প্রিন্ট সংস্করণ॥ইসহাক খান
অক্টোবর ২৮, ২০১৮, ০৮:০৭ পিএম
আমার ছোট ভাইয়ের ছেলে সাম্য ভীষণ মেধাবী। এসএসসিতে গোল্ডেন জিপিএ পেয়েছে। তার অর্থ প্রতিটি সাবজেক্টে সে মার্কস পেয়েছে নব্বইয়ের ঘরে। বিরাট সাফল্য। আমরা গোটা পরিবার তার সাফল্যে উৎফুল্ল। এবার এইচএসসি পরীক্ষার পর তাকে জিজ্ঞেস করলাম, পরীক্ষা কেমন হয়েছে, লাজুক স্বভাবের ছেলেটি মাথা নামিয়ে শুধু বলল, আশানুরূপ হয়নি। পরীক্ষার রেজাল্ট বের হলো। আমি অপেক্ষা করছি আমার ছোট ভাই অথবা সাম্য আমাকে ফোন দেবে। এসএসসির রেজাল্টের সময় সাম্য নিজেই ফোন দিয়েছিল। মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে নিজেই বাসায় এসে হাজির হয়েছিল। একটি মিষ্টি নিয়ে আমার সামনে দাঁড়িয়ে বলেছিল, বড় আব্বা, আমি নিজ হাতে তোমাকে মিষ্টি খাওয়াব। আমি প্রতিবাদ করে বলেছিলাম, মিষ্টি তোর প্রাপ্য। তুই ভালো রেজাল্ট করে পরিবারের মুখ উজ্জ্বল করেছিস।অথচ দুই দিন পার হয়ে গেল আমি সাম্যর রেজাল্ট জানতে পারছি না। বাসায় চলে গেলাম ছোট ভাইয়ের। ব্যাপার কী? তোরা কেউ আমাকে সাম্যর রেজাল্ট জানাচ্ছিস না কেন? আমার এই প্রশ্নে আমার ছোট ভাই, ছোট ভাইয়ের স্ত্রী ও সাম্য সবাই মাথা নামিয়ে নিশ্চুপ হয়ে গেল। আমি ধরে নিলাম রেজাল্ট খারাপ হয়েছে। কিন্তু কতটা খারাপ? ছোট ভাইকে ধমক দিয়ে বললাম, কী হয়েছে? সাম্য কি ফেল করেছে?ছোট ভাই বলল, না। ফেল করেনি। তবে আশানুরূপ ফল করেনি।‘কেমন করেছে?’ ‘এ পেয়েছে।’ এসএসসিতে গোল্ডেন জিপিএ পেয়েছিল, এইচএসসিতে গোল্ডেন তো দূরের কথা এ প্লাসও পায়নি। আর তাতেই সবার মন খারাপ। আমার ছোট ভাই তার ধ্যান-জ্ঞান ছিল ছেলেকে নিয়ে। অফিস থেকে বেরিয়ে অন্য কোথাও না গিয়ে সোজা বাসায় চলে আসত। এসেই ছেলেকে নিয়ে পড়াতে বসে যেত। ছেলেও মাশাআল্লাহ এ যুগের ছেলে না। বাজে আড্ডা দেয় না। ধূমপান করে না। সন্ধ্যায় সিঁড়িতে বসে বন্ধুদের সঙ্গে গুলতানি মারে না। যথার্থ অর্থে সে ভালো ছেলে। সেই ছেলের এমন রেজাল্টে ছোট ভাই এবং তার স্ত্রী মুষড়ে পড়েছে।জিজ্ঞেস করলাম এমন হওয়ার কারণ কী? ছোট ভাই খেদের সঙ্গে বলল, রাত জেগে মোবাইল টিপে। ফেসবুক না কী বলে, তাই টিপাটিপি করে।আমি ধমকে বললাম, এই কথা আমাকে আগে বলিসনি কেন? আমি ওকে বুঝিয়ে এই পথ থেকে সরিয়ে আনতাম।সাম্যকে কাছে ডেকে বললাম, ফেসবুক ব্যবহার করো। আমাকে অ্যাড করোনি কেন? এ কথায় লজ্জায় যেন নুইয়ে পড়ল। বলল, তোমাকে অ্যাড করতে সাহস পাইনি।ফেসবুকও ড্রাগের মতোই কঠিন আসক্তি। সেই আসক্তিতে সব ছেড়ে নেশার মতো পড়ে থাকে মোবাইল নিয়ে। আমি এক বাসায় গিয়ে হতবাক। বাসার সব সদস্য যার যার মতো নিজেদের রুমে মোবাইলে ফেসবুক নিয়ে ব্যস্ত। আমি যে একজন মানুষ সেখানে গেছি, এটা যেন কোনো গ্রাহ্যের মধ্যেই তারা আনতে চাচ্ছে না। ফেসবুকের নেশায় বুঁদ হয়ে আছে। এই নেশা আমাকেও পেয়ে বসেছিল কিছু দিন। নতুন নতুন আমিও নাওয়া-খাওয়া ভুলে ফেসবুক নিয়ে মেতে ছিলাম। কিন্তু সেই নেশা থেকে বেরিয়ে আসতে ভীষণ কষ্ট হয়েছে। আমার ইচ্ছাশক্তির কাছে নেশা পরাজিত হয়েছে।আমি সাম্যকে বললাম, ফেসবুক তোমার কতটা ক্ষতি করেছে এবার হিসাব করে দেখো। উচ্চশিক্ষার জন্য তুমি ভালো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারবে না। তাহলে কেমন হলো ব্যাপারটা?সাম্য আমাকে কথা দিল ক্ষতি যা হওয়ার হয়েছে। আর যাতে ক্ষতি না হয় সে ব্যাপারে ভীষণ সচেষ্ট থাকবে। এ সমস্যা শুধু আমার পরিবারে না। বোধ হয় অনেক পরিবারের সঙ্গে এই গল্প মিলে যাবে।বিজ্ঞানের আবিষ্কারের মধ্যে বরাবরই দুটি দিক আছে। একটা ভালো দিক, আরেকটা খারাপ দিক। ফেসবুক যেমন সম্পর্কের নতুন দিগন্ত তৈরি করেছে তেমনি নানা ধরনের ক্রাইমেরও জন্ম দিচ্ছে। কিছু দিন আগে দেখলাম ফেসবুক লাইভে এসে কেউ কেউ নানা ধরনের গুজব ছড়াচ্ছে। তাই নিয়ে দেশজুড়ে হুলুস্থুল কা-।
ডিনামাইট আবিষ্কৃত হয়েছিল পাহাড় ধ্বংস করে রাস্তা তৈরির কাজে। সেই ডিনামাইট ব্যবহার শুরু হলো মানুষ হত্যায়। এ অবস্থা দেখে ডিনামাইট আবিষ্কারক আলফ্রেড নোবেল অত্যন্ত মর্মাহত হলেন। পরে তিনি তাঁর সমুদয় অর্থ একটি ট্রাস্টির মাধ্যমে একটি পুরস্কারের ব্যবস্থা করে দিয়ে গেলেন। সেই মহৎ কাজের জন্য তিনি অমর হয়ে আছেন। যাযাবর তাঁর ‘দৃষ্টিপাত’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘বিজ্ঞান দিয়েছে বেগ, কেড়ে নিয়েছে আবেগ।’মোবাইল আমাদের যোগাযোগের ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন করেছে। কিন্তু উল্টো যে কাজটি হয়েছে, তা হলো মানুষ আর চিঠি লেখে না। চিঠি যে মহৎ সাহিত্য হতে পারে সেটা রবীন্দ্রনাথ আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে গেছেন। কিন্তু আমরা আর চিঠি লিখি না। লেখার প্রয়োজন পড়ে না। একসময় ঢাকার জিপিও অফিস ভীষণ রমরমা ছিল। জিপিওতে অনেক কাউন্টার, সব কাউন্টারেই থাকত লম্বা লাইন। কর্মচারীদের কথা বলার সুযোগ ছিল না। আর এখন? যাঁরা জিপিওর আগের অবস্থা দেখেছেন তাঁরা বর্তমান অবস্থা দেখলে ভীষণ হতাশ হবেন। মন খারাপ হবে। মনে হবে জিপিও যেন মৃত সাপ। নির্জীব পড়ে আছে। কোলাহলহীন, কর্মচারীরা অলস সময় কাটাচ্ছেন। দেখে ভীষণ মায়া হয়।ওই যে, চিঠি লেখার জায়গা দখল করেছে প্রযুক্তি। চিঠি লেখার আর প্রয়োজন হয় না। পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে আমরা মুহূর্তে কথা বলতে পারি এবং তার ভিডিও দেখতে পারি। সবই বিজ্ঞানের আশীর্বাদ। কিন্তু অভিশাপ হলো আমরা গ্রন্থ পাঠ থেকে ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছি। জাতির মননে তার ভয়ংকর প্রভাব পড়ছে এবং পড়বে। আমাদের মেধার বিস্তৃতি ঘটবে না। আমরা আমাদের মেধার যথাযথ ব্যবহার করতে পারব না। একসময় আসবে আমরা সত্যিকার সাহিত্য সংস্কৃতি থেকে দূরে সরে যাব।নতুন প্রজন্ম বইমুখী নয়। তারা যতটা প্রযুক্তিনির্ভর ততটা গ্রন্থবিমুখ। তারা মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানে না। তারা মুক্তিযুদ্ধের বীরদের সম্পর্কে জানে না। তারা পৃথিবী সৃষ্টির ইতিহাস জানে না। ভূগোল সম্পর্কে জানে না। এমনকি ধর্ম সম্পর্কেও জানে না। যা জানে সেটা ফেক। শোনা কথা মাত্র। আর এই সুযোগে অনেক ভ- ধর্ম নিয়ে ব্যবসা করার মওকা পাচ্ছে। সেই সুযোগটা আমরা নিজেরাই তৈরি করে দিচ্ছি।দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, পৃথিবীর উন্নত দেশগুলো তারা প্রযুক্তির উন্নতির পরও গ্রন্থবিমুখ হয়নি। কিন্তু আমরা হয়েছি। এমনিতে আমাদের পাঠাভ্যাস কম। তার ওপর প্রযুক্তি সেই ধারাকে আরো বেগবান করেছে। আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানে উন্নত না হলে শুধু প্রযুক্তি আমাদের কোনো কাজে আসবে না। একসময় সবই বোঝা হয়ে চেপে বসবে আমাদের ঘাড়ে। আমাদের মন ও মনন শাণিত করতে যথেষ্ট পাঠাভ্যাস বাড়াতে হবে। আমরা নিজেরা সেদিকে না গিয়ে উল্টো নিজেরাই আরো স্থবির হয়ে পড়ছি। তরুণ প্রজন্মের কাছে একমাত্র চাওয়া শুধু প্রযুক্তিনির্ভর হলে তোমাদের মেধা একসময় মুখ থুবড়ে পড়বে। তোমাদের এগিয়ে যেতে হবে পৃথিবীর অন্য দেশের মেধাবীদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। তার জন্য দরকার জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা। বেশি করে পাঠাভ্যাস গড়ে তোলা। পাড়ায় পাড়ায় লাইব্রেরি গড়ে উঠুক। একসময় যেটা ঐতিহ্য হিসেবে প্রতিটি গ্রামে ছিল। আবার সেই আন্দোলনে তরুণসমাজকে উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছি, তোমরা ভুল পথে সময় নষ্ট কোরো না। তাকিয়ে দেখো সামনে জ্ঞানচর্চার খোলা মাঠ অনাদরে-অবহেলায় পড়ে আছে। তাকে পরম মমতায় বুকে টেনে নাও। মগ্ন হও জ্ঞানচর্চায়। না হলে চরম মূল্য দিতে হবে তোমাদের, নতুন প্রজন্মকে।
লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, গল্পকার ও টিভি নাট্যকার।