মোঃ মনিরুল ইসলাম রাহুল, শিক্ষানবীশ আইনজীবী
জুলাই ২৬, ২০১৮, ০১:৪৪ পিএম
ইউপিডিএফের সহযোগী সংগঠনের দুই নেত্রীকে অপহরণ (প্রথম আলো-১৮ মার্চ, ২০১৮), ‘মালিক’ হওয়ার স্বপ্নে নৃশংস দুই তরুণ (প্রথম আলো-২২ মার্চ, ২০১৮), মিরপুরে নির্মাণাধীন ভবনে তরুণীকে তুলে নেওয়ার অভিযোগ (প্রথম আলো-২৪ মার্চ, ২০১৮), অপহরণের পাঁচ ঘণ্টা পর উদ্ধার (প্রথম আলো-১৪ এপ্রিল, ২০১৮), প্রায় পাঁচ মাস পর বাড়ি ফিরলেন নিখোঁজ প্রবাসী যুবক (প্রথম আলো- ০১ জুন ২০১৮), কেনাকাটায় ব্যস্ত মা, সন্তান অপহরণের শিকার! (প্রথম আলো- ০৩ জুন ২০১৮), দিনাজপুরে ঈদের কেনাকাটায় মায়ের সঙ্গে গিয়ে অপহৃত শিশুটি উদ্ধার হয়নি, ফোনে হুমকি (প্রথম আলো- ০৪ জুন ২০১৮), যশোরে অপহরণ করে কলেজছাত্র নির্যাতনের পর ফেরত পাঠানো হলো অ্যাম্বুলেন্সে! (প্রথম আলো- ০৬ জুন ২০১৮),
উপরে বর্ণিত ঘটনা আমাদের নিত্যদিনের সঙ্গী। অপহরণ সম্পর্কে আমাদের সকলের কম বেশি ধারণা আছে। সম্প্রতি অপহরণের ঘটনা তুলনামূলক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। আমাদের সমাজে নারী ও শিশুরা সব চেয়ে বেশি অপহরণের শিকার হয়। অপরহণ থেকে নির্যাতন, খুন ও ধর্ষণ এরকম ঘৃণিত অপরাধ পর্যন্ত হচ্ছে। আপনার পরিবারের কেউ যদি অপহরন হয় তাহলে আপনি কি করবেন? কোথায় মামলা করবেন এবং কি প্রতিকার আছে আমাদের প্রচলিত আইনে । অপহরণ ও আইনগত বিধান ও প্রতিকার নিয়ে আলোচনা করা হলো।
দণ্ডবিধি, ১৮৬০ (১৮৬০ সনের ৪৫নং আইন) ষোড়শ অধ্যায়ে মনুষ্যহরণ, অপহরণ সম্পর্কিত অপরাধের সংজ্ঞা ও শাস্তি সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। দণ্ডবিধি, ১৮৬০ এর ৩৫৯ ধারা মতে মনুষ্যহরণ দুই প্রকারের: বাংলাদেশ হইতে মনুষ্যহরণ এবং আইনানুগ অভিভাবকত্ব হইতে মনুষ্যহরণ। বাংলাদেশ হইতে মনুষ্যহরণ এবং আইনানুগ অভিভাবকত্ব হইতে মনুষ্যহরণ সর্ম্পকে যথাক্রমে ৩৬০ ও ৩৬১ ধারায় আলোচনা করা হয়েছে। যে ব্যক্তি, কোন ব্যক্তিকে উক্ত ব্যাক্তি বা উক্ত ব্যক্তির পক্ষে সম্মতি প্রদানের জন্য আইনানুগ ক্ষমতাপ্রদত্ত কোন ব্যক্তির সম্মতি ব্যাতিরেকে বাংলাদেশের সীমানার বাহিরে বহন করিয়া নেয়, সেই ব্যক্তি উক্ত ব্যক্তিকে বাংলাদেশ হইতে অপরহণ করে বলিয়া গন্য হইবে। যে ব্যক্তি, পুরুষের ক্ষেত্রে ১৪ বৎসরের কম বয়স্ক, বা নারী ক্ষেত্রে ১৬ বৎসরের কম বয়স্ক কোন নাবালক বা কোন অপৃকিতস্থ ব্যক্তির আইনানুগ অভিভাবকের তত্বাবধান হইতে, অনুরুপ অভিভাবকের সম্মতি ব্যতিরেকে লইয়া বা প্রলুদ্ধ করিয়া লইয়া যায়, সেই ব্যক্তি অনুরুপ নাবালক বা অপ্রকৃতিস্থ ব্যক্তিকে আইনানুগ অভিভাবকত্ব হইতে অপহরণ করে বলিয়া গন্য হইবে।
দণ্ডবিধি, ১৮৬০ এর ৩৬২ ধারায় অপহরণ এর সংজ্ঞা প্রদান করা হয়েছে। যে ব্যক্তি, কোন ব্যক্তিকে কো স্থান হইতে গমন করার জন্য জোরপূর্বক বাধ্য করে বা কোন প্রতারণামূলক উপায়ে প্রলব্ধু করে, সেই ব্যক্তি উক্ত ব্যক্তিকে অপহরণ করেছে বলিয়া গন্য হইবে।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ (২০০০ সনের ৮ নং আইন) ২ নং ধারার (খ) উপধারায় অপহরণ এর সংজ্ঞা আলোচনা করা হয়েছে। “অপহরণ” অর্থ বলপ্রয়োগ বা প্রলুব্ধ করিয়া বা ফুসলাইয়া বা ভুল বুঝাইয়া বা ভীতি প্রদর্শন করিয়া কোন স্থান হইতে কোন ব্যক্তিকে অন্যত্র যাইতে বাধ্য করা;
দণ্ডবিধি, ১৮৬০ এর ৩৬৩ ধারায় মনুষ্যহরণের শাস্তি সর্ম্পকে বিধান করা হয়েছে। যে ব্যক্তি, কোন ব্যক্তিকে বাংলাদেশ হইতে বা আইনানুগ অভিভাবকত্ব হইতে হরণ করে, সেই ব্যক্তি যেকোন বর্ণনার কারাদণ্ডে যাহার মেয়াদ সাত বৎসর পর্যন্ত হইতে পারে- দণ্ডিত হইবে এবং তদুপরি অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হইবে।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ এর ৭ ধারা অনুসারে যদি কেউ নারী বা শিশুকে অপহরণ করেন, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে বা অন্যুন চৌদ্দ বৎসর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন এবং ইহার অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হইবেন।
অনেক সময় দেখা যায় খুন করার উদ্দেশ্য মনুষ্যহরণ কিংবা অপহরণ করা হয়ে থাকে । দণ্ডবিধির ৩৬৪ ধারায় উক্ত অপরাধ সর্ম্পকে আলোচনা করা হয়েছে। যে ব্যক্তি, কোন ব্যক্তিকে এইরূপ উদ্দেশ্য অপহরণ বা হরন করে যাহাতে অনুরূপ ব্যক্তি খুন হইতে পারে বা তাহার এইরূপ ব্যবস্থাপনা হইতে পারে, যাহাতে সে খুনের বিপদ কবলিত হইতে পারে, সেই ব্যক্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে বা সশ্রম কারাদণ্ডে-যাহার মেয়াদ দশ বৎসর পর্যন্ত হইতে পারে- দণ্ডিত হইবে এবং তদুপরি অর্থদণ্ডে ও দণ্ডনীয় হইবে।
দশ বৎসরে কম বয়স্ক কোন ব্যক্তিকে অপহরণ বা হরন করার সর্ম্পকে দণ্ডবিধির ৩৬৪ক ধারায় আলোচনা করা হয়েছে। যে ব্যক্তি, এই উদ্দেশ্যে দশ বৎসরের কম বয়স্ক কোন ব্যক্তিকে অপহরণ বা হরণ করে যে, উক্ত ব্যক্তিকে খুন করা যাইতে পারে, কিংবা তাহাকে গুরুতর আঘাত বা দাসত্ব বা কোন ব্যক্তি কাম-লালসার বশে আনা যাইতে পারে, অথবা তাহার এইরূপ ব্যবস্থাপনা করা যাইতে পারে, যে তাহার খুন হওয়ার, কিংবা গুরুতর আঘাতপ্রাপ্ত হওয়ার বা দাসত্ব বা কোন ব্যক্তির ব্যক্তির কাম-লালসার বশীভূত হওয়ার আশংকা থাকে, সেই ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ডে বা যাবজ্জীন কারাদণ্ডে বা সশ্রম কারাদণ্ডে- যাহার মেয়াদ চৌদ্দ বৎসর পর্যন্ত হইতে পারে-দণ্ডিত হইবে এবং তদুপরি অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হইবে। কোন ব্যক্তিকে গোপনভাবে ও অবৈধভাবে অবরোধ করার উদ্দেশ্য অপহরণ বা হরণ করা হলে, সেই ব্যক্তি যেকোন বর্ণনার কারাদণ্ডে-যাহার মেয়াদ সাত বৎসর পর্যন্ত হইতে পারে- দণ্ডিত হইবে এবং তদুপরি অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হইবে।
যদি কোন ব্যক্তি অপহরণ করার কাজে সহায়তা বা প্ররোচনা দেন দণ্ডবিধির ১০৯ ধারার অধিনে সহায়তা করলে সহায়তাকারীকে সেই অপরাধের জন্য যেরূপ শাস্তি নির্ধারিত রয়েছে তাই দেওয়া হবে। তবে যদি দণ্ডবিধির অধিনে আলাদা কোন শাস্তির বিধান এমন অপরাধে সহায়তাদানকারীর জন্য রাখা হয় সেক্ষেত্রে ভিন্ন কথা, যে আলাদা শাস্তি বিধান রাখা থাকবে সেরূপ শাস্তিই তখন সহায়তাকারীকে দিতে হবে। এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ এর ৩০ ধারা অনুসারে যদি কোন ব্যক্তি এই আইনের অধীন কোন অপরাধ সংঘটনে প্ররোচনা যোগান এবং সেই প্ররোচনার ফলে উক্ত অপরাধ সংঘটিত হয় বা অপরাধটি সংঘটনের চেষ্টা করা হয় বা কোন ব্যক্তি যদি অন্য কোন ব্যক্তিকে এই আইনের অধীন কোন অপরাধ সংঘটনে সহায়তা করেন, তাহা হইলে ঐ অপরাধ সংঘটনের জন্য বা অপরাধটি সংঘটনের চেষ্টার জন্য নির্ধারিত দণ্ডে প্ররোচনাকারী বা সহায়তাকারী ব্যক্তি দণ্ডনীয় হইবেন।
অপহরণ এর মামলা নিকটস্থ থানায় এজাহার দায়ের মাধ্যমে দায়ের করা যায় কিন্তুু যদি থানার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মামলা গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানায় তাহলে আদালতে মামলা দায়ের করা যায়।