Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪,

মশা যেন ভোট খেয়ে না ফেলে

মার্চ ২০, ২০২১, ০৩:১৫ পিএম


মশা যেন ভোট খেয়ে না ফেলে

ছোট্ট প্রাণী মশার সঙ্গে আমার চির শত্রুতা। ঘরে যদি একটাও মশা থাকে, আর সেটা যদি কানের কাছে গান গায়, সে রাতের জন্য আমার ঘুম শেষ। ছেলেবেলা থেকেই আমার অ্যাজমার সমস্যা। ধুলোবালি, ধোঁয়ায় আমার শ্বাসকষ্ট হয়। তাই মশার কয়েল আমার এক নাম্বার শত্রু। আর মশারি খাটালে আমার দম বন্ধ হয়ে আসে, বন্দী বন্দী লাগে। মশা তো আর এতকিছু বোঝে না। 

রাত হলে ঠিকই গুন গুন গান গায়, আর আমার ঘুম কেড়ে নেয়। মশার সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য এখন নানান কৌশল নিতে হয়। আমি অফিসে থাকতেই ঘরে-বারান্দায় কয়েল জ্বালিয়ে মশার উৎপাত ঠেকানোর চেষ্টা হয়। 

বিকেলের মধ্যে ঘরের সব দরজা-জানালা বন্ধ করে মশার প্রবেশ ঠেকানোর চেষ্টা হয়। লিকুইড কয়েল ব্যবহার করা হয়। এত যুদ্ধ করেও মশা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। মধ্যরাতে উঠে বসে থাকি মশা মারার জন্য। সিটি করপোরেশন নানান অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে যেখানে মশা মারতে পারে না, সেখানে আমি কোন ছার।

ছোট্ট প্রাণী হলেও মশার শক্তি অনেক। মশার সঙ্গে পেরে ওঠা দায়। আর মশা নিছক গান শুনিয়ে বা রক্ত চুষেই ক্ষান্ত হয় না। মশা ভয়ংকর সব রোগের বাহক। ডেঙ্গু-চিকুনগুনিয়ার মতো প্রাণঘাতী সব রোগ তো আছেই; ফাইলেরিয়া, ডিপথেরিয়ার মতো নানান রোগের জীবাণু নিয়েই উড়তে থাকে মশা। আসলে মশা হলো ভয়ংকর এক উড়ন্ত বোমা। মশার মতো মশা মারার চেষ্টাটাও পুরানো।

১৯৪৮ সালে লালবাগে মশা মারার অফিস স্থাপন করা হয়েছিল। তারপর বুড়িগঙ্গায় কত জল গড়িয়েছে। সিটি করপোরেশন বড় হয়েছে, সিটি করপোরেশন ভাগ হয়েছে; মশা মারার কৌশল এবং চেষ্টায় বদল এসেছে, বরাদ্দ বেড়েছে, ব্যয় হয়েছে কোটি কোটি টাকা। কিন্তু মশার দাপট কমেনি। 

মশা মারা বলতে আমরা বুঝি ফগার মেশিন দিয়ে ওষুধ ছিটানো। সেই ওষুধে কতটা কাজ হয়, মশা আদৌ মরে কি না জানি না, তবে এলাকাবাসী একধরনের সান্ত্বনা পায়। বিকট আওয়াজে এলাকা অন্ধকার করে ফগার মেশিনের দৌরাত্ম্য দেখলে আমার- মশা মারতে কামান দাগানোর কথাই মাথায় আসে। 

কিন্তু কামান দাগিয়েও মশা আসলে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। ফগার মেশিনে ওষুধ ছিটানো হলো আসলে মশা নিয়ন্ত্রণের শেষ ধাপ। মশার জন্ম ঠেকাতে না পারলে বা আঁতুড়ঘরে মারতে না পারলে মশা নিয়ন্ত্রণ করা সত্যি কঠিন। মশার বন্ধু হলো নোংরা, ময়লা, আবর্জনা আর বদ্ধ জলাশয়, জমে থাকা পানি, কচুরিপানা। প্রথম নিশ্চিত করতে হবে আমাদের চারপাশ যেন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকে। এর দায়িত্ব যতটা সিটি করপোরেশনের, তারচেয়ে বেশি আমাদের সবার।

আমার ছাদের বাগানে যেন পানি জমে না থাকে, সেটা আমাকেই নিশ্চিত করতে হবে, সিটি করোপরেশন নিশ্চয়ই প্রতিদিন আমার ছাদ পরিদর্শন করবেন না। ময়লাটা যেন আমরা ঠিক জায়গায় রাখি, যাতে সিটি করপোরেশন সময়মতো ময়লাটা সংগ্রহ করে ঠিক জায়গায় ফেলতে পারে। আপনি যদি জানালা দিয়ে ময়লা ফেলে ফেলে বাসার পেছনে ডাস্টবিন বানিয়ে রাখেন মেয়রের সাধ্যি নেই আপনার এলাকা মশামুক্ত রাখবে। তবে মশা নিয়ন্ত্রণের মূল দায়িত্বটা সিটি করপোরেশনেরই।

শহর পরিচ্ছন্ন রাখা, নির্দিষ্ট জায়গায় ময়লা ফেলা, ড্রেনগুলো সচল রাখা, খালগুলো প্রবহমান রাখা এসব কাজ অবশ্যই সিটি করপোরেশনের। ঢাকায় ড্রেন সচল রাখা একটা কঠিন কাজ। আমাদের ফেলা ময়লা-আবর্জনা, পলিথিন ফেলে আমরা ড্রেনগুলো বন্ধ করে দেই, যাতে মশা সেখানে নির্বিঘ্নে বংশবিস্তার করতে পারে। আর বৃষ্টি হলেই জলাবদ্ধতার প্রধান কারণ এই বন্ধ ড্রেন। জালের মতো বিছিয়ে ঢাকার খালগুলো দখলে-দূষণে অনেক আগে থেকেই হারিয়ে যেতে বসেছে। 

অনেকগুলো খাল মেরে বক্স কালভার্ট বানানো হয়েছে। ঢাকার যে কটি খাল বেঁচে ছিল সেগুলো এতদিন ওয়াসা দেখভাল করত। সম্প্রতি খালগুলোর দায়িত্ব নিয়েছে সিটি করপোরেশন। দায়িত্ব পেয়েই দুই সিটি করপোরেশন খাল উদ্ধারে উঠেপড়ে লেগেছে। 

অনেকদিন পর ঢাকায় একটা দৃঢ় উদ্যোগ দেখে ভালো লাগছে। সব অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে সব খাল আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হবে। খালগুলো যেন প্রবহমান থাকে তা নিশ্চিত করতে হবে। তাতে একসঙ্গে পরিবেশ ভালো থাকবে, জলাবদ্ধতা কমবে এবং সবচেয়ে বড় কথা মশার বংশবিস্তার রোধ হবে। মশা ঠেকাতে হলে সবার আগে মশার প্রজননক্ষেত্র ভেঙে দিতে হবে। মশা একবার ডিম দিলে ঠেকানো কঠিন।

বর্ষা মৌসুম আসছে। বৃষ্টি হলে হয়তো কিউলেক্স মশার উৎপাত কিছুটা কমবে। কিন্তু তখন বাড়বে ভয়ংকর এডিস মশার উৎপাত। কিউলেক্স মশা মারার ক্র্যাশ প্রোগামের পাশাপাশি সতর্ক থাকতে হবে এডিস মশা নিয়েও।

মশা মারতে সিটি করপোরেশন বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়। ফগার মেশিনে ওষুধ ছিটানোর পাশাপাশি গাপ্পি মাছ ছাড়া হয়েছিল। এখন আবার জলাশয়ে ব্যাঙ ছাড়ার কথা শোনা যাচ্ছে। মশার লার্ভা ধ্বংসে জলাশয়ে ওষুধ রাখা হয়েছে। 

তবে কোনো চেষ্টাই শতভাগ সফল হয়নি। সত্যিকার অর্থে মশা পুরোপুরি নির্মূল করা কখনোই সম্ভব নয়। নানান চেষ্টায় নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে। একই ওষুধ বার বার প্রয়োগে তার কার্যকারিতা কমে যায়। মশা পরিচিত ওষুধর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে। 

তাই ওষুধ বদলাতে হয় বার বার। অতীতে ওষুধ কেনা নিয়ে নানান অনিয়মের খবর এসেছে। এবার এখনও তেমন খবর পাওয়া যায়নি। বরং সিটি করপোরেশনের চেষ্টাটাই বেশি দৃশ্যমান। তবে যত চেষ্টাই হোক, সেটা যদি কার্যকর না হয়; তাহলে সেটা কোনো কাজই নয়।

কদিন আগে বন্ধু জ. ই. মামুন ফেসবুকে একটি পত্রিকার প্রথম পাতার ছবি শেয়ার করে লিখেছিলেন, ‘ভোরের কাগজ, ১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৭। রাজধানীর মশা নিয়ে রিপোর্ট। রিপোর্টার জ.ই. মামুন/ জায়েদুল আহসান। 

কিন্তু ২৪ বছরে মশা কিছু কমেছে কি ঢাকা শহরে? দক্ষতা কি কিছু বেড়েছে সিটি করপোরেশনের?’ সেদিন ভোরের কাগজের লিড নিউজের শিরোনাম ছিল, ‘মশা নিধনের বেহাল অবস্থা।’ এই ২৪ বছরে অবস্থা খুব একটা পাল্টায়নি। 

জায়েদুল আহসান এটিএন নিউজের এক টক শো’তে বলেছেন, এখন আবার রিপোর্ট করতে হলে তিনি একই শিরোনাম দিতে পারবেন। রিপোর্টার ২৪ বছর আগে যা লিখেছেন, বিশেষজ্ঞরাও ২৪ বছর ধরে একই কথা বলে আসছেন। কিন্তু সত্যিটা হলো, অবস্থা খুব একটা পাল্টায়নি।

কাগজে-কলমে সিটি করপোরেশনের দায়িত্ব অনেক। তবে তাদের মূল কাজ হলো, নগর পরিচ্ছন্ন রাখা এবং মশা নিয়ন্ত্রণে রাখা। এবার যেহেতু খাল তাদের নিয়ন্ত্রণে তাই জলাবদ্ধতার গালিটাও এবার ওয়াসার বদলে সিটি করপোরেশনকেই শুনতে হবে।

গত বছর ফেব্রুয়ারিতে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের মেয়রদের শপথ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘মশা আপনাদের ভোট যেন খেয়ে না ফেলে, সেটা নিশ্চয়ই আপনাদের দেখতে হবে। মশা ক্ষুদ্র হলেও অনেক শক্তিশালী। এটা মাথায় রাখতে হবে।’ 

প্রধানমন্ত্রীর এই সাবধানবাণী নিশ্চয়ই মেয়রদের মাথায় আছে। মশা মারতে যত কামানই দাগান; মানুষকে মশা কামড়ালে, সেই কামড় কিন্তু আপনার ভোটের বাক্সেও পড়তে পারে।

লেখক: প্রভাষ আমিন (সাংবাদিক, কলাম লেখক)

আমারসংবাদ/এআই