Amar Sangbad
ঢাকা মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল, ২০২৪,

রাষ্ট্রপতির হাতে রিক্রুট হন গোলাম মোস্তফা

শাহজাহান সাজু

মার্চ ৪, ২০২১, ১২:৩০ পিএম


  রাষ্ট্রপতির হাতে রিক্রুট হন গোলাম মোস্তফা

কিশোরগঞ্জের যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মোস্তফা (৬৫) মাত্র ছয় বছর বয়সে মা জরিনা খাতুনকে হারালেও একাত্তরে দেশমাতৃকাই তার মা। জীবন বাজি রেখে দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য লড়াই করেছেন। 

বেশ কয়েকটি ভয়াবহ সম্মুখসমরে তিনি অংশ নেন। এ সময় কয়েকজন সহযোদ্ধাকে হারিয়েছেন তিনি। কিন্তু নিজের জীবনের মায়া তুচ্ছ করে শত্রুদের দেশের মাটি থেকে হটানোর আগ পর্যন্ত তিনি ক্ষান্ত হননি। বর্তমান রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদের হাতে রিক্রুট হয়ে ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় হানাদারদের বিরুদ্ধে সম্মুখসমরে অংশ নেন।

একাত্তরে গোলাম মোস্তফা দশম শ্রেণিতে মাত্র উঠেছেন। টগবগে দেশপ্রেম তার রক্তকণিকায়, শিরা-ধমনীতে। স্বাধীনতার ডাক শুনলেন বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে। ‘এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। 

যা বোঝার বুঝে গেলেন। আর ঘরে বসে থাকার সময় নয় এটা। আর বগলদাবা করে বই-খাতা নিয়ে স্কুলে যাওয়ার সময় নয় এটা। এবার নামতে হবে যুদ্ধে। চূড়ান্ত হিসাব-নিকাশ বুঝে নিতে হবে পাকিস্তানিদের কাছ থেকে। এর জন্য হাতে অস্ত্র নিতে হবে। এক হাতে প্রাণ, আর অন্য হাতে অস্ত্র। নামতে হবে সম্মুখযুদ্ধে। ঘরের মায়া ত্যাগ করে বেরিয়ে পড়লেন। 

মে মাসের শেষ দিকে দুটি নৌকাযোগে ৪১ জন যুবক-তরুণ পাড়ি জমালেন ভারতের উদ্দেশ্যে। তাদের সঙ্গে নৌকায় কিশোরগঞ্জের এরা দুই প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য (এমপিএ) অ্যাডভোকেট আব্দুল কুদ্দুস এবং আব্দুস সাত্তারও ছিলেন। 

প্রথমে সিলেটের তাহেরপুর সীমান্তে নেমে পায়ে হেঁটে গিয়ে উঠলেন মেঘালয় রাজ্যের বালাড প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে। সেখানে তাদের রিক্রুট করেন বর্তমান রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ। তখন আবদুল হামিদ ১৯৭০ সনের নির্বাচনে বিজয়ী সর্বকনিষ্ঠ জাতীয় পরিষদ সদস্য (এমএনও)। সেই ক্যাম্পে রিক্রুটের দায়িত্বে ছিলেন সম্প্রতি প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা সুরঞ্জিত সেন গুপ্তও।

বালাড ক্যাম্পে ২০ দিন ছিলেন। এখানে ডায়রিয়ায় নেত্রকোনার কেন্দুয়া এলাকার সহযোদ্ধা শাহজাহান মারা যান। বালাড ক্যাম্পে ২০ দিন প্রশিক্ষণের পর নেয়া হয় সমতল থেকে প্রায় তিন হাজার ফুট উপরে পাহাড়ি এলাকা ইকোয়ান প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে। 

সেখানে ১৭০ জন মুক্তিযোদ্ধাকে ৩০ দিন প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। প্রশিক্ষণের সময় যখন জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ানো হতো তখন আবেগে চোখে পানি এসে যেতো। গোলাম মোস্তফাকে থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল, স্টেনগান, এসএলআর, এলএমজি, ভারী মেশিনগান, গ্রেনেড, টাইমবোমা, ডিনামাইটসহ নানারকম বিস্ফোরকের ওপর প্রশিক্ষণ দেয়া হয়।

প্রশিক্ষণ শেষ হওয়ার পর ভারতীয় সেনাবাহিনীর কয়েকটি গাড়িতে করে তাদের নেয়া হচ্ছিল বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী মেঘালয়ের বালাঘাট এলাকায়। যাওয়ার পর থেকে একপর্যায়ে গোলাম মোস্তফাদের বহনকারী গাড়িটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পড়ে গেলো ৮০০ ফুট গভীর খাদে। দুর্ঘটনায় কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার আতকাপাড়া গ্রামের নূরুল ইসলাম, নিকলীর গুরুই এলাকার আব্দুল করিম ও হাফিজসহ ছয়জন সহযোদ্ধা মারা গেলেন। 

গোলাম মোস্তফাসহ ২৭ জন মারাত্মক আহত হলেন। তাদের ভর্তি করা হলো শিলং হাসপাতালে। গোলাম মোস্তফা ১৮ দিন চিকিৎসা শেষে সুস্থ হন। গোলাম মোস্তফার যুদ্ধকালীন কমান্ডার ছিলেন ড. মাসুদ কাদের। তাদের প্যান্টা কোম্পানিতে ১৭০ জন যোদ্ধা ছিলেন। 

সে সময় কোম্পানি কমান্ডার ছিলেন করিমগঞ্জের দেহুন্দা গ্রামের আসাদুজ্জামান। প্রশিক্ষণ নিয়ে সিলেট সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে ঢোকার পর ১০ জুন সিলেটের বিয়ানী বাজার ও তাহেরপুর এলাকায় পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারদের সঙ্গে ভয়াবহ যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে ৩০ জন পাকিস্তানি সেনা এবং ৪০ জন রাজাকার নিহত হয়। 

এসময় সিরাজ নামে এক মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন, অপর এক মুক্তিযোদ্ধা আহত হন। পরবর্তীতে নৌকাযোগে কিশোরগঞ্জের তাড়াইল এলাকায় এলে সেখানেও পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারদের সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধ হয়। শত্রুরা টিকতে না পেরে পালিয়ে যায়। তবে এক পাকিস্তানি সেনা আবুল হাশেম নামে এক মুক্তিযোদ্ধার ব্রাশ ফায়ারে মারা গিয়েছিল। 

২৯ জুলাই রাতে ময়মনসিংহের নান্দাইল এলাকার রাজাকার ও আলবদর ক্যাম্পে গোলাম মোস্তফাসহ মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ করেন। এখানে ১০ রাজাকার নিহত হয়, অন্যরা পালিয়ে যায়। ২২ আগস্ট গোলাম মোস্তফা ও তার বড় ভাই মুক্তিযোদ্ধা শহীদুল্লাহ নেত্রকোনার মদন ফতেপুর গ্রামে গিয়েছিলেন বাবা আব্দুল হামিদ খন্দকারকে এক নজর দেখার জন্য। 

ওই গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় নেয়ার কথা শুনে পাকিস্তানি সেনা ও রাজকাররা স্থানীয় বুলু চৌধুরীর বাড়িতে আগুন দিতে যায়। গ্রামের দুই দিক থেকে মেশিনগানের ব্রাশ ফায়ার আর মর্টার শেল নিক্ষেপ করতে করতে তারা এগুতে থাকে। 

এসময় গোলাম মোস্তফা ও তার ভাই শত্রুপক্ষের আক্রমণের মধ্যে পড়ে যান। দূর থেকে গোলাম মোস্তফাকে দেখে এক সেনা এলএমজি দিয়ে ব্রাশ ফায়ার করতে থাকে। গোলাম মোস্তফা ক্রলিং করতে করতে নদীর পাশে গিয়ে কোনোরকমে বেঁচে ফিরেন।

১২ সেপ্টেম্বর গোলাম মোস্তফাসহ অন্য মুক্তিযোদ্ধারা অষ্টগ্রামে পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার ক্যাম্পে হামলা করেন। তুমুল যুদ্ধ চলে দুই দিন। একপর্যায়ে টিকতে না পেরে সেনা ও রাজাকাররা পালিয়ে যায়। 

তবে যাওয়ার সময় আব্দুর রশিদ নামে এক মুক্তিযোদ্ধাকে ধরে কিশোরগঞ্জ শহরে নিয়ে অকথ্য নির্যাতন করে গোপন তথ্য নেয়ার জন্য। কিন্তু তিনি কোনো তথ্য দেননি। শেষ পর্যন্ত জয় বাংলা বলতে বলতে শহীদ হন। 

নেত্রকোনার মদন এলাকায় পাকিস্তানিদের ক্যাম্প ছিলো। ক্যাম্পটি ২৮ সেপ্টেম্বর তিনদিক থেকে ঘেরাও করে ফেলে গোলাম মোস্তফাসহ ১৫০ জনের একটি মুক্তিযোদ্ধা দল। 

সাতদিন ধরে তুমুল যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে ২০-২৫ জন পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার হতাহত হয়। আব্দুল কুদ্দুস নামে এক মুক্তিযোদ্ধা রাতের বেলায় সিগারেট খাওয়ার সময় আকাশ থেকে আগুন দেখতে পেয়ে হেলিকপ্টার থেকে পাকিস্তানিরা সেল নিক্ষেপ করলে তিনি শহীদ হন। এ সময় আরও কয়েক মুক্তিযোদ্ধা আহত হন।

পাকিস্তানি হানাদাররা মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয়ের কয়েকদিন আগেই কিশোরগঞ্জ ছেড়ে ঢাকায় চলে যায়। কিন্তু শহরের দখল ধরে রেখেছিল স্থানীয় রাজাকার-আলশামসরা। 

ফলে শহরটি মুক্ত করার জন্য ক্যাপ্টেন চৌহান ও হাবিলদার মেজর শ্রী কালিদাসের নেতৃত্বে ১৭০ জন মিত্র বাহিনীর সদস্য এবং ক্যাপ্টেন আব্দুল হামিদের নেতৃত্বে প্রায় ৮০০ মুক্তিযোদ্ধা ১৪ ডিসেম্বর চারদিক থেকে ঘেরাও করে ফেলেন। তাদের মধ্যে গোলাম মোস্তফাও ছিলেন। তিনদিন ঘেরাওকালে মাঝে-মধ্যে দুপক্ষে গুলি বিনিময় হয়। 

পাকিস্তানি সেনারা ১৬ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে আত্মসমর্পণ করলেও কিশোরগঞ্জের রাজাকাররা আত্মসমর্পণ করে ১৭ ডিসেম্বর বিকাল পৌনে ৫টায়। ফলে একদিন পর কিশোরগঞ্জ আনুষ্ঠানিকভাবে শত্রুমুক্ত হয়।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর গোলাম মোস্তফা আবার স্কুলে ভর্তি হয়ে এসএসসি পাস করেন। এরপর চাকরি নেন ফায়ার সার্ভিসে লিডার পদে। তার আদি বাড়ি নেত্রকোনার কেন্দুয়ায় হলেও পৈতৃক সূত্রে বসবাস করছেন কিশোরগঞ্জ শহরে। 

বাসা করেছেন পুরাতন কোর্ট এলাকায়। স্ত্রী, দুই ছেলে আর এক মেয়ে নিয়ে তার সংসার। ছেলেরা বিশ্ববিদ্যালয় আর ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছেন। মেয়েটি সরকারি প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতা করেন। গোলাম মোস্তফা ‘ডি’ ক্যাটাগরির যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে মাসে ২৫ হাজার টাকা ভাতা পাচ্ছেন।

তবে একাত্তরের যুদ্ধের কথা মনে পড়লে আজো তার গা শিউরে ওঠে। বয়স হয়ে গেলেও গোলাম মোস্তফা আজও কোনো যুদ্ধাপরাধীর বিচারের রায় হলে বা ফাঁসি হলে টগবগে তরুণের মতই রাস্তায় বেরিয়ে পড়েন। অন্য সহযোদ্ধাদের সঙ্গে রাস্তায় রাস্তায় গগনবিদারী স্লোগানে মিছিল করেন।

স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস আর ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসের কোনো অনুষ্ঠানেই তিনি অনুপস্থিত থাকেন না, বরং সরব উপস্থিতি দেখা যায়।

লেখক : দৈনিক আমার সংবাদ, কিশোরগঞ্জ প্রতিনিধি

আমারসংবাদ/এআই