Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪,

গাধা জল ঘোলা করে খাবে

মোহাম্মদ রাশেদুজ্জামান

ডিসেম্বর ২, ২০২০, ০১:৫৫ পিএম


গাধা জল ঘোলা করে খাবে

ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা এই স্লোগান এখন আর হালে পানি পাচ্ছে না। তাই নতুন মোড়কে একই জিনিসে বাজার দখলের চেষ্টা। হালাল-হারামের জিগির তুলে তাই প্রচার-প্রসারের অপপ্রয়াস। বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে ভাস্কর্যই মূর্তি, মূর্তিই ভাস্কর্য! মানে এগুলো ধরাছোঁয়া সব অনৈসলামিক। স্পর্শকাতর এ বিষয়টি নিয়ে চলছে পাড়া-মহল্লায় বাগ্বিতণ্ডা, উচ্চস্বরে গলা ফাটিয়ে জেহাদের ঘোষণায় আঁতেলদের শহীদ হয়ে বাতিলের পক্ষের শক্তিকে নির্মূল করে অন্য রাষ্ট্রেও ইসলাম কায়েম করা ইত্যাদি। কিছুদিন সময়ের ব্যবধানে সব আবার কর্পুরের মতো উবে যাবে। যেমনটা গেছে ‘নারী নেতৃত্ব হারাম তত্ত্ব’, ‘মসজিদে উলুধ্বনি তত্ত্ব’, ‘বউ তালাক তত্ত্ব’ ইত্যাদি। একপর্যায়ে শহীদ মিনারে ফুল দেয়াকে যারা ফতোয়া দিয়ে জায়েজ করেছিলেন, আবার তারাই হয়তো ভাস্কর্যকে জায়েজ করে দেবেন। সবই করবেন তবে ঘোলা করে! অতীতেও এমনই নজির অহরহ তার কিছু নমুনা তুলে ধরার চেষ্টা

‘জাতির পিতা’ অন্য মুসলিম দেশে হলে ঠিক আছে কিন্তু বাংলাদেশের ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু’ হলে বিদয়াত, কারণ মুসলমানদের জাতির পিতা হজরত ইব্রাহিম (আ.)’ এবং এ সংক্রান্ত আরো অনেক ফতোয়া দিয়ে মায়াকান্না আর গোপনে বহু ষড়যন্ত্র করেও বিগত সময়ে তাদের আন্দোলন ধোপে টেকেনি। কয়েকজন গোঁড়া আর ধর্মজীবী ছাড়া দল-মত নির্বিশেষে বাংলাদেশের প্রায় সবাই হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, মহান মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জাতির পিতার স্বীকৃতি দিয়ে তার আদর্শ সগৌরবে বুকে ধারণ করেছে। 

এরাই ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের বিপরীতে মুসলিম পরস্পর ভাই ভাই ছড়া দিয়ে পাকিস্তানি জালেমদের পক্ষে ইসলামের অপব্যবহার করেছিল। ‘আল্লাহ বড় মেহেরবান, রক্ষা করো পাকিস্তান’ এই স্লোগান দিয়ে সে সময় তারা ধর্ষণ, গণহত্যা, লুটপাট, ঘরবাড়ি পেড়ানো, সবই হালাল করার চেষ্টা করেছে। তাতে তেমন লাভবান হননি বরং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক কূটকৌশল, অপতৎপরতা এবং ষড়যন্ত্র উপেক্ষা করে মাত্র ৯ মাসে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। যদিও দেশ স্বাধীনের পর কতিপয় ইসলামসেবক লন্ডনে বসে মুজিবনগর সরকারের আদলে প্রবাসী পূর্বপাকিস্তান সরকার ও রক্ষা পরিষদ গঠন করেছিলেন। এরা মধ্যপ্রাচ্যে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের নামে নানা বিষোদগার করে এখানে ইসলামের নিবিড় চাষকল্পে ব্যাপক দান-অনুদান সংগ্রহ করে নিজেদের আখের গুছিয়েছেন। পরবর্তীতে এরাই স্বেচ্ছায় নির্বাসন ত্যাগ করে  ভোল পাল্টে বাংলাদেশকে স্বীকার করে এর নাগরিকত্ব নিয়েছেন।

যখন এলো ’৭১-এর রাজাকার আল-বদরদের ফাঁসি দেয়ার পালা তখন তারা হয়ে গেলেন ইসলামের সোল এজেন্ট। এই লেবাসধারীরা অপরাধী হলেও তারা যেনো বিচারের আওতায় না পড়েন সে জন্য দেশে-বিদেশে তার সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হলো। এর অংশ হিসেবে বিচারকারীদের উৎখাতের উদ্দেশ্যে গঠিত হলো ‘ইসলাম রক্ষা পরিষদ’। এবারও অনেক অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনা ঘটলো। মিথ্যা তথ্য দিয়ে দেশের মানুষকে বিভ্রান্ত করার প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকলো। 

পরিশেষে তাদের ঘটে যখন কোনো সুফলই মিললো না তখন তাদের কেউ ছাদে পালিয়ে গেলো, কেউ চাঁদে পালিয়ে গেলো, আবার কেউ মরণোত্তর রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইলো। প্রসঙ্গ, গণতন্ত্র না আল্লাহর আইন? এই স্লোগানও বাংলার মানুষ অনেক শুনেছে। স্লোগান শুনতে শুনতে জনগণ যখন ক্লান্ত তখন স্লোগান দিতে দিতেও তারাও ততদিনে তাগুতি গণতন্ত্রের মহান সেবকের খ্যাতি লাভ করতে মরিয়া হয়ে পড়েছেন। 

মাঝখান দিয়ে বেঘোরে ঝরে গেলো কিছু মাস্টারমাইন্ড ও বহু বিভ্রান্ত জিহাদির জীবন। এক্ষেত্রে পয়লা বৈশাখ পড়েছে মহাবিপদে। কারণ এটি শহরে হালাল আর গ্রামে হারাম। বেশ কয়েক বছর আগেই এর ওপর কঠিন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। প্রায় প্রতিটি গ্রামের মসজিদে পয়লা বৈশাখের ঠিক আগের শুক্রবারে ইমাম সাহেব জুমার নামাজে এই হারাম সংক্রান্ত কঠিন খুতবা দিয়ে থাকবেন। আমার মনে হয় খুব শীঘ্রই শহরও একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে গ্রামে গ্রামে পয়লা বৈশাখ হালাল করে দেবে। ‘মাইকে কথা বলা হারাম’ এটা কাটিয়ে উঠতে বেশি সময় লাগেনি। যদিও মাইকেই অনেক প্রচার হয়েছে এই মাইক নিষিদ্ধ করার বিষয়ে। তবে আমাদের দেশের আলেম-উলামারা এর বেশি ব্যবহার করছেন। তারা ওয়াজের মাঝখানে ‘চিল্লাইয়া বলেন, ঠিক কি না?’ বলে গর্জে উঠে। যে এলাকায় ওয়াজ মাহফিল হয় সে এলাকার বাইরেও মাইকে কানেকশন দেয়া হয়, যাতে সবাই শুনতে পান। 

আর মাইকে বাংলা হিন্দির সব গীতির নকল গান অঝোর ধারায় ঝরতে থাকে। এককালে এই অঞ্চলের মুসলমানদের জন্য ইংরেজি বিদ্যাশিক্ষা হারাম ঘোষণা করা হয়েছিল। এই হারাম তত্ত্বের অপকারিতা আস্তে আস্তে সবাই টের পেয়েছে। যার মাশুল এখনো গুনতে হচ্ছে। এখন নিজেদেরকে বেশি পণ্ডিত প্রমাণ করতে প্রায়ই ভুলভাল ইংরেজি আওড়াচ্ছেন অনেক আলেম-উলামা। উদাহরণ স্বরূপÍ দরজা খোলা আছে। ওয়াজ মাহফিলের একজন বক্তা এর ইংরেজি বললেন, is the door open? একটা বিবৃতিমূলক বাক্যকে জানার ভুলে তিনি এক নিমিষেই প্রশ্নবোধক বাক্য বানিয়ে দিলেন।

কেন এরকম করলেন? এরা আসলে সবসময় এরকমই করেন। কারণ যেকোনো জিনিসকে প্রশ্নবোধক করে তোলাই এদের কাজ।
বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও অস্তিত্বকে অস্বীকার করার আর একটি কৌশল হলো জাতীয় সঙ্গীতকে হারাম বলে প্রপাগাণ্ডা করে মুসলমানদের মন বিষিয়ে তোলা। এ নিয়ে এখনো কিছু বক্তব্য মাঠে প্রচলিত আছে। কিন্তু আখেরে তেমন লাভ হচ্ছে না। বরং ওরাই লাইন ধরে জাতীয় সঙ্গীত গায়। তবে মনে মনে ‘পাকসার জমিন সাদবাদ’ গাইতে চায়? এই আর কি! তবে ছবি উঠা আর শয়তানের বাক্স টিভি দেখা, কেনাবেচা বা ঘরে রাখা হারাম হলেও হারাম ঘোষণাকারী নেতাদেরই এটা আবার লাগে। কারণ বিভিন্ন চ্যানেলে প্রগ্রাম থাকে। আবার মহিলারা উপস্থাপনা করে। 

এটা নিয়ে বেশি বলা ঠিক হবে না কারণ এটা এদের লাগে। কিছু জিনিস এমনিতেই লাগে আবার কিছু খটকা লাগে। তাই কিছু জিনিস জনগণ মানতে চায় না বা জনগণকে মানানো যায় না। একপর্যায়ে বাংলার নাফরমান-বেদ্বীনদের জাহান্নামে পাঠিয়ে  তাদেরকেই সব মেনে নিতে হয়। ‘তাইলে হুজুর এরকম করেন ক্যা’ না মানে, কিছু না কিছু তো লাভ আছেই ‘লাভের আশায় আবার ইহকাল-পরকাল দুইড্যাই  হারাইয়েন না হুজুর, রেকর্ড কিন্তু বেশি ভালো না।’

লেখক : মন্ত্রীর সহকারী একান্ত সচিব, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়

আমারসংবাদ/এমআর