কামাল সিদ্দিকী
মার্চ ১০, ২০১৮, ০৫:৫১ এএম
‘পুরনো সেই দিনের কথা ভুলবি কিরে হায়/ সেযে চোখের দেখা প্রাণের কথা তাও কি ভোলা যায়। সময় আর স্রোত ধরে রাখা যায় না। তাকে মনে লালন করতে হয়। পেছন ফিরে বারবার দেখে নিতে হয় সেই সোনালি অতীতকে। কোথায় ছিলাম আর কোথায় এলাম, তার হিসাব মেলাতে হিসাবের খাতায় গরমিল হলেও অতীতের সেই ক্ষণ মনেতে দোলা দিয়ে যায়। এই নষ্টালজিয়ায় পড়ে কতজনই না তার হারানো অতীতে ফিরে যেতে আকুল হয়েছেন। গ্রাম ছেড়ে যারা আজ শহুরে হয়েছেন তাদের মনেও একবার এইভাবে দোলা দেয় ‘একবার যেতে দে না আমায় ছোট্ট সোনর গায়... কিম্বা সেই গানের মতো... আমি মেলা থেকে তালপাতার এক বাঁশি কিনে এনেছি/ বাঁশি কই আগের মতো বাজে না/ মন আমার কেন তেমন সাজে না/ তবে কি আমি আমার ছেলেবেলা অনেকটা পথ ফেলে এসেছি... আর হেমন্তের সেই গানের চরণÑ আমিও পাখির মত হারিয়ে যাব আসবো না ফিরে আর আসবো না কোন দিন...।’ তবে ছোট্টবেলার সেই স্মৃতিময় স্থানে গতকাল হাজির হয়েছিলেন স্মৃতিকাতর কিছু মানুষ। তাদের প্রিয় স্কুলের বাষট্টিকে স্বাগত জানাতেই তারা সেদিন মিলেছিলেন। ...হঠাৎ বৈকালে অফিস অঞ্চলে হারিয়ে যাওয়া মুখ চমকে দিয়ে বলেÑ বন্ধু কি খবর বল... কতদিন দেখা হয়নি...
চুয়াডাঙ্গা জেলার জীবননগর থানার ছোট্ট একটি হাট হাসাদহ। জীবননগর শহর থেকে যার দূরত্ব চার কিলোমিটার। ১৯৫৫ সালে এই ছোট্ট বাজারে এলাকার শিক্ষার উন্নয়নে একটি উচ্চবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা পায়। তখনো জীবননগর থানা সদরে কোনো হাইস্কুল গড়ে ওঠেনি। ঠিক সে সময়ে হাসাদহ হাইস্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেন এলাকার কিছু বিদ্যোৎসাহী মানুষ। যাদের ব্যক্তিগত বিদ্যার দৌড় হয়তো বেশি ছিল না তবে শিক্ষার প্রতি তারে টান ছিল অনেক অনেক বেশি। তাই তারা জোটবদ্ধ হলেন একটি হাইস্কুল প্রতিষ্ঠায়।
সেই স্কুলের গতকাল ছিল ৬২ বছরে পদার্পণ। এই দিনটিকে স্মরণ এবং বরণ করতে এই স্কুলের প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা পুনর্মিলনীর আয়োজন করেন। প্রাক্তনদের অনেকেই রাজধানী ঢাকাসহ আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, কানাডাসহ এই মহাদেশ ছেড়ে অন্য মহাদেশে বসবাস করছেন। এই সেই সব হারিয়ে যাওয়া মুখ আবারো একই মোহনায় এসে মিশেছিল গত ৯ মার্চ।
ঘড়ির কাঁটা তখন আটটা ছুঁই ছুঁই করছে। হাসাদহ জেগে ওঠে সেই পুরনোদের বরণ করার দীপ্ত মানসে। হাজির পুরনোর দল। সাথে সঙ্গ দিচ্ছে নতুনের কাফেলা। সবার মাথায় ক্যাপ আর গায়ে টি-শার্ট। পুনর্মিলনীর ছন্দে সবাই তখন দাঁড়িয়ে র্যালির অপেক্ষায়। র্যালিতে কি নেই। রয়েছে পুরনোদের মুখে নতুনের উচ্ছ্বাস। বয়সের বাধা পেরিয়ে সবাই তখন নতুন আর হৃদয়ে ধারণ করেছে স্কুলজীবনের হারিয়ে যাওয়া স্মৃতি। চুয়াডাঙ্গার জেলা প্রশাসক জীয়া উদ্দিন আহমেদ এলেন। সকলের উচ্ছ্বাস এবং ভালোবাসা ভাগাভাগি করে নিলেন। হাজির কানাডা প্রবাসী যিনি কেবলমাত্র এই অনুষ্ঠানের জন্য ফিরেছেন সেই এএসএম হাবিবুর রহমান, চুয়াডাঙ্গা বারের লব্ধপ্রতিষ্ঠিত আইনজীবী বজলুর রহমান, এককালের প্রধানমন্ত্রী সচিবালয়ের জাঁদরেল আমলা আব্দুল আজিজ, যশোরে কর্মরত নামকরা সুচিকিৎসক সিরাজুল ইসলাম (যিনি এখনো তার ব্যক্তিগত গাড়িতে বাংলাব্যাকরণ আর রবীন্দ্রনাথের বই নিয়ে বসার আসন অলঙ্কৃত করেন), আছেন বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার ডা. আসাদুল হক, জেলা পরিষদের নির্বাচিত মেম্বার মো. শফিকুল ইসলাম নান্নু, অবিভক্ত বাকা ইউনিয়নের পরপর চারবার নির্বাচিত সাবেক জনপ্রিয় চেয়ারম্যান ও উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান, বর্তমান উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি গোলাম মুর্তজা, হাসাদহ ইউনিয়নের আওয়ামী লীগ মনোনীত চেয়ারম্যান প্রার্থী রবি বিশ্বাস, দৈনিক ইত্তেফাকের মহেশপুর প্রতিনিধি আব্দুর রহমানসহ নতুন-পুরান মিলে অর্ধশত। শুরু হলো র্যালি। হাসাদহর মাটি এবং মানুষ তাদের পুরনো সাথীদের স্বাগত জানাতে হাজির হলেন স্কুল প্রাঙ্গণে।
আনান্দ আর উচ্ছ্বাসে কেটে গেল র্যালি পর্ব। এবার আলোচনা সভা। স্মৃতিচারণে স্মৃতিকাতর মানুষগুলো। এ অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি হিসেবে যোগ দিলেন স্বনামধন্য চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসক। আর অনুষ্ঠানে পৌরহিত্য করলেন স্কুলের প্রাক্তন শিক্ষার্থী আয়োজক কমিটির আহবায়ক গোলাম মুর্তজা। আলোচনা সভা সঞ্চালনার দায়িত্ব নিলেন অ্যাড. বজলুর রহমান। আর যাকে সাথে নিলেন তিনি আমাদের জেলার গর্ব একজন স্বার্থক উপস্থাপক বাংলাসাহিত্যে যার বিচরণ ঈর্ষণীয়, আবার যিনি সরকারি কলেজে বাংলা পড়ান, সেই সহকারী অধ্যাপক আবু সাঈফ মুকু। কণ্ঠ এবং রসবোধ মাখিয়ে যিনি আলোচনাকে আরো প্রাণময় করে তুলতে পারেন। এই কাজে তিনি অদ্বিতীয় বললে খুব একটা বেশি বলা হবে না। আলোচনা শেষের ঘণ্টা বাজিয়ে দিল জুমার আজান। এরপর বিরতি। আর নামাজান্তে বিশাল প্যান্ডেলে মধ্যাহ্ন ভোজ। আগেই খাবার টোকেন দিয়ে সুশৃঙ্খলভাবে পরিবেশন করা হলো। খাবার শেষে ক্রীড়ানুষ্ঠান। ক্রিকেট এখন জনপ্রিয় খেলা। সেটিই আইটেম হিসাবে আয়োজকদের পছন্দ। সৈয়দ মুজতবা আলীর প-িত মশাই গল্পের একটি উদ্ধৃতি মনে পড়ে গেল। প্রচ-ভাবে সংস্কৃতির প-িত মশাই যখন ডাস্টার ছুড়ে মেরেছিলেন তখন আত্মরক্ষার্থে সেটিকে ক্যাচ ধরতে সক্ষম হন মুজতবা আলী। নিজের কৃতিত্বকে বড় করে দেখার লোভ সামলাতে পারেননি। তাই বললেন, ক্রিকেট ভালো খেলায় সেদিন কাজে লেগেছিলো। আজকে সেই কথাটি আবারো মনে পড়ে গেল। তবে সবাই যে ছিলেন এমনটি বলা গেল না। কারণ অনেকেই পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে পরপারের টিকিট নিয়েছেন। তাদের ভিতরে একজন সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত চিকিৎসক মরহুম ডা. খলিলুর রহমান। তার স্মৃতিতে খোলা হয় স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচি। সেখানে রক্তদান করে বিপন্ন মানুষের জন্য অবদান রাখেন প্রাক্তন শিক্ষার্থীর দল। মানুষের বয়স চল্লিশ হলেই তিনি বয়স্কদের খাতায় চলে যান। কথায় আছে চল্লিশ পেরুলেই চালশে। তখন চশমা আর দেহের নানাবিধ রোগের সাথে হয় বসবাস। কিন্তু বিদ্যালয়? এই অভিশাপ থেকে মুক্ত। যখনই পলেস্তারা খুলে পড়ে তখনই নতুন করে প্লাস্টার করে দিলে আবার তার যৌবন ফিরে আসে। অবশ্য এটি তার অবকাঠামোগত যৌবন। কিন্তু প্রকৃত যৌবন দৃশ্যমান হয় তখন যখন সেই স্কুল প্রকৃত শিক্ষা কাউকে দিতে সক্ষম হয়। কথায় আছে ‘শিক্ষার জন্য আসো আর সেবার জন্য বেরিয়ে যাও।’
এপিজে আব্দুল কালাম। যিনি একসময় বিভিন্ন কাজ করে তার লেখাপড়া চালিয়েছেন। যিনি ভারতের প্রেসিডেন্ট হয়েও নিজেকে প্রেসিডেন্ট অপেক্ষা শিক্ষক পরিচয় দিতেই স্বাছন্দ্য বোধ করতেন। আরেকজন যিনি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ছিলেন, জেফারসন, তিনি তার কীর্তি যেটি খোদাই করেছিলেন সেখানে তিনি বলেছিলেন এখানে শুয়ে আছেন জেফারসন। যিনি আমেরিকার সংবিধান রচনার সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলেন আর তিনি একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছেন। এর চেয়ে তার আর কোনো কীর্তি নেই। তিনি যে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ছিলেন সে বিষয়টি কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজ বলে মনে করেননি।
হাসাদহ হাইস্কুল আগামীতে আরো বড় গুণীর জন্ম দেবে, তাদের মধ্যে কেউবা হবেন আইনস্টাইন, এপিজে আব্দুল কালাম, জেফারসন। যারা বদলে দেবেন অধিকারহারা মানুষের ভাগ্য। আগামী প্রজন্ম আরো ব্যাপকভাবে শতবর্ষ পালন করে এলাকার ঐতিহ্যবাহী স্কুলটিকে স্মরণ করবে এমন প্রত্যাশায় শেষ হলো ৬৩-র উদযাপন। শেষে মনের কোনে জমে ওঠা অতৃপ্তি নিয়ে গেয়ে উঠলো আজ তবে এই টুকু থাক বাকী কথা পরে হবে/ ধূসর মরুর পথ ভেঙেচুরে আসে রথ/ এখনো বহু দূর যেতে হবে, আজ তবে.....।