প্রিন্ট সংস্করণ॥রায়হান আহমেদ তপাদার
জানুয়ারি ২৪, ২০১৯, ০৭:০৬ পিএম
দক্ষিণ এশিয়ার একটি উন্নয়নশীল দেশ বাংলাদেশ। এদেশের মানুষও এ স্লোগানের বাইরে নয়। ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল, তাদের অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনের জন্য, অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও মানব উন্নয়নসহ সকল প্রকার বৈষম্যের বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে আসার জন্য। স্বাধীনতালাভের পর থেকে প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় এদেশের অর্জনও কম নয়। জাতিসংঘ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় বাংলাদেশের সাফল্য বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশ মানব উন্নয়নের অনেক সূচকে ভারতের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে। মাতৃমৃত্যু ও শিশু মৃত্যুর হার কমেছে। রেমিট্যান্স, গার্মেন্ট, সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ অর্থনীতির গতি বৃদ্ধি করেছে। এছাড়াও শিক্ষা, জেন্ডার সমতা, স্বাস্থ্য, তথ্যপ্রযুক্তি, সমুদ্র সীমানা, স্থল সীমান্ত চুক্তির বাস্তবায়ন, পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়ন এসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অগ্রগতি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। বাংলাদেশকে দেখা হচ্ছে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে। সন্দেহ নেই, বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের মহাসড়কে। সম্প্রতি ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত উন্নত বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে আত্মবিশ্বাস ও দেশপ্রেমের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করার জন্য সরকারের আহ্বান ও দেশকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করার জন্য একের পর এক প্রকল্প বাস্তবায়ন আশার সঞ্চার করছে মানুষের মধ্যে। দেশের এই উন্নয়ন ধারা অব্যাহত থাকুক এটা সকলেরই প্রত্যাশা। কিন্তু প্রশ্ন আসছে, এত উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রায় কেন স্বস্তিতে নেই মানুষ? কেন আশায় বুক বেঁধেও মানুষ স্বস্তি খুঁজে ফেরে বারবার। উন্নয়ন বা উন্নয়ন ভাবনা প্রবৃদ্ধিকেন্দ্রিক ধ্যান-ধারণার পরিসর ছেড়ে ব্যাপক ও বহুমাত্রিকতা লাভ করেছে অনেকদিন আগেই। উন্নয়নশীল দেশগুলোর নানাবিধ সমস্যা সমাধানে পূর্ববর্তী উন্নয়ন প্রয়াস সীমিত ও অপর্যাপ্ত হওয়ার নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টি আরও প্রসারিত হয়েছে। শুধু আয় বৃদ্ধি নয়, মৌলিক চাহিদা পূরণের পাশাপাশি সমাজ ও জনগণের সামগ্রিক উন্নয়ন ও অগ্রগতির দিক সর্বশেষ গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। দেশের সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হলে দেশের রাজনীতিকে কলুষমুক্ত করতে হবে। সব অবক্ষয় রোধ করে অর্থবহ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিই গণতন্ত্রকে সমৃদ্ধ করে আর সুষ্ঠু ও বলিষ্ঠ রাজনৈতিক নেতৃত্ব পারে তাকে বাস্তবে রূপ দিতে সঠিক, যোগ্য ও সৎ রাজনৈতিক নেতৃত্ব সুন্দর ভবিষ্যতের বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পারে। তার সঙ্গে প্রয়োজন সুশীল সমাজ, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহ, পেশাজীবী ও ব্যবসায়ীসহ সাধারণ নাগরিকদের বলিষ্ঠ ও সক্রিয় সহযোগিতা। রাষ্ট্রের ভাবাদর্শ যা-ই হোক না কেন, রাষ্ট্রবদ্ধ মানুষ যাতে কল্যাণময়, সুষ্ঠু ও সুন্দর পরিবেশে উন্নত, মহৎ ও অর্থবহ জীবনযাপন করতে পারে, তা-ই সুশাসন এবং গণতন্ত্রের অভীষ্ট লক্ষ্য। সব আধুনিক রাষ্ট্রের মতোই বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রচেষ্টার চাবিকাঠি হচ্ছে রাষ্ট্র, জাতি ও সমাজের কল্যাণ সাধন। জাতীয় সংহতি ছাড়া রাজনৈতিক রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। কারণ রাজনৈতিক উন্নয়ন এবং জাতীয় সংহতি পারস্পরিকভাবে সংশ্লিষ্ট প্রক্রিয়া। এদেশে সুশাসনের জন্য প্রয়োজন উন্নয়নমুখী, কল্যাণমূলক সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যবোধ গড়ে তোলা। প্রয়োজন আত্মবিশ্বাস ও সংগঠন যার এই আত্মনির্ভরতার আর সক্রিয়তার অগ্রপথিক হবে এদেশের তরুণ শিক্ষিত যুবসমাজ। উল্লেখ্য, নিবেদিতপ্রাণ, সৎ, আন্তরিক ও গঠনমূলক নেতৃত্ব ও সংগঠনই কেবল এদেশে সুশাসন ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় ইতিবাচক বিপ্লব আনতে পারে। আজকের বিশ্বব্যবস্থায় বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের সামনে রয়েছে বহুবিধ চ্যালেঞ্জ। এসব চ্যালেঞ্জের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে গণতন্ত্রায়ন এবং মুক্তবাজার অর্থনীতির পথ প্রশস্ত করা এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির মাধ্যমে বিশ্বব্যবস্থার সঙ্গে সমন্বয় সাধন করা। আজকের উন্নয়নশীল বিশ্বে সুশাসন হলো রাষ্ট্রীয় প্রশাসনে জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণের বাস্তব এবং কার্যকর প্রক্রিয়া সৃষ্টি করা। এর লক্ষ্য জাতীয় জীবনে সব সমস্যার সমাধান করা এবং যেসব সিদ্ধান্ত জনস্বার্থে অপরিহার্য তার সঠিক বাস্তবায়ন করা। সুশাসন একটি রাষ্ট্রের সব নাগরিককে তাদের জীবনকে সঠিকভাবে সঞ্চালিত করতে সহায়তা করে এবং একটি উন্নততর সমাজ গঠনে উদ্বুদ্ধ করে। সেই সঙ্গে যেটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তা হলো সুশাসনই শক্তিশালী, জবাবদিহিতামূলক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার শক্ত ভিত রচনা করে এবং সব নাগরিককে তথ্য ও জ্ঞানসমৃদ্ধ করে প্রকৃত অর্থে দায়িত্বশীল নাগরিক হতে সক্ষম করে তোলে। এদেশে যখন মাশরুমের মতো বেড়ে উঠা অপচয়কারী, বিলাসিতায় মগ্ন সরকারি আমলাদের ১২৩% বেতন বৃদ্ধি হয়, বৈশাখীভাতা দেওয়া হয়, তখন এই অর্থ জোগান দিতে গরিব কৃষক দীনমজুরের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। কিন্তু শহরে এলিটদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য এবং বিলাস বৈভরের সামগ্রী জোগাতে গরিব দুঃখী মানুষের প্রাণ যায়। শুধু নির্বাচনের সময় এদের মানুষ বলে গণ্য করা হয়। তারপর পরবর্তী নির্বাচন পর্যন্ত এদেরই অর্থে লালিত-পালিতদের এরা পদসেবা করে। এখানে সরকারি কর্মকর্তারা প্রভুর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। এখন প্রতিযোগিতামূলক অর্থনৈতিক কর্মকা-ের জগৎ। এখানে টিকে থাকতে হলে উন্নত ও সমৃদ্ধি অর্জন করতে হলে দরিদ্র দেশগুলোর অনগ্রসর ও অনুন্নত মানবসম্পদকে উন্নত ও সমৃদ্ধ করতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সুপরিচালনা, মানবিক উন্নয়ন, আঞ্চলিক ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা, প্রয়োজন দারিদ্র্য হ্রাসকরণ, উপার্জনমূলক কর্মসংস্থান প্রসার এবং অনুন্নত, প্রান্তিক ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীকে একাত্ম করে সামাজিক সংহতি অর্জন। আর, এসবই সম্ভব জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে মানবকেন্দ্রিক মানবসম্পদ উন্নয়নের মাধ্যমে, শাসন-প্রশাসনের মাধ্যমে নয়, প্রয়োজন স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সেবা। আর এর জন্য প্রয়োজন শিক্ষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, কৃষিবিদ এং বিজ্ঞানী, শাসক নয়। সরকারের প্রশাসনিক ব্যবস্থার সুষ্ঠুতা ও সুপরিচালনার ওপরে কাক্সিক্ষত মানবসম্পদ উন্নয়ন নির্ভরশীল। মানবসম্পদ উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন একটি জাতীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন পরিষদ বা কমিশন এবং এর সঙ্গে সংযুক্ত হবে শিক্ষাসংক্রান্ত সব সংস্থা, কারিগরি ও বৃত্তিমূলক সব প্রতিষ্ঠান, রপ্তানিপণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ কর্তৃপক্ষসমূহ, জাতীয় সমাজকল্যাণ কাউন্সিল এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান। আসলে সুশাসনের জন্য প্রয়োজন এদেশের বঞ্চিত এবং সুযোগ-সুবিধাহীন গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে সংগঠিত করে প্রশিক্ষণদান ও ঋণের মাধ্যমে আত্মকর্মসংস্থানে নিয়োজিত করা। এদেশের দরিদ্র, অসংগঠিত, ভূমিহীন সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসমষ্টিকে উন্নয়ন প্রয়াসের লাভজনক সুফলের অংশীদার না করতে পারলে সুশাসন সম্ভব নয়। আজ তারুণ্যনির্ভর বাংলাদেশে ৪৯ শতাংশ মানুষের বয়স ২৪ বছর কিংবা তার নিচে। এদের কাজে লাগাতে হলে বিপুল পরিমাণ কর্মসৃষ্টি করা প্রয়োজন। প্রয়োজন নারীর শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণ। আজ এদেশে কর্মক্ষম জনসংখ্যা ১০ কোটি ৫৬ লাখ, এই জনগোষ্ঠীকে যথাযথভাবে কাজে লাগিয়ে বেকার সমস্যা দূরীকরণ সুশাসনের মূললক্ষ্য হওয়া উচিত। এর জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টির অগ্রাধিকার দরকার। রাজনীতি আজ স্বার্থান্বেষী, অর্থ-বিত্ত সর্বস্ব এবং পেশিশক্তিনির্ভর ব্যক্তিদের নিয়ন্ত্রণে। ফলে সমাজ আজ দুর্নীতিগ্রস্ত। দেশে স্থানীয় সরকারের অবর্তমানে, ক্ষমতার ভারসাম্য প্রায় লুপ্ত। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ সুশাসন এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। নোবলে বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের মতে জনসাধারণের সক্ষমতার বিকাশই উন্নয়ন। মানুষের সক্ষমতা নির্ভর করে স্বত্বাধিকারের ওপর অর্থাৎ কী পরিমাণ দ্রব্য এবং সেবা সামগ্রীতে সে তার স্বত্বপ্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে তার ওপর। মনে রাখতে হবে, এটি শুধু একটি অর্থনৈতিক প্রস্তাবনা নয়, বরং মানসিক সমস্যাও বটে। যেমন, অর্থনীতিবিদগণ দাবি করেন, অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রধান সূচক হলো, মাথাপিছু আয় এবং মোট জাতীয় আয়ের বণ্টন বা পরিমাণ। রাজনীতিবিদগণ মনে করেন, যে সমাজে মৌলিক চাহিদার নিশ্চয়তাসহ রাজনৈতিক স্বাধীনতা বিদ্যমান সে সমাজই উন্নত। আচরণবাদীরা বিশ্বাস করেন, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নই হলো আসল উন্নয়ন, যেখানে মানুষের উন্নতির সুযোগ রয়েছে। যত ভিন্ন ভিন্ন মতই থাকুক না কেন বিশ্বের সকল মানুষই চায় জীবনমানের ইতিবাচক পরিবর্তন। উন্নয়নকামিতা মানুষের ধর্ম। উন্নয়নকে ঘিরেই মানুষের যাবতীয় উদ্যম, পরিশ্রম ও কর্মতৎপরতা। পৃথিবীর ধনী ও দরিদ্র সকল দেশের মানুষের মুখে এখন একমাত্র সেøাগান আমরা উন্নয়ন চাই’।
লেখক ও কলামিস্ট।