Amar Sangbad
ঢাকা বুধবার, ২৮ মে, ২০২৫,

বিশ্ব নবী (স.)-এর জীবনী ও তাঁর জন্মলগ্নের কিছু বিস্ময়কর ঘটনা

প্রিন্ট সংস্করণ॥জিয়া উল ইসলাম

নভেম্বর ২০, ২০১৮, ০৮:১৪ পিএম


বিশ্ব নবী (স.)-এর জীবনী ও তাঁর জন্মলগ্নের কিছু বিস্ময়কর ঘটনা

জন্মের সাথে সাথেই বিস্ময়কর ঘটনা:- বিশ্ব শান্তির অগ্রদূত ছিলেন মুহাম্মদ (স.)। তাঁর জন্ম যেমনিভাবে ছিল বিশ্ববাসীর জন্যে এক রহমত স্বরূপ তেমনিভাবে তার জন্মের সাথে সাথেই কিছু বিস্ময়কর ঘটনা ঘটে ছিল। যার মাধ্যমে বিশ্ববাসী বুঝতে পেরেছিল যে, তিনি কোন সাধারণ মানুষ নয়। তিনি অবশ্যই হবেন একজন মহামানব। তাঁর জন্মের ৫০ দিন পূর্বে বায়তুল্লাহ আক্রমণকারী ইয়ামানের শক্তিশালী বাদশাহ আব্রাহা তার সৈন্যসহ সমূলে ধ্বংস হয়েছিল। মক্কায় তখন মহা দুর্ভিক্ষ চলছিলো, তিনি তাঁর মায়ের গর্ভে আসার সাথেই দুর্ভিক্ষ অবসান হয়ে গিয়েছিল। হারিয়ে যাওয়া যমযম কূপের সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল। তাঁর মা জননী আমেনা বর্ণনা করেন, মুহাম্মদ তাঁর পেটে অবস্থান নেয়ার সাথেই সারা বিশ্বে আলোক রশ্মি ছড়িয়ে পড়েছিল, যার সাহায্যে তিনি সুদূর সিরিয়ার রাজ প্রাসাদসমূহ পরিস্কার দেখতে ছিলেন। এমনিভাবে আরো অসংখ্য ঘটনা পৃথিবীতে ঘটছিল। তিনি যখন জন্মগ্রহণ করলেন, মক্কায় তখন ভূ-কম্পনের দ্বারা মূর্তিগুলো ভেঙে চুরমার হয়েগিয়েছিল। জ্বিনদের আসমান থেকে সংবাদ সংগ্রহ করা সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। অপরদিকে পারস্য সম্রাটের রাজমহলে ভূ-কম্পনের আঘাতে রাজমহলের ১৪টি স্থম্ভ ধসে পড়েছিলো। এক দিকে শান্তির আগমন অপরদিকে বাতিলের মাথায় আঘাত। তাইতো আল্লাহপাক ঘোষণা করেছেন, ‘আমি সত্য দ্বারা আঘাত হানি মিথ্যার ওপর, ফলে সত্য মিথ্যাকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেয় এবং তৎক্ষণাৎ মিথ্যা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।’

রাসূল (সা.)এর বংশ পরিচয়:- তিনি মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে আব্দুল মুত্তালিব ইবনে হাশেম। হাশেমের দিকে সম্পর্কযুক্ত করে নবীজীর বংশ হাশেমী বংশ হিসেবে পরিচিত। আর হাশেম ছিলেন কুরাইশ গোত্রের যা আদনান পর্যন্ত পৌঁছেছে।

জন্ম ও শৈশব:- মুহাম্মদ (সা.) ৫৭০ সালে , হস্থী বাহিনী ধ্বংসের বছর জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জন্মের ৬ মাস পূর্বেই তার পিতা আব্দুল্লাহ ইবনে আব্দুল মুত্তাল্লিব সফররত অবস্থায় মদিনায় ইন্তেকাল করেন । তসে সময়ের। ঐতিহ্য অনুযায়ী সম্ভান্ত আরব পরিবারের সন্তানদেরকে অন্য গোত্রে লালন-পালন করতে দেওয়া হত। সে হিসেবে নবী করীম (সা.) বনী সা‘দ গোত্রে লালিত- পালিত হন এবং চার অথবা পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত সেখানেই বসবাস করেন। আর সেখানেই তাঁর বুক বির্দীণের ঘটনা ঘটে।

নবী করীম (সা.)এর মাতা ও দুধ মাতাগণ :- স্বীয় মাতা আমেনা বিনতে ওয়াহাব হালিমা -তু- সা‘দিয়াহ আবূ লাহাবের বাঁদী সুয়াইহাব। মায়ের মৃত্যু:- নবী করীম (সা.) এর মাতা আমেনা মদিনা মুনাওয়ারায় নিজ স্বামী আব্দুল্লাহ এর কবর যিয়ারতের পর ফেরার পথে মক্কা ও মদিনার মাঝে অবসিত আবহাওয়া নামক স্থানে ইন্তেকাল করেন। তখন নবী মুহাম্মদ (সা.) এর বয়স ছিল মাত্র ছয় বছর।

দাদা ও চাচার তত্ত্বাবধানে :- মাতা-পিতার মৃত্যুর পর দাদা আব্দুল মুত্তালিব তাঁর লালন পালনের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। তিনি তাঁকে খুব স্নেহ করতেন। এমনকি নিজের ছেলেদের ওপরও তাঁকে প্রাধান্য দিতেন। নিজের আসনে বসাতেন। দাদার মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি তাঁর তত্ত্বাবধানেই ছিলেন। দাদা আব্দুল মুত্তালিবের মৃত্যুর পর চাচা আবু তালিব তাঁর দায়িত্ব নেন। তখন তার বয়স ছিল আট বছর। তিনি স্বীয় চাচাকে বকরী লালন- পালন ও শাম দেশের ব্যবসায়ে সহযোগিতা করতেন।

খাদীজা (রা.) এর সাথে বিবাহ এবং সন্তান:- পঁচিশ বছর বয়সে খাদীজা (রা.) কে বিবাহ করেন। একমাত্র ইবরাহীম ব্যতীত তাঁর সব কয়টি সন্তান খাদীজার (রা.) এর গর্ভ থেকেই হয়েছে। কাসেম তাঁর প্রথম সন্তান। এর নামেই তাঁর উপনাম আবুল কাসেম। অতঃপর যয়নব, রূকাইয়া, উম্মে কুলসুম, ফাতেমা ও আব্দুল্লাহ (রা) এর জন্ম হয়। তাঁর ছেলের সকলেই বাল্য বয়সে মারা যান। মেয়েদের সকলেই ইসলাম গ্রহণ করে হিযরত করার সুযোগ পান। ফাতেমা (রা.) ব্যতীত তাদের সকলেই নবীজীর জীবদ্দশায় মারা যান। তিনি নবীজীর ইন্তেকালের ছয় মাস পর মৃত্যুবরণ করেন।

নবুওয়্যাত পূর্ব গুণাবলি:- তিনি ছিলেন চিন্তায় সঠিক, সিদ্ধান্তে নির্ভুল, ব্যক্তিত্বে অনন্য, চরিত্রে শ্রেষ্ঠতর, প্রতিবেশী হিসেবে অতি মর্যাদাবান, সহনশীলতায় সুমহান, সত্যবাদিতায় মহত্ত্বর। সচ্চরিত্র, বদান্যতা, পুণ্যকর্মা, প্রতিশ্রুতি রক্ষা ও বিশ্বসতায় অনুপম আদর্শ। এসব গুণে মুগ্ধ হয়ে তার গোত্র তাঁকে আল-আমীন উপাধিতে ভূষিত করে।

ওহি নাযিলের সূচনা:- তিনি মক্কায় অবস্থিত হেরা গুহায় ইবাদত করতেন। চল্লিশ বছর বয়সে তিনি নবুয়ত প্রাপ্ত হন। জিবরাইল আ. আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে ওহী নিয়ে অবতরণ করেন। সর্ব প্রথম সূরা ‘আলাকের প্রথম পাঁচটি আয়াত নাযিল হয় : যার অর্থ- পাঠ করুন, আপনার পালন কর্তার নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টি করেছেন মানুষকে জমাট রক্ত থেকে। পাঠ করুন, আপনার পালনকৃত মহা দয়ালু। যিনি কলম দ্বারা শিক্ষা দিয়েছেন। শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে যা সে জানত না। (সূরা আলাক:১-৫)। দাওয়াত:- নবী করীম (সা.) স্বীয় প্রতিপালকের আদেশ যথাযথ পালন করেন এবং গোপনে গোপনে মানুষের মাঝে ইসলাম প্রচার করতে শুরু করেন। যাতে করে কুরাইশদের বিরোধিতা প্রকট না হয়। তিনি সর্বপ্রথম আপন পরিবার- পরিজন ও বন্ধুবর্গকে ইসলামের দাওয়াত দেন। সর্বপ্রথম খাদীজা (রা.) তাঁর দাওয়াত গ্রহণ করেন। পুরুষদের মধ্যে সর্বপ্রথম আবূ বকর সিদ্দীক (রা.) ছোটদের মধ্যে আলী ইবনে আবূ তালিব (রা.) এবং ক্রীতদাসদের মধ্যে যায়েদ ইবনে হারেসা (রা.) ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি খাদিজা (রা.) এর ক্রীতদাস ছিলেন। রাসূল (সা.) তিন বছর পর্যন্ত তার নিকটস্থ’ লোকদের মাঝে ইসলাম প্রচারে গোপনীয়তা অবলম্বন করেন। তিনি দারুল আরকাম তথা কুরাইশ নেতা আরকাম ইবনে আবূ আরকামের বাড়িটি মুসলমানদের সম্মেলনস্থল হিসেবে নির্বাচিত করেন।

ঠাট্টা-বিদ্রুপ:- মুশরিকরা নবী আকরাম (সা.) কে বিভিন্ন উপায়ে উপহাস করত। কখনো কখনো তাকে পাগল ও যাদুকর বলত। আবার কখনো বলত কবি ও গণক। অগান্তুক লোকদেরকে তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করতে অথবা কথা শুনতে বাধা দিত। তাঁর চলাচলের রাস্থায় কাঁটা বিছিয়ে রাখত এবং সালাতরত অবস্থায় তাঁর ওপর ময়লা-আবর্জনা নিক্ষেপ করত।

নির্যাতন নিপীড়ন :- মুশরিকরা তাদের মুসলিম গোলামদের ওপর কঠিন নির্যাতন চালাতো। তাদেরকে হাত- পা বেঁধে ভর দুপুরে উত্তপ্ত বালুকারাশিতে শুইয়ে দিত এবং ভারী পাথর দ্বারা তাদের বুক চাপা দিত এবং ছড়ি দ্বারা প্রহার করত ও আগুনের সেঁকা দিত। নির্যাতনের এমন কোন পদ্ধতি নেই যা তারা মুসলমানদের ওপর প্রয়োগ করেনি।

ধৈর্য ও অবিচল:- মুসলমানগণ মুশরিকদের সকল নির্যাতন ও নিপীড়ন ধৈর্য ও দৃঢ়তার সাথে মোকাবিলা করতেন। কেননা নবীকরীম (সা.) তাদেরকে সাওয়াব ও জান্নাত লাভের আশায় বিপদে ধৈর্য ধারণ ও অনড় থাকার পরামর্শ দেন। মুশরিকদের নির্যাতন ভোগ করেছেন এমন কয়েকজন উল্লেখযোগ্য সাহাবী হলেন: বিলাল ইবনে রাবাহ ও আম্মার ইবনে ইয়াসির (রা.) প্রমুখ। তাদের নির্যাতনের শিকার হয়ে শহীদ হয়েছেন ইয়াসির ওসুমাইয়া (রা.)। ইসলামের ইতিহাসে এরাই সর্বপ্রথম শহীদ।

হাবশায় হিজরত:- রাসূল (সা.) কাফেরদের অনবরত নির্যাতনের কারণে সাহাবাগণের প্রতি দয়া পরবশ হয়ে হাবশাতে হিজরত করার নির্দেশ দেন। হাবশার বাদশা নাজ্জাশী ন্যায়পরায়ণ ও দয়ালু ছিলেন বলে হাবশাকেই হিজরতের জন্যে মনোনীত করা হল। নাজ্জাশী ঈসা (আ.) এর অনুসারী ছিলেন। নবুয়্যাতের পঞ্চম বছর মুহাজিরদের প্রথম এ দলে ছিলেন দশ জন পুরুষ ও চার জন মহিলা। তারা কুরাইশদের অজান্তে চুপিসারে হাবশার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। কিছুদিন পর আরো একটি মুহাজির দল তাদের সাথে মিলিত হলেন। পুরুষ, মহিলা, শিশুসহ তাদের মোট সংখ্যাছিল প্রায় একশো জন। বাদশা নাজ্জাশী তাদের সম্মান এবং সুন্দর ব্যবহার করেন পাশাপাশি সেখানে নিরাপদে বসবাস করার অনুমতি দেন।

তায়েফ গমন:- রাসূল (সা.) এর আশ্রয়দাতা চাচা আবূ তালিবের মৃত্যুকে কুরাইশরা সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করল। তার ওপর নির্যাতনের মাত্রা পূর্বের চেয়ে অনেক বাড়িয়ে দেয়। এ কঠিন পরিস্থিতিতে সহযোগিতাও আশ্রয় পাওয়ার আশায় তিনি তায়েফ গমন করলেন। কিন্তু সেখানে উপহাস ও দুর্ব্যবহার ছাড়া আর কিছুই পেলেন না। তারা রাসূল (সাঃ) কে পাথর নিক্ষেপ করে মারাত্মক আহত করে। বাধ্য হয়ে তিনি মক্কায় ফিরে আসেন।

বিভিন্ন গোত্রের নিকট রাসূলের উপস্থিতি:- রাসূল (সা.) হজের মৌসুমে মক্কায় আগত বিভিন্ন গোত্রের নিকট দাওয়াত নিয়ে উপস্থি’ত হন। তাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দেন এবং শত্রুদের থেকে আত্মরক্ষা ও দাওয়াতের নিরাপত্তা বিধানে সহযোগিতা কামনা করেন। তবে কোন গোত্রই এতে সাড়া দিল না। কারণ, কুরাইশরা তাদেরকে ভয়ভীতি প্রদর্শন করে এবং তাদেরকে তার নিকট হতে দূরে রাখার কৌশল অবলম্বন করে। ইত্যবসরে মদীনার নেতৃস্থানীয় ছয়জন লোক রাসূলের সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং কুরাইশদের ভয়ে গোপনে তাঁর হাতে বাইয়াত গ্রহণ করেন। তারা নিজ দেশে প্রত্যাবর্তন করে মানুষের সাথে ইসলাম সম্পর্কে এবং রাসূল (সা.)এর চরিত্র ও দাওয়াতের সত্যতা সম্পর্কে আলোচনা করেন। এবং মদীনাবাসীদের মাঝে ইসলাম প্রচারের কাজ করেন। ফলে অনেকেই ইসলাম গ্রহণ করেন।

আকাবার প্রথম বাইয়াত:- নবুয়্যাতের দ্বাদশ বছর হজ্জের মৌসুমে বার জন লোক মদীনা হতে বের হয়ে মিনাতে আকাবার প্রথম বাইআতের সময় রাসূল (সা.) এর সাথে দেখা করে এবং বাইয়াতে অংশ গ্রহণ করেন। এ বাইয়াতকে ইসলামের ইতিহাসে ‘আল আকাবাতুল উলা’ প্রথম বাইয়াত বলা হয়। মদীনায় ফিরে যাবার সময় রাসূল তাদের সাথে মুস‘আব ইবনে উমায়ের (রা.)কে কুরআন তিলাওয়াত এবং দ্বীন শিখানোর জন্য পাঠান।

হিযরত ও মক্কা ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত:- কুরাইশরা রাসূল (সা.)কে হত্যার ষড়যন্ত্র করে। কিন্তু’ তারা ব্যর্থ হয় এবং আল্লাহ তাআলাকে তাকে হেফাযত করেন। রাসূল (সা.) স্বীয় ঘর থেকে বের হন এবং আল্লাহ তাআলা কাফেরদের চক্ষু অন্ধ করেদেন যাতে তারা রাসূল (সা.) কে দেখতে না পারে। তিনি চলতে চলতে মক্কার বাইরে স্বীয় বন্ধু আবু বকর সিদ্দীক (রা.) এর সাথে মিলিত হন। অতঃপর তারা উভয়ে এক সাথেই পথ চলা আরম্ভ করেন। ‘সওর’ নামক পাহাড়ে পৌঁছে একটি গুহায় তিন দিন পর্যন্ত আত্মগোপন করেন। আব্দুল্লাহ বিন আবূ বকর (রা) তাদের নিকট কুরাইশদের সংবাদ পৌঁছাতেন এবং তার বোন আসমা (রা.) খাদ্য ও পানীয় পৌঁছাতেন। তারপর নবী করীম (সা.) ও তার সঙ্গী গুহা হতে বের হন এবং ইয়াসরিব (মদীনা) অভিমুখে যাত্রা শুরু করেন।

ইয়াসরিবে (মদীনা) নতুন অধ্যায়ের সূচনা:- রাসূল (সা.) মদীনায় পৌঁছে তাকওয়ার ভিত্তিতে ইসলামের সর্বপ্রথম মসজিদ নির্মাণকরেন। বর্তমানে মদীনা শরীফে এ মসজিদটি “মসজিদে কু’বা” নামে পরিচিত। মদীনাতে রাসূলুল্লাহ (সা.) সর্বপ্রথম যে পদক্ষেপ গ্রহণ করেন তা হচ্ছে মসজিদে নববীনির্মাণ এবং মুহাজির ও আনসারদের মাঝে ভ্রাতৃত্ব স্থাপন। প্রথম কাজ ও সর্বপ্রথম পরিকল্পনা যা রাসূল (সা.) নির্ধারণ করেন, তা ছিল মসজিদে নববী নির্মাণ এবং আনসার ও মুহাজিরদের মধ্যে ভ্রাতৃত্বস্থাপন করা।

ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধ:- কুরাইশদের একটি ব্যবসায়ী দল সিরিয়া থেকে বিশাল যুদ্ধসামগ্রী কিনে মক্কা প্রত্যাবর্তন করছে মর্মে সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে। রাসূলুল্লাহ (সা.)এ ব্যাপারে অবগত হলে তাকে বাধা দিতে চাইলেন। কারণ ইতিপূর্বে মক্কাবাসীরা মুহাজিরদের সম্পদ দখল করে নিয়েছিল। ঐ দলনেতা আবূ সুফিয়ান রাসূল (সা.) এর সংকল্পের কথা জানতে পেরে এক লোককে কুরাইশদের নিকট পরিস্থিতি সম্পর্কে সংবাদদানের জন্য পাঠালেন। সংবাদ পেয়ে কুরাইশরা বাণিজ্যিক কাফেলা রক্ষার্থে দ্রুত বের হয়ে আসল। এদিকে আবূ সুফিয়ান আগেই কাফেলাসহ পলায়ন করতে সক্ষম হয় এবং বেঁচে যায়। নবী আকরাম (সাঃ) পরামর্শ করে মুহাজির ও আনসারগণের নিয়ে গঠিত প্রায় তিনশত তের জনের একটি সেনাদল নিয়ে মুশরিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার লক্ষ্যে বের হলেন। হিজরী দ্বিতীয় সনের ১৭ রামাযান বদর নামক স্থানে উভয় দল মুখোমুখি হয় এবং সেখানেই বদর যুদ্ধ সংঘটিতহয়। এ যুদ্ধে মুসলমানরা মহা বিজয় লাভ করেন। এ যুদ্ধে মুসলমানগণ অনেক গনিমতের সম্পদ লাভ করেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) তাদের মাঝে সেগুলো বণ্টন করে দেন। এ যুদ্ধে মোট সত্তুর জন মুশরিক নিহত হয় এবং সত্তুর জন বন্দি হয় আর মুসলমানদের শহীদের সংখ্যা মাত্র চৌদ্দজন।

মক্কা বিজয়:- হুদায়বিয়ার সন্ধির পর নবী আকরাম (সা.) বিভিন্ন গোত্রে তাঁর দাওয়াতী কর্মসূচি অধিক পরিমাণে বিস্তৃতি ঘটাতে সক্ষম হন। ফলে এক বছরের মাথায় মুসলমানদের সংখ্যা অধিক হারে বৃদ্ধি পেল। এরই মাঝে কুরাইশদের সাথে মৈত্রী চুক্তিতে আবদ্ধ বনু বকর মুসলমানদের মিত্র কবীলায়ে খুযা‘আর ওপর আক্রমণ করল। এর অর্থ দাঁড়াল করাইশ এবং তার মিত্ররা হুদায়বিয়ার সন্ধি চুক্তি ভঙ্গ করল। নবী আকরাম (সা.) এ সংবাদ পেয়ে অত্যধিক ক্রুদ্ধ হন এবং মক্কা বিজয়ের উদ্দেশ্যে দশ হাজার যোদ্ধার একটি বিশাল সেনাদল গঠন করেন। তখন ছিল হিজরী অষ্টম বর্ষের রমাযান মাস। এদিকে কুরাইশরা নবী আকরাম (সা.) এর মক্কাভিমুখে অভিযানের সংবাদ পেয়ে তাদের নেতা ও মুখপাত্র আবূ সুফিয়ানকে ক্ষমা প্রার্থনা, সন্ধি চুক্তিবলবৎ এবং চুক্তির মেয়াদ আরো বাড়ানোর প্রস্থাব দিয়ে নবী আকরাম (সা.) এর নিকট প্রেরণ করেন। নবী করীম (সা.) তাদের ক্ষমার আবেদন নাকচ করে দিলেন। কেননা তারা অঙ্গীকার ভঙ্গ করেছে। আবূ সুফিয়ান ইসলাম গ্রহণ ভিন্ন বাঁচার আর কোন উপায় না দেখে ইসলামগ্রহণ করেন। অতঃপর সেনাদল (মক্কাভিমুখে) রওয়ানা হয়ে মক্কার কাছাকাছি আসলে মক্কাবাসী বিশাল দল দেখেআত্মসমর্পণ করে। আর নবী আকর (সাঃ)মুসলমানগণ কে সঙ্গে নিয়ে বিজয়ী বেশে মক্কায় প্রবেশ করেন। অতঃপর নবী আকরাম (সা.) লোকদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন। ঘোষণা করেন মক্কাপবিত্র ও নিরাপদ।

বিদায় হজ্জ:- দশম হিজরী সনে নবী (সা.) মুসলমানদেরকে তাঁর সাথে হজ পালন ও হজের আহকাম শিক্ষা গ্রহণ করতে মক্কা যাবার আহ্বান জানা। তাঁর আহ্বানে এক লক্ষের মত লোক সাড়া দিল। তাঁরা যুলকা’দাহ্ মাসে পঁচিশ তারিখ তাঁর সাথে মক্কা পানে বের হন। বাইতুল্লাহতে পৌঁছে প্রথমে তওয়াফ করেন। অতঃপর যিলহজ্জ মাসের আট তারিখ মিনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। এরপর নয় তারিখ জাবালে আরাফাহ অভিমুখে যাত্রা করেন। রাসূল (সা.) সেথা অবস্থান করেন এবং মুসলমানদের উদ্দেশ্যে তার ঐতিহাসিক অমর ভাষণ দান করে তাদেরকে ইসলামী বিধি-বিধান ও হজের আহকাম শিক্ষা দেন এবং আল্লাহ তাআলার নিম্নোক্ত বাণী তিলাওয়াত করে শুনান- আজ আমি তোমাদের জন্যে তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম। তোমাদের প্রতি আমার নিয়াআমত পরিপূর্ণ করে দিলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্যে দ্বীন হিসেবে মনোনীত করলাম।”

রাসুল (সা.) এর জীবনে যুদ্ধ:- রাসূল (স.) স্বীয় জীবনে সর্বোমোট তেইশটি জিহাদে অংশগ্রহণ করেন। এ সকল জিহাদকে ‘গাযওয়া’ বলা হয়। তন্মধ্যে মোট নয়টি যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। যথা- (১) বদরের যুদ্ধ (২) উহুদের যুদ্ধ, (৩) আহযাবের যুদ্ধ (৪) বনী কুরাইযা যুদ্ধ (৫) মুত্তালিক যুদ্ধ (৬) খাইবার যুদ্ধ (৭) ফাতহে মক্কা যুদ্ধ (৮) হুনাইনের যুদ্ধ এবং (৯) তায়িফের যুদ্ধ। আর রাসূল (সা.) নিজে সশরীরে অংশগ্রহণ না করে অপর কাউকে সিপাহসালার নিযুক্ত করে সাহাবায়ে কেরামকে যে জিহাদ অভিযানে প্রেরণ করেছেন, তাকে ‘সারিয়্যা’ বলে। এ ধরনের জিহাদের সংখ্যা ৪৩টি।

আলাহর সান্নিধ্যে:- বিদায় হজ্জ পরবর্তী বছর নবী আকরাম (স.) জ্বরাক্রান্ত হয়ে অসুস্থ’ হয়ে পড়েন এবং প্রিয় সহধর্মিণী আশেয়া (রা.) এর ঘরে শয্যা গ্রহণ করেন। রাসূল (স.) ৬৩ বছর বয়সে ১১ হিজরীর ১২ রবিউল আউয়াল সোমবার দুপুরের পর মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের ডাকে সাড়া দিয়ে ইহকাল ত্যাগ করে পরপারে গমন করেন। অতঃপর খলীফা নির্বাচনের কাজ সমাধা করে ১৪ই রবিউল আউয়াল রাতে হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (রা.)-এর গৃহে (রওযা মুবারকে ) রাসুল্ (সা.) কে সমাহিত করা হয়।