Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪,

মাতৃভাষার বিকৃতি রোধে প্রয়োজন সচেতনতা

সায়মা জাহান সরকার

ফেব্রুয়ারি ২০, ২০২১, ০৮:০০ এএম


মাতৃভাষার বিকৃতি রোধে প্রয়োজন সচেতনতা

প্রতিটি জাতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি সংস্কৃতি হলো তার নিজস্ব ভাষা বা মাতৃভাষা। সকল জাতিরই রয়েছে নিজস্ব ভাষা। পৃথিবীর ইতিহাসে কখনোই কেউ জোর করে কারো মাতৃভাষাকে স্তব্ধ করে দেয়ার অপপ্রয়াস চালায়নি, যেমনটা চালিয়েছিল তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী।

তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান তথা আজকের বাংলাদেশের সকলের মাতৃভাষা বাংলা হওয়া সত্ত্বেও পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী জোর করে বাংলার পরিবর্তে উর্দুকে চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল। আর এটি করতে গিয়ে তারা হত্যা, নির্যাতনের মতো জঘন্য কাজগুলো করেছে।

১৯৪৭ সালের ১লা সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবুল কাশেমের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয় তমুদ্দিন মজলিস নামক সাংস্কৃতিক সংগঠন। এ সংগঠনটি ১৫ সেপ্টেম্বর একটি পুস্তিকা প্রকাশ করে যার নাম 'পাকিস্থানের রাষ্ট্র ভাষা বাংলা না উর্দু?'। 

এ পুস্তিকার সাথে জড়িত ছিলেন কাজী মোতাহার হোসেন ও আবুল মনসুর আহমেদ। অধ্যাপক আবুল কাশেম বাংলা ভাষাকে অফিস-আদালত ও ভাব বিনিময়ের ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য জোরালো দাবি তুলে ধরেন।

১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারিতে পাকিস্তানের গণপরিষদে উর্দু ও ইংরেজিকে সরকারি রাষ্ট্রভাষা হিসেবে নির্ধারণ করা হয়। গণপরিষদে পূর্ব বাংলার প্রতিনিধি হিসেবে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত পাকিস্তানের সংখাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষা হিসেবে উর্দু ও ইংরেজির পাশাপাশি বাংলাকে গণপরিষদের ভাষা হিসেবে গ্রহণ করার প্রস্তাব করেন। পাকিস্তান গণপরিষদ তা ঘৃণাভরে অগ্রাহ্য করে। ফলে পূর্ব বাংলায় শুরু হয় প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ। 

এর পরম্পরায় ২৭ ফেব্রুয়ারি এক সভায় গঠিত হয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবিতে ১১ মার্চ বৃহস্পতিবার সারা দেশে হরতাল পালনের সিদ্ধান্ত হয়। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত ১১ মার্চ তারিখটি রাষ্ট্রভাষা দিবসরুপে পালিত হয়।

১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে এক নাগরিক সংবর্ধনায় মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঘোষণা করেন, 'উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা'। এতে তাৎক্ষণিক প্রতিবাদে ফেটে পড়ে ছাত্র-জনতা।পুনরায় ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে অনুষ্ঠিত সমাবর্তনে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ 'Students role in Nation building' শিরোনামে ভাষণ প্রদানকালে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিকে নাকচ করে দেন। 

তিনি বলেন, 'পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে একটি এবং সেটি উর্দু। একমাত্র উর্দুই পাকিস্তানের মুসলিম পরিচয় তুলে ধরে। সাথে সাথে ছাত্ররা 'নো নো' বলে তীব্র প্রতিবাদ জানায়।

জিন্নাহর বক্তব্যের প্রেক্ষিতে ভাষা আন্দোলন আরও গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে। আন্দোলনের তীব্রতা পায় ১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি খাজা নাজিমুদ্দিনের বক্তব্যের প্রেক্ষিতে। তিনি জিন্নাহর কথারই পুনরাবৃত্তি করেন। 

এরপর তার বক্তব্যের প্রতিবাদে ৩১ জানুয়ারি ১৯৫২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের  লাইব্রেরি হলে মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে সভা অনুষ্ঠিত হয়। ভাসানীর সভাপতিত্বে কাজী গোলাম মাহবুবকে আহবায়ক করে ৪০ সদস্যের 'সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মী পরিষদ' গঠিত হয়। এই পরিষদ ২১ ফেব্রুয়ারি হরতাল, সমাবেশ ও মিছিলের কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করে।

এরপর তৎকালীন সরকার স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে ঢাকায় ১ মাসের জন্য সভা সমাবেশ নিষিদ্ধ করে ১৪৪ ধারা জারি করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা বিভিন্ন হলে সভা করে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত নেয়। পরদিন অর্থাৎ ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা করার দাবিতে মিছিল বের করে ছাত্র-জনতা। পুলিশ মিছিলে গুলিবর্ষণ করে এবং এতে রফিক, শফিক সালাম বরকতসহ নাম না জানা আরও অনেকে শহীদ হন।

প্রকৃতপক্ষে ভাষা আন্দোলনই ছিল স্বাধীনতা আন্দোলনের সূচনা। রক্ত ঝরলো, শহীদ হলো, বাংলা মাতৃভাষা হলো। এরপর ১৯৭৪ সালের ২৩ শে মার্চ জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের পক্ষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলায় ভাষণদান করার ফলে বিশ্ববাসী বাংলা ভাষার মহত্ত্ব জানতে পারে।

১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে বাংলা ভাষাকে স্বীকৃতি বিশ্ব দরবারে এনে দিয়েছে বাংলা ভাষার বিশাল খ্যাতি। ২০০০ সাল থেকে ইউনেস্কোর সদস্য রাষ্ট্রগুলো দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করে। এটি নিঃসন্দেহে আমাদের জন্য গৌরব ও সন্মানের।

এত সংগ্রাম ও আত্মাহুতির মাধ্যমে অর্জিত গৌরব ও সম্মান, আমরা কী পেরেছি এর মর্যাদা রক্ষা করতে? 

প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত হয় 'নদীর মতোই বাংলা ভাষার দূষণ' সংক্রান্ত একটি লেখা। আসলেই আজ বাংলা ভাষা যেন দূষিত হচ্ছে বিভিন্ন মাধ্যমে। রেডিওতে হরহামেশা চলছে বাংলার বিকৃতি। দেখা ও ব্যবস্থা নেওয়ার যেন কেউই নেই।

ভারতীয় টিভি চ্যানেলে হিন্দি দেখার মাধ্যমে আমাদের শিশু সন্তানরা যেন বাংলার পরিবর্তে হিন্দি চর্চাতেই মেতে আছে। বাংলাকে আমরা মাতৃভাষা বললেও বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের পড়াশোনার মাধ্যম হয়েছে ইংরেজি। অফিস-আদালতের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে ইংরেজিকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়। আমাদের শিক্ষার জন্য নেই বাংলা ভাষায় পর্যাপ্ত সহায়ক বই।

বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞান বোঝার জন্য বাংলায় কোনো সহায়ক বই পায়না বললেই চলে। আর যত্রতত্র বাংলা বানানের যে অবস্থা, তা দেখে বোঝারই উপায় নেই যে এ ভাষার পেছনে রয়েছে রক্তাক্ত ইতিহাস। সরকারি, আধা-সরকারি অনেক প্রতিষ্ঠানের নামের বানানেই রয়েছে অসংখ্য ভুল।কেউই কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছেনা। সবাই যেন নিশ্চুপ। 

বাংলা ভাষায় পরিচর্যার জন্য 'বাংলা ভাষা ইন্সটিটিউট' প্রতিষ্ঠা হলেও নেই ভাষা বিষয়ক কোনো গবেষণা। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নেই বাংলা ভাষা সমৃদ্ধকরণ কোনো ইন্সটিটিউট। এমনকি অনেক সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগও নেই।আর প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে তো বাংলা বিষয়ের নিশানই নেই। যে জাতি ভাষার জন্য এত সংগ্রাম করেছে, তাদের জন্য কি এসব অপরিহার্য বিষয় নয়?

অথচ সারা পৃথিবীতে প্রায় ৩০টি দেশের ১০০টি বিশ্ববিদ্যালয়ে চালু রয়েছে বাংলা বিভাগ। সেখানে বহু অবাঙালি বাংলা ভাষা শিক্ষা ও গবেষণার কাজ করছেন। বাংলা ভাষা, সাহিত্য, ইতিহাস ও সংস্কৃতি নিয়ে বহির্বিশ্বে ভারত ও বাংলাদেশের পর ব্রিটেন ও আমেরিকায় সবচেয়ে বেশি চর্চা হয়ে থাকে। এর বাইরে চীন, জাপান, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, জার্মানি, পোল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশে বাংলা ভাষার সংস্কৃতি চালু হলেও আমরাই রয়েছি পিছিয়ে।

আমেরিকায় কমপক্ষে ১০টি বিশ্ববিদ্যালয় ও এশীয় গবেষণা কেন্দ্রে বাংলা ভাষার চর্চা হচ্ছে। অথচ আমরা কথায় কথায় ইংরেজি না বললে যেন তৃপ্তিই পাইনা। কথায় কথায় যে যত বেশি ইংরেজি বলতে পারে সেই যেন তত বেশি মানানসই। 

তাই এখনই সময় সচেতনতা তৈরি করার ও সচেতন হওয়ার। যে সচেতনতা আমাদেরকে শুদ্ধ বাংলা ভাষার চর্চা ও ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করবে। বাংলা বানান তদারকির জন্য রাষ্ট্রের পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। রেডিও টেলিভিশনে শুদ্ধ বাংলা চর্চার জন্য তাগাদা দিতে হবে। নইলে আমাদের যে বাংলা ভাষার সংগ্রাম ও গৌরবের ইতিহাস, তা অচিরেই ম্লান হয়ে যাবে।

লেখক: সায়মা জাহান সরকার (শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)।

আমারসংবাদ/এআই