প্রিন্ট সংস্করণ॥প্রিন্সিপাল মুহাম্মদ আবু হানিফ খান
ডিসেম্বর ১২, ২০১৮, ০৮:১৪ পিএম
মানব জীবনে নানা স্তরে, নানা স্থানে, নানা পর্যায় অভিভাবকত্বের সাথে আমরা বেশ পরিচিত। অভিভাবকত্ব রয়েছে সমাজে, রাষ্ট্রে, প্রতিষ্ঠানে, সংগঠন বা সংস্থায়, আর অভিভাবকত্ব সবচেয়ে বেশি চর্চা দেখি পরিবারের। অভিভাবকের থাকে এক বিশেষ ক্ষমতা। ক্ষমতার কারণে পছন্দ হোক চাই না হোক নিরবে বা সরবে মেনেই চলতে হয় অভিভাবকত্বের নিয়ম-নীতি কখনও বা শাসন বা দুঃশাসন। এবারে আলোচনা পরিবারে অভিভাবকত্ব নিয়ে। তাও আবার সীমাবদ্ধ থাকবে সন্তানের নিকট অভিভাবক আচরণ কখন অপ্রত্যাশিত বা অনাকাংখিত বা অনভিপ্রেত হয় সে বিষয়। সন্তানের প্রত্যাশিত বিকাশ ও উন্নতির পথে নিজ অজ্ঞতা, মূর্খতা, অনভিজ্ঞতা বা জিদ ও স্বার্থের বশে বাধা সৃষ্টি না করার স্বার্থেই এ বিষয় অভিভাবকদের সতর্ক ও সচেতন থাকা চাই। অভিভাবক শব্দটি অভি উপসর্গযোগে গঠিত। অভি শব্দার্থ সম্মুখ, নিকট, সাদৃশ্য। আর ভাবক শব্দার্থ কল্পনাকারী, ভাবনাকারী, চিন্তক। শব্দগত অর্থে অভিভাবক শব্দের অর্থ দাঁড়ায়, যিনি বা যারা অন্যের বর্তমান ও সম্মুখ বিষয়ে চিন্তা করেন বা ভাবেন। অর্থাৎ বর্তমান ও ভবিষ্যত সম্পর্কে কার্যকরভাবে ভাবেন। অন্য বলতে বোঝায় যে ব্যক্তি বা ব্যক্তি সকল অধীন রয়েছেন এমন। এবার জেনে নেই পরিবারে কে কার ও কখন অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করবেন এবং কীভাবে পালন করবেন এ বিষয়। পরিবার নামক এ প্রতিষ্ঠানে পরিবার প্রধান অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করেন। সমাজ-সভ্যতা ও সংস্কৃতি ভেদে পরিবারের কর্তা ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তি হয়ে থাকেন। মাতৃতান্ত্রিক পরিবারে মা, পিতৃতান্ত্রিক পরিবারে বাবা প্রধান অভিভাবক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। দ্বিতীয় অভিভাবকের ভূমিকায় থাকেন কখনো বাবা, কখনো মা । আবার মা-বাবার অবর্তমানে অভিভাবক হন বড় ভাই বা দাদা বা চাচা। অভিভাবকত্ব থাকে সন্তান বা পরিবারের অপ্রাপ্ত বয়স্ক সন্তানের ওপর। একজন গাড়ি চালকের যেমন চালনা জ্ঞান থাকা দরকার তেমন একজন অভিভাবকের জন্যও তার অভিভাবকত্বের দায়িত্ব সুচারুরূপে পালনের প্রয়োজনীয় জ্ঞান থাকা আবশ্যক। অভিভাবক আচরণ হওয়া চাই ইতিবাচক, সৃষ্টিশীল, নমনীয়, বন্ধুত্বপূর্ণ, সহযোগিতামূলক, মহনশীল, শিক্ষামূলক, নির্দেশনামূলক ও দৃষ্টান্তমূলক। শিশুর প্রতি অভিভাবকের আচরণ যখন হয় অনভিপ্রেত তখন তার ফল হয় পীড়াদায়ক, ক্ষতিকারক, যন্ত্রণাদায়ক ও ধ্বংসাত্বক। সমাজ-রাষ্ট্রে দেখা দেয় বিষ্ফোরণোম্মুক্ত পরিবেশ। সৃষ্টি হয় তিক্ত অভিজ্ঞতা। অভিভাবকের কাঙ্খিত দায়িত্ব পালন বর্তায় শিশুর অনাগত অবস্থায়ই। অভিভাবক নিজ সন্তানকে গভীর ভালোবাসা, আদর-সোহাগ ও যতেœ লালন-পালন করে বড় করে তোলেন। সন্তানের সুখ, শখ ও স্বপ্ন পূরণে সময়-শ্রম ও অর্থ ব্যয় করেন। জ্ঞান-বিজ্ঞান, গণিত, শিল্প, সংগীত, নৃত্য, ক্রীড়া, অংঙ্কন, উপাস্থাপনসহ নানা প্রতিযোগিতামূলক বিষয় অংশগ্রহণ ও বিজয়ের লক্ষ্যে অভিভাবকগণ উৎসাহ দেন, সাহায্য-সহযোগিতা করেন এবং এ জন্য যে কোন ত্যাগেও প্রস্তুত থাকেন। শিশুর উজ্জ্বল ভবিষ্যত গড়তে ব্যস্ত অভিভাবক আচরণ যেমন শিশু প্রতিভা বিকাশে সহায়ক হয় আবার কখনও শিশুর সুপ্ত প্রতিভা বিনাশ করে ও জীবন বিষময় করে তোলে। এমন অনভিপ্রেত আচরণ অভিভাবক করেন কখনও বুঝে আবার কখনও না বুঝে কখনও অজ্ঞতা বা জিদের বশে। মানব জীবনে সবচে সুন্দর অংশটুকু হলো শিশুকাল। এ সময়ই তার মধ্যে সফলতা, দক্ষতা ও যোগ্যতার বীজ বপণের সবচে মোক্ষম সময়। এ সময়টি কোনভাবে বিষময় করে তোললে পুরো জীবনটাই হয়ে পড়ে বিপর্যস্ত। শিশু জীবনে যা দেখে তাই শেখে। মানব শিশু জন্মগতভাবে নিরপরাধ হিসেবে জন্মায়। সে অন্যায় করতে জানে না। অন্যায় কাজ ও কথা শিখে নেয় যখন পিতা-মাতা, অভিভাবক বা কাছের মানুষের কাছে। শিশুর সামনে অন্যায় কথা বললে বা অন্যায় কাজ করলে তা দেখে-শুনে শিশু তা শিখে নেয়। এমন সুন্দর মন কলুষিত করার অধিকার অভিভাবক কখনোই পেতে পারেন না। অনাগত শিশু যখন মায়ের পেটে থাকে তখনই শিশুর সাথে কাঙ্খিত আচরণ করা অভিভাবকের পবিত্র কর্তব্য। পৃথিবীর আলো দেখাতে অনুকূল পরিবেশ ও যতœ পাওয়ার অবশ্যই দাবিদার মায়ের গর্ভে থাকা শিশুর। এ সময় মায়ের আচরণ ও মায়ের সাথে অন্যদের আচরণ, মায়ের খাদ্য খাবার সব কিছুতেই অনাগত শিশুটির প্রতি গভীর প্রভাব ফেলে। প্রতিনিয়ত গণমাধ্যম প্রকাশিত সংবাদের ব্যাপক অংশ জুড়ে থাকে মন খারাপ করার মত ঘটনা। সন্তান নিয়ে অনেক সময় অভিভাবকের আতঙ্কের দিন কাটাতে হয়। এ সবই অভিভাবকের অনৈতিক, অযথা আরোপিত, নেতিবাচক ও অবিজ্ঞচিত আচরণের ফল। শিশু জন্মের পর তার যেসব অধিকার অগ্রাধিকার পায়, যেমন তার একটি যুৎসই অর্থবহ সার্থক নাম রাখা। নাম শুধু আলাদা করে চিহ্নিত করার জন্যই নয় বরং নাম মানব জীবনে অনেক প্রভাব ফেলে। আবার কাজে, আচরণে বা চরিত্রের প্রভাবে নাম বা উপাধি তৈরি হয়। জন্মের পর শিশুকে মায়ের বুকের দুধ না দিয়ে কৃত্রিম খাবার চাপিয়ে দেওয়াও শিশুর অধিকার হরণ। পরস্পরের আন্তরিকতা স্নেহবোধ, শ্রদ্ধাবোধ, ভালোবাসা লোপ পাওয়ারও অন্যতম কারণ। পৃথিবীর ভারসাম্য রক্ষা, পৃথিবীকে বাসযোগ্য রাখা ও এর সৌন্দর্য টিকিয়ে রাখতেই সৃষ্টিকর্তা মানব সন্তান আলাদা-আলাদা বৈশিষ্ট্য, গুণাবলী ও যোগ্যতা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। মানব অদৃষ্টও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নির্ধারিত ও অপরিবর্তনীয়। স্কুলে অনুপস্থিত থাকার কারণ স্বরূপ ছোট বেলায় রশিয়ে-রশিয়ে একটি গল্প করতাম। গল্পটি এ রকম, শিক্ষক জিজ্ঞেস করলেন, গতদিন ক্লাসে কেন অনুপস্থিত ছিলে? শিক্ষার্থী জবাব দিল, স্যার, মা বলেছেন ‘তোর জ্বর, তাই তোর স্কুলে যাওয়ার দরকার নাই’ এজন্য আমি গতদিন স্কুলে আসিনি’। অর্থাৎ জ্বর আমার শরীরে দেখা না দিলেও এটি ছিল মায়ের পক্ষ হতে আরোপিত জ্বর। যা বাধ্য সন্তান হিসেবে বাধ্য করেছে এ মিথ্যে জ্বর বইতে। আবার শিশু তার ভবিষ্যত জীবনে কী হবে, কী হবে না তাও অনেক সময় অভিভাবক চাপিয়ে দিয়ে থাকেন শিশুর প্রতি তার আগ্রহ-অনাগ্রহের বিষয় বিবেচনায় না এনেই। এরকম নানা আরোপিত বিষয় চাপিয়ে দেওয়া হতো যদিও তা একদম বাড়াবাড়ির পর্যায় চলে যায়। যা শিশু জীবনে কল্যাণ বা উন্নতির পরিবর্তে কেবল অকল্যাণ বা অবনতিই ডেকে আনে। শিশু মন কাঁদা-মাটির মত নরম হলেও সে কিন্তু কাঁদা-মাটি নয়, তাকে দিয়ে পছন্দসই পুতুল বানানো যায় এমন নয়। শিশু একটি আলাদা স্বত্ত্বা। তারও নিজের পছন্দ-অপন্দ, আগ্রহ-অনাগ্রহের বিষয় থাকে। তার মাঝে বিশেষ লুকায়িত প্রতিভা রয়েছে। তার এ সব কিছু মাথায় না রেখে যখন অভিভাবক শুধু নিজ পছন্দ ও আগ্রহে শিশুর পছন্দে ও আগ্রহের বাইরে বিশেষ বিষয় যোগ্যতার করতে চায়, তখন শিশুর মন থমকে দাঁড়ায়। আগ্রহ বাধাগ্রস্ত হয়। প্রতিভা বিনাশ হয়ে যায়। শিশুর কাছে অভিভাবকের এমন অনাকাঙ্খিত আচরণ অপ্রতাশিত ও অনভিপ্রেত মনে হয়। শিশুর জীবনে সে কী হবে সে সিদ্ধান্ত নেওয়ার বা দেওয়ার মালিক অভিভাবক নয়। অভিভাবকের দায়িত্ব হলো, শিশু যা হতে চায় সে ব্যাপারে সঠিক দিক-নির্দেশনা দেওয়া ও কার্যকর সহযোগিতা করা। শিশুর সামনে অভিভাবকের মিথ্যা বলা শুধু অনভিপ্রেত নয় বরং গুরুতর অপরাধও বটে। যে শিশু জন্মগতভাবে সত্যের ওপর ভিত্তি করে পৃথিবীতে আসে সে শিশুর মনে মিথ্যা নামক বিষবৃক্ষের বীজবপন করা ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। ধুমপায়ী অভিভাবক সন্তানের সামনে ধূমপান করা, সন্তানকে দিয়ে সিগারেট বা নেশাদ্রব্য আনানো, সন্তানের সামনে মিথ্যা বলা, ফাহেশা বা বেফাশ বলা, সন্তানকে মিথ্যা বলতে বলা, ঘরে থেকে আগন্তুকের ডাকে সাড়া না দিয়ে সন্তানকে দিয়ে বলানো বাবা বা মা ঘরে নাই। মোবাইল ফোন সন্তানকে ধরিয়ে দিয়ে বলতে বলা বল, তিনি ঘরে নাই। কারণে-অকারণে শাসন ক্ষমতা প্রদর্শণার্থে ধমকানো। এসব আচরণ সন্তানের জন্য ভয়ানক মাত্রায় অনভিপ্রেত। মা সব সময়ই সন্তানের কাছে বিশেষ সম্মান ও মর্যাদার। সন্তানের সামনেই যখন কোন বাবা মাকে অসম্মানীয় আচরণ করে থাকে, তখন শিশুমন ব্যথিত, মর্মাহত ও বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। এর ফল খুবই ভয়াবহ পরিণতির দিকে ধাবিত হয়। যে মায়ের পায়ের নিচে জান্নাত পাওয়ার কথা, সে মাকে অসম্মান করায় প্রকারান্তরে বাবা নিজেই নিজের প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধাবোধ হারানোর আয়োজন করে থাকেন। এক সময়ের শিক্ষামন্ত্রী ড. ওসমান ফারুক একটি টেলিভিশন চ্যানেলে পারিবারিক সাক্ষাৎকারে মুখোমুখি হয়েছিলেন। ওই অনুষ্ঠানে তার স্ত্রী মন্তব্য করতে গিয়ে তাকে প্রচ- রাগী মানুষ বলেছিলেন। শিক্ষামন্ত্রী তখন বললেন, তার বড় সন্তানের বয়স তখন একুশ বছর। ওই একুশ বছরে তিনি কখনো সন্তানের সামনে স্ত্রীর সাথে রাগ করেননি। মানুষ একে অপরকে কায়িক শক্তি বা ক্ষমতার কারণে সম্মান বা শ্রদ্ধা পোষণ করে না বরং শ্রদ্ধাবোধ তৈরি হয় তার নীতি নৈতিকতা, শিক্ষা ও জ্ঞানের শক্তিতে। কায়িক শক্তি বা ক্ষমতা থাকলেও এ সবের অভাবে সে ভয়ের পাত্র হতে পারে; কিন্তু সে সম্মানের পাত্র হতে পারে না। অপরাধী বা অপশক্তিমান শুধু ভয়ের পাত্রই নন বরং সে ঘৃণার পাত্রও বটে। কথিত বিখ্যাত সাধক নিজামউদ্দিন ডাকাত থাকাকালে তার অন্যায়ের দায়ভাগ পরিবারের কোন সদস্যই নিতে রাজি হয়নি এ ইতিহাস আমাদের জানা রয়েছে। অন্যায়কারীর মূল্যায়ন সবার নিকটই অন্যায়কারী হিসেবেই। হোক না সে মা বা বাবা। অন্যায় উপার্জনে সন্তানের ভরণ-পোষণ করার ব্যবস্থা করা হোক এটি কোন মানব সন্তানের নিকট প্রত্যাশিত হয় না। ভালোর প্রতিদান ভালই হয় আর খারাপের প্রতিদান খারাপই হয়। অন্যায় উপার্জন ও অন্যায় আচরণে লালিত সন্তান মা- বাবার বৃদ্ধাবস্থায় রহমদিল হতে না পারা এ সবেরই বহিঃপ্রকাশ বা প্রতিফল মাত্র। পৃথিবীতে মানব শিশু আগমণের পর প্রথম পরিচয় ঘটে নারীর সাথে।আর সেই হলেন গর্ভধারিনী মা। পরিবারে সাধারণত প্রথম যে পুরুষের সাথে পরিচয় ঘটে তিনি হলেন জন্মদাতা পিতা। এই দুই নারী-পুরুষ কে দেখে শুনে নিষ্পাপ সন্তান ধারণা অর্জন শুরু করে পৃথিবীর নারী-পুরুষ সম্পর্কে। এরা দুজন এই সন্তানের জন্য মডেল হিসেবে ভূমিকা পালন করেন আকৃতিগত মানব সন্তানকে প্রকৃতিগত মানবীয় গুণসম্পণœ আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে। মা-বাবা এ ক্ষেত্রে সন্তানের জন্য হয়ে ওঠেন যেমন লালন-পালনকারী ও রক্ষণাবেক্ষণকারী হিসেবে পাশাপাশি সন্তান তাদের পেতে প্রত্যাশা করে ইতিবাচক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী দক্ষ অভিভাবক, সর্বোত্তম বন্ধু, খেলার সাথী, দিকনির্দেশকারীসহ এরকম সব কিছুতেই। কারিগরের নিপুণ হাতের ছোঁয়ায় যেমন কাঁদা-মাটিও দৃষ্টিনন্দন বস্তুতে পরিণত হয়ে মূল্যহীন যেভাবে অমূল্য হয়ে ওঠে, সন্তানে’র ভবিষ্যত গড়তে অভিভাবকের ভূমিকাও সে রকমই। এসব ক্ষেত্রে কাক্সিক্ষত ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হলে সন্তান ও সমাজের জন্য তা হয় অনভিপ্রেত বা অপ্রত্যাশিত। মানুষ স্বাধীন জীব। মানব সন্তান স্বাধীনভাবেই জন্ম নিয়ে থাকে। তাকে স্বাধীনভাবেই বেড়ে ওঠার সুযোগ ও সহায়তা দান অভিভাবকের দায়িত্ব। তবে মনে রাখা দরকার স্বাধীনতা যেমন লাগামহীনতা নয়; তেমন অভিভাবকত্বও শৃংঙ্খলিত করা নয় এবং অন্যায় পথে ধাবিত করা নয়।