প্রিন্ট সংস্করণ
নভেম্বর ১৪, ২০১৮, ০৭:১৯ পিএম
বেশ কয়েক দিন ধরে দুর্জয় স্কুলে যাওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। স্কুলে যাওয়ার সময় হলেই নানা অজুহাতে স্কুল কামাই করতে চায় সে। কখনও পেট ব্যথা, কখনও বা মাথা ব্যথা বলে বিছানায় পড়ে থাকে দুর্জয়। অথচ দুর্জয় কখনও এমনটি ছিল না। স্কুলে যাওয়ার সময় হলেই নিজে নিজেই তৈরি হয়ে স্কুলে যাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে উঠতো। লেখাপড়া ছাড়াও ছবি আঁকতে পছন্দ করতো দুর্জয়। টিভিতে কার্টুন দেখা থেকে শুরু করে এটা-ওটা নিয়ে মেতে থাকতো সারাদিন। অথচ দিনে দিনে সবকিছুতেই ওর আগ্রহ কমতে থাকে, এমনকি খাবারের প্রতিও অনীহা আর অরুচি বেড়ে যায় ফলে ঘন ঘন শরীর খারাপ হতে তাকে দুর্জয়ের। দুর্জয়ের এ অবস্থায় ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায় ওর মা। শিশু ও মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ দুর্জয়ের কাছে ওর স্কুলের কথা জানতে চান। ডাক্তারের সাথে গল্প করতে করতে একপর্যায়ে দুর্জয় ডাক্তারকে জানায়, স্কুলের কয়েকজন বন্ধু দুর্জয়কে ‘মটু’ বলে খেপায়। ওর স্থূল শরীর দেখে হাসাহাসি করে বন্ধুরা। এছাড়াও এ অবস্থায় স্কুলের যে কোন খেলাধুলার প্রতিযোগিতায় স্থূল শরীরের জন্য দুর্জয় কিছুতেই পাল্লা দিয়ে উঠতে পারে না। এ নিয়েও অনেক সময় হাসি-তামাশায় বিরক্ত হয় দুর্জয়। এ নিয়ে দুর্জয়ের সাথে বন্ধুদের কয়েকজনের ঝগড়াও হয়েছে বেশ কয়েকবার। ডাক্তার জানান, দুর্জয় স্কুলে বুলিংয়ের শিকার। স্কুলে শিশুরা প্রায়ই অন্য শিশুকে অপদস্থ করে, ব্যঙ্গাত্মক নামে ডাকে- উপহাস করে। একই শ্রেণির বা অন্য শ্রেণির শক্তিশালী শিশুরা দলবদ্ধভাবে দুর্বল বা অন্য কাউকে উত্ত্যক্ত করে, ভয়ভীতি দেখায়। এ জন্য স্কুলে গেলেই দুর্জয়ের বন্ধুরা ওকে উত্ত্যক্ত করবে, আবারও ঝগড়া-বিবাদ হবে। এ কারণে ও স্কুলে যেতে ভয় পায় দুর্জয়। এই বিষয়টিই ‘বুলিং’ নামে পরিচিত। প্রকৃতিগতভাবেই প্রতিটি শিশুই সহজ-সরল হয়েই জন্মায়। তবে অপেক্ষাকৃত বেশি সহজ মনের এবং যে কোন শারীরিক সমস্যাগ্রস্ত শিশুরা সহপাঠী বন্ধু বা স্কুলের ওপরের শ্রেণির চঞ্চলমতি শিশুদের দ্বারা বুলিংয়ের শিকার হতে পারে। শারীরিক স্থূলতা অথবা অতিরিক্ত ওজন, রুগ্ন, কথা বলতে তোতলানো কিংবা ক্লাসে পড়া বলতে না পারার জন্য সহপাঠী বন্ধুদের দ্বারা বুলিংয়ের শিকার প্রায়ই লক্ষ্য করা যায়। এ ছাড়াও সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বা ভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সদস্যরাও অন্য ধর্ম-বর্ণের শিশুদের দ্বারা বুলিংয়ের শিকার হতে পারে। যারা এ ধরনের ঘটনার জন্য দায়ী তারাও সুস্থ নয়। বুলিং সমস্যা আমাদের দেশে নতুন কিছু নয়। শুধু শিশুরা কেন, বড়রাও অনেক সময় বুলিংয়ের শিকার হতে পারেন। তবে এ জন্য শিশুদের সমস্যা কখনও কখনও মারাত্মক হতে পারে। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সস্টিটিউটের ডা: মুনতাসীর মামুন বলেন, বুলিংয়ের শিকার শিশুরা হীনমন্যতায় ভোগে, হতাশ বোধ করে, বিষণœতা ও অন্যান্য শারীরিক সমস্যায় আক্রান্ত হয়। তাদের আত্মবিশ্বাস কমে যায়, স্কুল ভীতি বৃদ্ধি পায়। এতে ফলাফল খারাপ হয়ে এক সময় পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এসব শিশুদের বড় হওয়ার পরও মানসিক সমস্যা থেকে যেতে পারে। এমন কি বুলিংয়ের শিকার শিশুরা আত্মহত্যার পথও বেছে নিতে পারে। এ সমস্যাটিকে কিছুতেই খাটো করে দেখা ঠিক নয়। কোন শিশু হঠাৎ করে স্কুলে বা খেলাধুলার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেললে এবং শারীরিক অসুস্থতার কথা বললে বিষয়টিকে খুবই গুরুত্ব দিতে হবে। সত্যিকার অর্থে শিশুটির কোন শারীরিক সমস্যা রয়েছে কিনা, এ জন্য শিশুরোগ বিশেষজ্ঞের সাথে যোগাযোগ করতে হবে। প্রয়োজন হলে শিশুটিকে মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে যেতে হবে, পরামর্শ নিতে হবে। স্কুল ও খেলাধুলার বন্ধুদের দ্বারাই যেহেতু শিশুটি বুলিংয়ের শিকার সে কারণে এ দু’টি ক্ষেত্রে বিশেষভাবে নজর দিতে হবে অভিভাবক ও শিক্ষকদের। ক্লাসে যাতে প্রতিটি শিশু একে অন্যের বন্ধু হতে পারে সে জন্য শিক্ষকদের নজরদারি থাকা দরকার। শিশুদের বোঝাতে হবে যে, ধনী-গরীব, হিন্দু-মুসলমান অর্থাৎ জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে প্রতিটি শিশুই একজন মানুষ। ‘সবার ওপরে মানুষ’ এ সত্য প্রতিটি শিশুর মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পারলে বুলিং প্রতিরোধ করা কঠিন কিছু নয়। বুলিং প্রতিরোধে স্কুল কর্তৃপক্ষ ও অভিভাবকদের সচেনতার কোন বিকল্প নেই। (বাসস ফিচার)