। এখনই অনেক শহর বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে পরিস্থিতি দিন দিন খারাপ হচ্ছে। তাই নগরকে বাসযোগ্য করতে শহরমুখী জনস্রোত কমানোর পাশাপাশি বিকল্প ভাবনা ভাবতে হবে। আমরা আশা করি, কর্মসংস্থানের সুযোগ গ্রাম পর্যায়ে বৃদ্ধি করে এবং গ্রামীণ অবকাঠামোসহ বসবাসের ক্ষেত্রে সুবিধা নিশ্চিত করতে পারলে অনেকেই শহরমুখী হতো না। এছাড়া অপরিকল্পিত নগরায়ন ঠেকাতে হবে। এটা না ঠেকাতে পারলে ভবিষ্যতে বসবাস অনুপোযোগী হবে আরও অনেক শহর। উল্লেখ্য অধিক জনসংখ্যা ও পর্যাপ্ত জায়গার অভাবে ঢাকায় বিনোদনের পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা নেই। কয়েকটি নির্দিষ্ট পার্ক ও বিনোদন কেন্দ্র ছাড়া তেমন বিশুদ্ধ নির্মল পরিবেশের অভাব প্রকট আকার ধারণ করেছে। শিশুদের বিকাশে যে পর্যাপ্ত বিনোদনের ব্যবস্থা থাকা উচিত তার ছিটেফোঁটাও নেই। নেই কোনো খেলার মাঠ। নেই কোনো নির্মল পরিবেশ। গাছ-পালার অভাব ও বিশেষভাবে লক্ষণীয়। আজকাল আবার বিভিন্ন মাঠ দখল করে সুপার মার্কেট, এপার্টমেন্ট ইত্যাদি গড়ে তোলার হিড়িক পরেছে। ফলে শিশুরা খেলার মাঠ থেকে বঞ্চিত। ঘরের কোনায় থাকতে থাকতে তাদের পর্যাপ্ত মানসিক ও শারীরিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। ঢাকার আরো একটি বড় সমস্যা হল যানজট। অপরিকল্পিত নগরায়নের আরো একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ। পরিকল্পনার অভাব ও দুর্নীতির ফলে শহরের রাস্তাঘাটে হরহামেশাই যানজট লক্ষ করা যায়। ফলে পথচারী ও যানবাহনগুলোর অসুবিধা অনেক বেশী হয়। এখানেও পরিকল্পনার অভাব বিশেষভাবে লক্ষণীয়। দেশের প্রতিটি বিভাগে যদি সঠিক ও পরিকল্পিত দীর্ঘ মেয়াদী উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয় তাহলে হয়তো নির্দিষ্ট কিছু বড় শহরগুলোতে কাজের খোঁজে যাওয়া লোকের সংখ্যা কমে আসত। আর লোকসংখ্যা কমে গেলে পরিবেশ দূষণ থেকে শুরু করে আরো অনেক সমস্যারই সমাধান সম্ভব হত। দেখা যায় সবাই পরিবেশ বাঁচাও বলে চিৎকার করে। খাদ্য ঘাটতি দূর কর বলে চিৎকার করে। গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর মত গাল ভরা শব্দ বলতে বলতে মুখে ফেনা তুলে ফেলে। পরিবেশ দিবসে সভা সেমিনার করে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। মনে রাখতে হবে, আমাদের দেশের মধ্যে যে হাজারো পর্বতসম সমস্যা আছে সেটা নিয়ে ভাবতে হবে। সবাই যেন নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছেন। কেউ বলে না আমাদের দেশের অপরিকল্পিত উন্নয়ন ও নগরায়ন সম্পর্কে। যত উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা হয় সবই সাময়িক। দীর্ঘ মেয়াদী কোনো পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয় না। তাই আমার প্রশ্ন আমাদের দেশের কী হবে?
–লেখক ও কলামিস্ট