Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪,

একুশ এলে কলা গাছের শহীদ মিনারে সরষে ফুল দিতাম

ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০২১, ১২:১৫ পিএম


একুশ এলে কলা গাছের শহীদ মিনারে সরষে ফুল দিতাম

ফেব্রুয়ারি আসলেই আমার মনে পড়ে শৈশবে স্কুলে কলা গাছ দিয়ে অস্থায়ী শহীদ মিনার বানানোর কথা। নিজ গ্রামের স্কুল থেকেই পড়াশোনার হাতেখড়ি। আমাদের স্কুলের কাঠামো অতটা উন্নত ছিল না। চারপাশে কড়ই গাছে আবৃত করে রেখেছে টিনের চালের শেখের গাঁও আব্দুল অদুদ মুন্সি উচ্চ বিদ্যালয়কে। সামান্য বৃষ্টি এলেই আমাদের স্কুলের টিনের চালের ছিদ্র দিয়ে টপটপ করে বৃষ্টির ফোঁটা পড়তো। আমরা পড়া বাদ দিয়ে বৃষ্টির ফোটা হাতের তালুতে জমা করতাম। টিনের ছিদ্র দিয়ে তাকালে দেখা যেতো দিগন্ত জোড়া ফসলের মাঠ, কৃষকের মাঠে কাজ করার অপরুপ সে দৃশ্য। মফস্বলের স্কুল বলেই হয়তো স্থায়ী কোন শহীদ মিনার ছিল না, এখনো নেই। বছর ঘুরলেই ভাষার মাস আসে, একুশ আসে। আমাদেরও কলা গাছ দিয়ে অস্থায়ী শহীদ মিনার তৈরি করার পালা আসে। অস্থায়ী মিনার হলেও শহীদদের প্রতি ভালোবাসাটা ছিল স্থায়ী। খুব যত্ন করেই তৈরি করতাম বন্ধুরা মিলে।

নবম শ্রেনি থেকেই স্কুল ক্যাপ্টেন ছিলাম। মেনে চলতাম স্কুল ক্যাপ্টেন মানেই স্বেচ্ছাসেবক। ক্লাসের টেবিল মুছে দেয়া, ক্লাসের ময়লা পরিষ্কার করা, দল নিয়ে স্কুলের মাঠ পরিষ্কার করা ইত্যাদি। বিনিময়ে যা পাওয়া যেতো তা হলো শিক্ষকদের কাছ থেকে ভালোবাসা, আর দোয়া। সহপাঠীদের থেকে পাওয়া যা অতিরিক্ত তোষামদ, গ্রহণযোগ্যতা। ক্যাপ্টেন ছিলাম বলে ২১ ফেব্রুয়ারি জন্য অস্থায়ী শহীদ মিনার বানানোর কাজে সরাসরি অংশগ্রহণ করার সুযোগ হতো। ২০ ফেব্রুয়ারির দিন স্কুল ছুটির পর অফিস সহকারীর সাথে আমাদের কলা গাছের অস্থায়ী প্রতীকী শহীদ মিনার বানানোর কাজ শুরু করতে হতো।
 
বন্ধুরা মিলে ২০ ফেব্রুয়ারি বিকেল বেলা বেড়িয়ে পড়তাম কার বাড়িতে কলা গাছ আছে তার খুঁজে। কলা গাছ প্রায় কমবেশি সবার বাড়ির আঙ্গিনায় ছিল বলে বেগ পেতে হতো না খুঁজতে। বন্ধুরা মিলে কলা গাছ কেটে মাথায় করে স্কুলে নিয়ে আসতাম। স্কুলের মাঠে বড় বড় তিনটি র্গত করে নির্দিষ্ট সাইজের কলার গাছ গুলো দাড়ঁ করিয়ে রাখতাম। আঠা দিয়ে লাল, সাদা কাগজে সাজানো হতো আমাদের কলা গাছের প্রতীকী শহীদ মিনার। ২০ ফেব্রুয়ারি কাগজ সাটাঁতাম না, কারণ গ্রামে রাতের বেলা প্রচুর শিশির পড়ে। কাগজ ভিজে যাওয়ার ভয়ে ২১ই ফেব্রুয়ারির দিন ফজরের নামাজের পরই আমাদের সাজানোর কর্মযজ্ঞ শুরু হতো। আগের দিন রাতে ঘুম হতো না কখন সকাল হবে আর শহীদ মিনার বানানো শেষ হবে তা ভেবে। শহীদ মিনারে ছাত্রছাত্রীরা ফুল দেয়া শুরু করতো ভোর থেকেই। যে যেখান থেকে পারতো ফুল আনতো। গোলাপ, রজনীগন্ধা কিংবা যে কোন ফুল কিনতে হলে আমাদের যেতে হতো ট্রলার যোগে নদীর পাড় হয়ে নারায়ণগঞ্জ কিংবা ঢাকায়। বেশির ভাগ শিক্ষার্থীর হাতেই থাকতো বাড়ির কিনারায় লাগানো গাছের গোলাপ, গাঁদা কিংবা জবা ফুল, যেন ২১ই ফেব্রুয়ারির জন্যই বাড়ির আঙ্গিনায় লাগানো হয়েছে ফুল গাছ। ছোট বাচ্চারা নিয়ে আসতো কলমি ফুল, কচুরিপানা ফুল, সরষে ফুল ইত্যাদি। 

অনেকেই আবার পাশের বাড়ির ফুল গাছ থেকে রাতের বেলা ফুল চুরি করে আনতো। তখন মনে হতো শহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে ফুল চুরি করা কোন দোষের কাজ নয় বরং দিতে পেরেছি এটাই বড়। আমরা যারা নবম-দশম শ্রেনিতে পড়তাম তাদের উপরে কোন কথা বলার সাহস পেতো না স্কুলের আর বাদবাকি ছাত্রছাত্রীরা। ফুল দেয়া শেষে যখন সবাই প্রভাতফেরিতে বের হতাম আমরা যখন সবার আগে প্রভাতফেরি শেষ করে স্কুলে চলে আসার চেষ্টা করতাম। কারণ যে আগে আসতে পারবে সে ততবেশি ফুল নিতে পারবে। ফুল নেয়ার জন্যও আমাদের মাঝে তখন প্রতিযোগিতা চলতো। এমনও হয়েছে আমার এক বছর কোন ফুল নেইনি কিন্তু শেষে এসে ফুল নেয়ার অভিযোগ আমাদের মাথা এসেই পড়ে।

স্কুলে কলা গাছের প্রতীকী শহীদ মিনারে যখন বড় শিক্ষার্থীদের সাথে যখন ঘরের সবচেয়ে কম বয়সী সদস্যটিও গুটি গুটি পায়ে হেটেঁ আসতো, তখন মনে হতো দিনের সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য বুঝি এটাই। খানিক্ষণ পর যখন দেখতে পেলাম তিনবছরের শিশুটিকে যখন তার ৬ষ্ঠ শ্রেনিতে পড়ুয়া বোন হাতের বাহু উঁচু করে ধরেছে তিনবছর বয়সী শিশুটি হাতে রাখা কচুরিপানা ফুলটি টুক করে রেখে দিল মিনারের বেদীতে সে দৃশ্যটিই মনে হয়েছে দিনের সবচেয়ে সেরা দৃশ্য। 

সামান্য কচুরিপানা ফুল দিয়েও যে ভালোবাসা জানান দেয়া যায় সেদিনই বুঝেছিলাম। যেমন করে সুই দিয়ে কাথাঁর মধ্যে সুতাগুলোকে নক্সী করে রাখা হয় এ দৃশ্যটি আমার হৃদয়ে যেন তেমন করেই নক্সী হয়ে গেঁথে রইলো। কচুরিপানা দেখলেই এখন আমার আট বছর আগের দেখা সে দৃশ্যের রঙ ঝিলিক দিয়ে উঠে চোঁখে। কি অদ্ভুত সুন্দর সে দৃশ্য! বারবার মনে হয় এ দৃশ্যের সৃষ্টি করতেই হয়তো হাজারো শহীদ ভাষার জন্য নিজের তাজা প্রাণ বিলিয়ে দিয়েছে।

আমার সেই স্কুলে এখন টিনের চালের পরির্বতে ইট পাথর দিয়ে দালান তৈরির কাজ চলছে। স্কুলে এখনো বছর ঘুরলেই কলা গাছ দিয়ে শহীদ মিনার বানানো হয়, এখনো লাল সাদা কাগজ দিয়ে খুব ভোরে সাটাঁনো হয় কলা গাছের মিনার। হয়তো এখনো দেখা মিলে ছোট শিশুটির সেই কচুরিপানা ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবারণের হৃদয়কারা সে দৃশ্যটি। সময় গড়িয়েছে, হয়তো অস্থায়ী কলা গাছের শহীদ মিনারের বদলে দেখা যাবে ইট পাথরের মিনার। তবে অস্থায়ী সেই কলা গাছের মিনার, সরষে ফুল, কলমি ফুল, কচুরিপানা ফুলে দৃশ্যটি আমার হৃদয় গহীনে জমা হয়ে থাকবে বহুকাল। 

লেখক: শিক্ষার্থী, তিতুমীর কলেজ।

আমারসংবাদ/কেএস