প্রিন্ট সংস্করণ
জানুয়ারি ১১, ২০১৯, ০৮:০১ পিএম
‘মাওলানা’ উপাধি মধ্য এশিয়া ও ভারতীয় উপমহাদেশে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। ‘মাদরাসা’ কিংবা ‘দারুল উলুম’ থেকে স্নাতকোত্তর পাস করা ব্যক্তিকে ‘মাওলানা’ বলা হয়ে থাকে। প্রয়োগের ওপর নির্ভর করে বিভিন্ন শব্দের অর্থের পরিবর্তন ঘটে। ‘মাওলানা’ শব্দটি আরবি, তবে আরব থেকে ইরান, তুর্কি, আফ্রিকা ও ভারত উপমহাদেশ ঘুরে নানা অর্থ পরিগ্রহ করেছে। যেমন ইরানের প্রখ্যাত কবি রুমির নামের আগে ‘মওলানা’ ব্যবহৃত হয়। ‘মাওলানা’ শব্দটির তুর্কি উচ্চারণ হলো ‘মেভলানা’। পশ্চিম আফ্রিকার মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলের ‘হাউসা’ ভাষায় (ঐধঁংধ ষধহমঁধমব) ‘মাল্লাম’ ও ‘উলুফ’ ভাষার (ডড়ষড়ভ ষধহমঁধমব) ‘মাম্মে’ শব্দটি এসব ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। ‘হাউসা’ ভাষার ‘মাল্লাম’ শব্দটি ইংরেজি শব্দের ‘মিস্টার’-এর সমার্থক। ‘হাউসা’ ভাষার ‘মাল্লাম’, শোয়হালি ভাষার ‘মুয়ালিমু’, আরবি ভাষার ‘মু’ আল্লিম’ আর মরোক্কীয় আরবির ‘মা’ আল্লাম’ শব্দটির ইংরেজি অর্থ মাস্টার কিংবা টিচার। ‘মাওলানা’ শব্দটি মুসলিম ধর্মীয় প-িতের ক্ষেত্রে শ্রদ্ধাপূর্ণ অর্থ বহন করে। অন্যদিকে সাধারণ ধর্মীয় ব্যক্তির ক্ষেত্রে উপাধি হিসেবে ‘মৌলভি’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশের সরকারি আলিয়া মাদরাসার আলেমদেরও ‘মৌলভি’ বলা হয় । ‘মাওলানা’ বা ‘মওলানা’ শব্দটি আরবি। এটি ‘মাওলা’ ও ‘না’ দুটি শব্দে ঘটিত। ‘না’ একটি সর্বনাম। এর অর্থ আমরা বা আমাদের। আর ‘মাওলা’ শব্দের প্রায় ৩০টি অর্থ আছে। যেমন প্রভু, বন্ধু, সাহায্যকারী, মনিব, দাস, চাচাতো ভাই, প্রতিনিধি, অভিভাবক, নিকটবর্তী, আত্মীয়, নেতা, গুরু, প্রতিপালক, সর্দার, প্রেমিক, প্রতিবেশী, আনুগত্য, প্রার্থনা, নীরবতা, ইবাদত, দ-ায়মান ইত্যাদি। (সূত্র : বাদায়িউল ফাওয়ায়িদ : ৪/৯৭৮, ফাতাওয়ায়ে আশরাফিয়া, পৃষ্ঠা ৭০, উমদাতুর রিআয়াহ : ২/৩২৮, লিছানুল আরব : ৮/৪৫২, আল-মিসবাহুল মুনির, পৃষ্ঠা ৫৯১) পবিত্র কোরআন ও হাদিসে বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন অর্থে ‘মাওলা’ শব্দটি ব্যবহার হয়েছে। আমাদের কিছুসংখ্যক ভাই সঠিক অনুসন্ধান না করে বলে ফেলেন যে ‘মাওলানা’ শব্দটি আল্লাহর সঙ্গে সুনির্দিষ্ট। তাই মানুষের জন্য এ শব্দ ব্যবহার করা ‘শিরক’! প্রমাণ হিসেবে তাঁরা বলেন, পবিত্র কোরআনে এসেছে, ‘আনতা মাওলানা ফানছুরনা অর্থাৎ আপনিই আমাদের অভিভাবক। সুতরাং আপনি আমাদের সাহায্য করুন।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ২৮৬) এ আয়াতে ‘মাওলানা’ বলে আল্লাহকে সম্বোধন করা হয়েছে। তাই কোনো মানুষকে ‘মাওলানা’ বলে সম্বোধন বা বিশেষিত করা জায়েজ নয়, বরং শিরক! মাওলানা শব্দটি যদি আক্ষরিক অর্থে ব্যবহৃত হয়, তাহলে নিশ্চয়ই এ শব্দ মানুষের জন্য ব্যবহার করা অন্যায়। কিন্তু এটা যদি একটা উপাধি হিসেবে ব্যবহার করা হয়, তাহলে তো এর আক্ষরিক অর্থ নিয়ে আমাদের মাথা ঘামানোর প্রয়োজন পড়ে না। ইসলামের ইতিহাসে খালিদ বিন ওয়ালিদ (রা.)-এর উপাধি ছিল ‘সাইফুল্লাহ’। এ শব্দের অর্থ আল্লাহর তরবারি। অথচ কেউ কিন্তু কখনো প্রশ্ন করেনি যে খালিদ (রা.) রক্ত-মাংসের মানুষ ছিলেন না, খালিদ (রা.) শুধু একটি তরবারির নাম! কেননা এটা একজন মানুষের উপাধি ছিল। তাই এ শব্দের আক্ষরিক অর্থ কেউ গ্রহণ করেনি। রূপক অর্থটাই গ্রহণ করেছে। এবার আসা যাক, আল্লাহর ক্ষেত্রে ‘মাওলানা’ শব্দকে যে অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে, আলেমদের ক্ষেত্রে সে অর্থে ব্যবহার করা হয়নি। আল্লাহর ক্ষেত্রে ‘মাওলানা’ অর্থ হলো আমাদের প্রভু বা প্রকৃত অভিভাবক আর আলেমদের ক্ষেত্রে তার অর্থ হচ্ছে আমাদের ধর্মীয় অভিভাবক। (সূত্র : কিতাবুল ফাতাওয়া : ১/২২৮, আপকে মাসায়েল আওর উনকা হল : ২/৬৩৮) যদি শুধু শব্দগত রূপ মিল থাকায়ই কোনো শব্দের ব্যবহার ও প্রয়োগ নিষিদ্ধ হয়ে যায়, তাহলে ঈমানদারদের জন্য ‘মুমিন’ শব্দ ব্যবহারও ‘নাজায়েজ’ হতে বাধ্য। কেননা আল্লাহ তাআলার ৯৯ নামের একটি হচ্ছে ‘মুমিন’। অথচ কোরআন ও হাদিসে বিভিন্ন স্থানে মুসলমানদের ‘মুমিন’ বলে বিশেষিত করা হয়েছে। এর কারণ হলো, বান্দার ক্ষেত্রে ‘মুমিন’ শব্দ এক অর্থে আর আল্লাহর ক্ষেত্রে অন্য অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। একই কথা ‘মাওলানা’ শব্দটার বেলায় প্রযোজ্য। অনুরূপভাবে ‘রউফ’ শব্দ আল্লাহর গুণবাচক নাম। কিন্তু সুরা তাওবার শেষ আয়াতে শব্দটি মহানবী (সা.)-এর জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। কেননা শব্দ এক হলেও তা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের জন্য ভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। ইতিহাসে দেখা যায়, প্রখ্যাত তাবেয়ি হজরত হাছান বসরিকে লোকেরা ‘মাওলানা’ বলে ডাকত। (সূত্র : তাহজিবুত তাহজিব : ২/২৬৩, আলবেদায়া ওয়ান্নেহায়া : ৬/২৬৬) তা ছাড়া আরেকটা লক্ষণীয় বিষয়, উর্দু ভাষায় ‘মাওলানা’ শব্দটি উস্তাদ ও আলেমে দ্বিন অর্থেও ব্যবহৃত হয়। (সূত্র : আল-হাদিয়্যাতুল মারযিয়্যা, পৃষ্ঠা ১১৭, ফিরুজুল লুগাত, পৃষ্ঠা ৬৬৪) আমরা যেহেতু এই শব্দের ব্যবহার উর্দুভাষীদের থেকে পেয়েছি, তাই মাওলানা দ্বারা এই দুই অর্থই উদ্দেশ্য। এ বিষয়ে পবিত্র কোরআনের কিছু ব্যবহার দেখা যাক। হজরত ইউসুফ (আ.) তাঁর আশ্রয়দাতা হিসেবে আজিজে মিসরকে ‘ইন্নাহু রাব্বি’ অর্থাৎ ‘তিনি আমার লালন-পালনকারী’ বলে সম্বোধন করেছেন। আজিজে মিসরের স্ত্রী যখন হজরত ইউসুফ (আ.)-কে মন্দ প্রস্তাব দিয়েছেন, তখন তিনি বলেছেন, ‘মা’ আযাল্লাহি ইন্নাহু রাব্বি আহ্সানা মাসওয়া ইয়া’ অর্থাৎ আল্লাহ রক্ষা করুন, তোমার স্বামী আমার মালিক; তিনি আমাকে সযতেœ থাকতে দিয়েছেন।’ এ আয়াতে ‘রব’ শব্দটি মানুষের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। অথচ আল্লাহ ছাড়া কোনো ‘রব’ হতে পারে না। কিন্তু এখানে ‘রব’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে পৃথক অর্থে। ঠিক একই দৃষ্টিকোণ থেকে ‘মাওলানা’ শব্দটিও আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট কোনো শব্দ নয় কিংবা এটা আল্লাহর কোনো নামও নয়। এমনকি খোদ পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা নিজের পাশাপাশি জিবরাঈল (আ.) ও পরহেজগার ঈমানদার বান্দাদের ক্ষেত্রেও ‘মাওলা’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। যেমন, “ইন তাতুবা ইলাল্লাহি ফাক্বাদ ছাগাত ক্বুলুবুকুমা; ওয়াইন তাজাহারা আলাইহি ফা ইন্নাল্লাহা হুয়া ‘মাওলাহু’ ওয়া জিবরিলু ওয়া সালিহুল মু’মিনিন” অর্থাৎ যদি তোমরা উভয়ে তাওবা করো, তাহলে ভালো কথা। কেননা তোমাদের অন্তর ঝুঁকে পড়েছে। আর যদি নবীর বিরুদ্ধে একে অন্যকে সাহায্য করো, তাহলে জেনে রেখো, আল্লাহ, জিবরাঈল ও সৎকর্মপরায়ণ ঈমানদাররাও তাঁর সাহায্যকারী।’ (সুরা : তাহরিম, আয়াত : ৪) এ আয়াতে ‘মাওলা’ শব্দটি সহায় বা সাহায্যকারী অর্থে মানুষ ও ফেরেশতার জন্যও ব্যবহৃত হয়েছে। কাজেই না জেনে এ শব্দ ব্যবহার নিয়ে আপত্তি করা বা বিভ্রান্তি ছড়ানো অনুচিত। (সংগৃহীত)