Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ২১ জুন, ২০২৫,

‘উপকারীকে বাঘে খায়’ আর আত্মপ্রতারণার কিচ্ছা

কামাল সিদ্দিকী

মার্চ ২৮, ২০১৮, ০৯:০৮ পিএম


‘উপকারীকে বাঘে খায়’ আর আত্মপ্রতারণার কিচ্ছা

মার্চ মাস এলেই অনেক কাহিনী আমাদের চিত্তে কাঁপন ধরায়। যারা ১৯৭১ সালের এই দিনে ছিলেন অথচ তাদের বড় কোনো ভূমিকা ছিলনা তারাও যেমন নড়ে চড়ে বসেন, আবার যারা ঘটনার সাক্ষী হয়েছেন মাত্র, তারাও নিজেদেরকে বীর বানাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এমনি একটা ঝড় উঠেছে স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়ানো নিয়ে। ৩ মার্চ এই পতাকা উত্তোলনের দাবিদার দুজন। একজন সাবেক স্বৈরশাসক জেনারেল এরশাদের গৃহপালিত বিরোধী দলনেতা আ স ম আব্দুর রব অন্যজন বিএনপি আমলের মন্ত্রী হয়ে লুটেপুটে খাওয়া শাহজাহান সিরাজ। তাদের লড়াইয়ের ফিরিস্ত দেবার আগে একটি গল্প বলে নিলে মন্দ হয়না। যদিও গল্পটি কমবেশি সকলেই জানেন। যারা জানেন তাদের জন্য নয়। কেবল যারা জানেন কিন্তু মনে রাখতে পারেননি তাদের জন্য। এক লোভী বামুন হঠাৎই নিমন্ত্রণ পেলেন। অনেকটা দূরের এক গায়ে। নিমন্ত্রণ পাওয়ার পর থেকে তিনি নিজেকে তৈরি করছেন কীভাবে যাবেন আর ভালো ভালো খাবারগুলি লুকিয়ে গিন্নির জন্য নিয়ে আসবেন। যাত্রার দিন বেশ সকাল সকাল বের হতে হবে ভেবে স্নান সেরে তিনি গিন্নিকে বললেন, বুঝলে ঠাকরুন আজকে সেই নিমন্ত্রণের দিন। তাই আমি চললুম। গিন্নি মুখ ভার করে বললে, তুমি একাই এসব ভালো ভালো জিনিস খাবে আর আমাকে তার গল্প শুনতে হবে? এর চেয়ে ঠাকুর আমার মরণ করলে না কেন! বামুন বললে, আরে তুমি কী ভাবো আমাকে এ্যাঁ। আমি কি একা খাব? খাবো আর তোমার জন্য বেঁধে নিয়ে আসব। বলেই তিনি কোঠরে গোজা ময়লা ধুতি লুকানো আচলটি দেখালেন। বউতো মহাখুশ্ িগঙ্গা জল দিয়ে পা ধুইয়ে সেই পদজল খেয়ে স্বামীর কল্যাণ কামনা করতে করতে পূজোর ঘরে ঢুকলো। অনেক রাস্তা যেতে হবে তাই বামুন আর দেরি না করে রাস্তায় বের হয়ে পড়লো। বামুন যাচ্ছে আর মনে মনে ভাবছে কতকী খাবে, কীভাবে গিন্নির জন্য পাত পেতে তা নিয়ে আসবে। এসব ভাবতে ভাবতে সে এক গভীর বনে ঢুকে পড়লো। গহীন অরণ্য সূর্যের আলো ঢোকেনা। গা ছম ছম করছে। কোথাও কেউ নেই। দেবতার নাম নিতে নিতে বামুন চলেছে। হঠাৎই গভীর বনের ভিতর থেকে একটা চিৎকার ভেসে আসে। বাঁচাও! বাঁচাও! কোন দিক দিয়ে আসছে তার খোঁজ করতে থাকে বামুন। তার পাশ থেকেই এই বাঁচাও ! শব্দটি ভেসে আসছে। সে ভালো করে তাকিয়ে দেখে একটা বাঘ তার সাহায্য চাইছে। বামুন তাকাতেই দেখতে পেলো বাঘটি পচা ডোবায় ডুবে যাচ্ছে। যত সে নড়াচড়া করছে ততই পাকে পড়ে গভীরে তলিয়ে যাচ্ছে। বাঘ বাঁচার জন্য বামুনকে নানা ধরনের আকুতি মিনতি জানাতে থাকে। কিন্তু বামুন জানে উপকারীরে বাঘে খায়। তাই তাকে এড়াতে সে নিজের পথ ধরে। বলতে থাকে না বাপু, তোমাকে বাঁচিয়ে আমার কাজ নেই। তোমাকে বাঁচালেই ডেঙ্গায় এসে তুমি আমাকে খাবে। বাঘ তখন সব দেবতাদের দোহাই দিতে থাকে। আবার বলে আমাকে তুমি ওপরে তুললে তোমাকে আমার পিঠে চড়িয়ে অতিদ্রুত পৌছে দেব। বামুনের দয়া হলো। কারণ একেই অনেক দূরের পথ। তারপরে বেলা পড়ে এসেছে। দ্রুত না যেতে পারলে ভালো খাবার মিলবে না। এসব ভেবে সে রাজী হলো। পাশেই একটা বাঁশ পড়েছিলো সেটি বাঘের দিকে এগিয়ে দিলো। সেই বাঁশ ধরে বাঘটি কাঁপতে কাঁপতে ওপরে উঠে এলো। এরপর গা ঝাড়া দিয়েই বললো, বামুন আমার বড্ড খিদে পেয়েছে এখন আমি তোমাকে খাব। বাঘের এই কথায় বামুন অবাক। বললো, তুমি যে দেবতাদের দোহাই দিলে, আবার আমাকে পিঠে চড়িয়ে পৌছে দেবে, সেই তুমি একথা বলছো? বাঘ বললো তখন বাঁচার জন্য কী বলেছি ওসব ভুলে যাও। আমার খিদে লেগেছে এখন আমি তোমাকে খাব। বামুন তখন তার পুথি থেকে অনেক শ্লোক শুনালো। এমন অধর্মের কাজ করলে ঈশ্বর তোমাকে ক্ষমা করবে না। সারাজীবন তোমাকে নরকে পুড়তে হবে। বাঘ বললো তা হোক। এখন তুমি এসোতো তোমাকে খেয়ে আমার পেট ঠা-া করি। বামুন দেখলো কোনো শাস্ত্রেই আমার নিষ্কৃতি নেই। তাই সে বলে ঠিক আছে, তুমি আমাকে খাবে। কিন্তু এভাবে যদি তুমি আমাকে খাও তাহলে তোমার অধর্ম হবে। তার চেয়ে এক কাজ করো, আমরা তিনজন স্বাক্ষীর কাছে যাই। তারা যদি সবশুনে বলে তুমি অন্যায় করছো না তখন তুমি আমাকে খেও। এতে তোমারও পাপ হবে না, আর আমারও কোনো আপত্তি থাকবে না। বেশ তাই হোক, বলে বাঘ রাজি হলো। এরপর দুজনে স্বাক্ষী খুঁজতে চললো। প্রথমেই এক কাকের সাথে দেখা। তাকে ডেকে আদিঅন্ত ঘটনা সব বামুন খুলে বললো। এরপর জানতে চাইলো বল এটাকি বাঘের অন্যায় নয়? কাক সরাসরি জবাব দিলো না বাঘের কোনো অন্যায় নেই। এই তোমরা মানুষেরা, কত অন্যায় করো। আমি কাক তোমাদের ময়লা আবর্জনা ছাপ করে দিই। যাতে তোমরা রোগ বালাই থেকে মুক্ত থাকো। অথচ তোমরা আমাকে দেখলেই দূর দূর করে তাড়িয়ে দাও? বলো আমি নাকি অকল্যাণ! সুতরাং বাঘ যা বলছে তাই ঠিক। কাক এই কথা বলেই পাখা মেলে উড়ে গেলো। বাঘ বললো দেখলে তো আমার কথা ঠিক। এবার এসো তোমাকে খাই। বামুন বললো এতো ব্যস্ত হচ্ছো কেন? কেবলতো একজন এখনো দুই জন বাকি। তারা বললে তুমি খেও। আমিতো আর না করতে পারবো না। এরপর দুজনে গঙ্গার ধারে এলো। একটা ভাঙাহাড়ি ভেসে যাচ্ছিলো। বামুন তাকে ডেকে নিজের বোকামীর কথা বলে। হাড়ি সব শুনে বলে তোমরা মানুষেরা বড় অকৃতজ্ঞ। এই আমাকে দেখ সারাজীবন আমি তোমাদের রেঁধে খাইয়েছি। আজ বয়স হয়েছে, আমাকে ঘর থেকে এই নদীর জলে ফেলে দিয়েছে। তাই বলছি বাঘ ঠিকই বলছে। ও তোমাকে খেতেই পারে। বাঘ বলে শুনলেতো। এবারে এসো তোমাকে খাই। উফ খিদের জ্বালায় আর বাঁচি না। বামুন বললো অত খাই খাই করছো কেন? এখনোতো একজন বাকি। সে বললে খেও। বাঘ আর বামুন আবারো হাটতে থাকে। বামুন নিশ্চিত তাকে বাঘের পেটে যেতে হবে। আহ কোন কুক্ষণে সে বাঘকে বাঁচাতে গিয়েছিলো। এখন নিজের জীবন দিয়ে তার খেসারত দিতে হবে। হঠাৎ দেখা গেল একটা শিয়াল আসছে। বামুন তখন শিয়ালকে ডেকে বললো, প-িত মশাই একটু শুনবেন। শিয়াল বললো তোমার কাছে যাওয়া যাবেনা। তোমার সাথে বাঘ আছে। যা বলার তা দূর থেকেই বলো। বামুন সব ঘটনা খুলে বলে। শিয়াল না বোঝার ভান করে বলে আমিতো ঠিক কিছুই বুঝতে পারছি না। তোমরা কি আমাকে ঘটনাস্থলে নিয়ে যেতে পারো? বাঘ রাজী হলো। তখন শিয়াল বললো তোমরা ওই পথেই যাও। আমি পিছনে পিছনে আসছি। ডোবার কাছে এসে বাঘ বলে, আমি এই ডোবায় পড়েছিলাম। বামুন আমাকে উদ্ধার করে। তখন শিয়াল বলে ওহ বুঝেছি। ব্যাটা বামুন ডোবায় পড়েছিলো আর তুমি তাকে উদ্ধার করেছে? এই কথা শুনে বাঘের খুব রাগ হলো। সে বলে এই ব্যাটা বুদ্ধ.ু বামুন না আমি পাকে পড়েছিলাম। শিয়াল বলে তা তুমি কোন খানটায় পড়েছিলো সেটা না দেখালে বিচার করি কীভাবে? বাঘ দাঁত কটমট করতে করতে ডোবায় নেমে গেলো। শিয়াল তখন বললো বামুন কতদূরে সে জায়গাটি। বামুন বলে আরো একটু এগিয়ে বাঘ রাগে রাগে সে পর্যন্ত যেতেই পাকে পড়ে যায়। আবার সে বাঁচার জন্য বামুনকে অনুরোধ করতে থাকে। এই অবস্থা দেখে শিয়াল লেজ তুলে ভোদৌড় আর বামুনকে বলে পালাও। বাঁচার জন্য তখন বাঘ সমানে আকুতি করে চলেছে। কিন্তু বামুন- আর নয় বাবা বড় বাঁচা বেঁচে গেছি বলে নিজের রাস্তায় পা বাড়ায়। একসময় বাঘটি পাকে পড়ে চিরদিনের মত হারিয়ে যায়। আমাদের দুই নেতা রব-সিরাজ সাহেব একসময় উপকার পেয়েছিলেন, জাতির জনকের আশির্বাদ পেয়েছিলেন। চার খলিফার দুই খলিফা ছিলেন দুজন। স্বাধীনতার পর কালমার্ক্সের সমাজতন্ত্রে মন ভরেনি। তাই তার আগে লিখলেন বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র। তারপর গণবাহিনী করে গল্পের বাঘের মত আচরণ করতে থাকেন। সদ্য স্বাধীন দেশে যখন ঐক্যের প্রয়োজন, যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশকে গড়ে তোলার জন্য যখন দিনরাত কাজের প্রয়োজন, তখন এই দুজন দেশকে অস্থিতিশীল করে ফেলার নীলনকশা আঁকলেন। সরকারকে আরো চাপে ফেলে দিলেন। গণবাহিনী গড়ে নির্বিচারে হত্যা লুণ্ঠনে মেতে উঠলেন। ডাকাতি করে মানুষের স্বপ্ন ভেঙে দিলেন। স্বাধীনতার ওপর থেকে জন আস্থা ঘুচাতে সেদিন তারা পাকিস্তানিদের সাথে হাত মেলালেন। ৭৫এর ১৫ আগস্টের নির্মম হত্যাকা-ের পর উধাও হয়ে গেল সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন। কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে সেখানে জ্বালালেন পাকিস্তানিদের আলো। তাই তার এদিনকার নেতা মেজর জলিল বলে বসলেন, আদতে সমাজতন্ত্র ও সব আমি কিছু বুঝি না। আমার দরকার ছিলো পাকিস্তানি ভাবধারা ফিরিয়ে আনা। আর আমি যে কাজটি করতে চেয়েছি তাকে সার্থক করেছেন জাসদ। যার চালিকাশক্তি সিরাজুল আলম খান, আ স ম আব্দুর রব এবং শাহজাহান সিরাজ। এরাই এখন প্রথম পতাকা উত্তোলনকারী হিসাবে নিজেদের মধ্যে লড়াইয়ে মেতেছেন। শাহজাহানের পক্ষে ওকালতি করছেন পুরো বিএনপি সমাজ। যার নেতৃত্বে আছেন নজরুল ইসলাম খান। আর আ স ম রবের পক্ষে দুতিয়ালিতে নাম লিখিয়েছেন ড. কামাল গং। তবে যার নেতৃত্বে সেদিন পতাকা তোলার সাহস হয়েছিলো তাকে কিন্তু এরা একবারের জন্যও মনে রাখতে চাননি। আর এই না চাওয়ার জবাব দিতে বাংলা এবং বাঙালি তাদেরকে পিঠ দেখাতে কোনোভুল করেনি। রাজনীতি বলতে প্রেসক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জ অথবা সমমনা কোনো পত্রিকার পাতা। অবশ্য দুজনেই এখন একজন ভালো শিয়ালের বুদ্ধি নিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন। একজন শিয়াল প-িতের অপেক্ষায় কটি বছর কাটবে সেটিই এখন দেখার বিষয়। যদিও সিরাজুল আলম খান একবারে নিঃশ্বেষ হয়ে যাননি বলে মাঝে মাঝে হুংকার শুনা যায়।