Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪,

আমার শিক্ষক যেন সৌন্দর্যবঞ্চিত না হয়

এপ্রিল ১১, ২০২১, ১২:১৫ পিএম


 আমার শিক্ষক যেন সৌন্দর্যবঞ্চিত না হয়

বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হওয়ার পর শিক্ষকদের নেমপ্লেট খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখার অভ্যাস ছিল আমার। ধারণা ছিল, নেমপ্লেটে লেখা ডিগ্রী যার যত বেশী তিনি তত বড় শিক্ষক। এ বিশ্বাস নিয়ে বেশ কয়েক বছর চললাম এবং প্রফেসর সুব্রত মজুমদার স্যারকে একজন সাধারণ মানের শিক্ষক হিসেবেই মনে করলাম। কারণ স্যারের নেমপ্লেটে শুধু লেখা ছিল, প্রফেসর সুব্রত মজুমদার। 

আমাদের মতো লেখা ছিল না, প্রফেসর ক, পিএইচডি খ, পোস্টডক গ, ডিপ্লোমা ঘ ইত্যাদি ইত্যাদি। ফলিত ও বিশুদ্ধ গণিতে ছাত্র ভাগাভাগির কারণে স্যারের কোর্সগুলো পড়া হয়নি আমার। 

তবুও যে কোনো বিষয় নিয়ে আলোচনা এবং গণিত বিভাগের বারান্দায় দাঁড়িয়ে গণিতের বিভিন্ন জানা-অজানা গল্প বলা ছিল স্যারের নিত্য দিনের অভ্যাস। এবং এখনও তা অব্যাহত আছে। স্যারের এই অভ্যাসে আমাদের অনেকের বদঅভ্যাস হয়ে গেল। স্যারকে সামনে পেলেই এখনও আমরা অনেক কিছু জানতে চাই। আর স্যার জানাতে পেরে খুশি হন। 

শাহ্জালাল বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার জন্য যখন এনওসির জন্য শাবির তৎকালীন প্রোভিসি প্রফেসর হাবিবুর রহমান স্যারের কাছে যাই তখন স্যার আমাকে জিজ্ঞেস করেন, শাবি কেন ছেড়ে যাবে? আমার উত্তর ছিল, রাবিতে বট-বৃক্ষের মতো গণিতের কয়েকটি গাছ আছে তাঁদের ছায়ায় থাকতে চাই। 

স্যার কোনো সময় না নিয়ে ফাইল সই করে দিলেন। বললেন, বেস্ট অব লাখ।আদর্শ, চরিত্র, একাডেমিক এবং প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আমরা যখন অনেকে নানা অপকর্মের জন্ম দিচ্ছি, তখনও কেউ কেউ এ আদর্শ টিকিয়ে রাখার ব্রত নিয়ে এগিয়ে গেছেন বা যাচ্ছেন। 

তেমনি একজন শিক্ষক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের সাবেক প্রফেসর সুব্রত মজুমদার স্যার। বেশ কয়েক বছর হলো স্যার অবসরে গেছেন। অবসরে গেলেও গণিত বিভাগে তাঁর আসা-যাওয়া আমাদেরকে দায়িত্বের প্রতি সচেতনতা আরও বাড়িয়ে দেয়। প্রফেসর সুব্রত মজুমদার স্যারকে নিয়ে অনেক কথা বলা যায়, অনেক কথা লেখা যায়। যারা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একটু খোঁজ-খবর রাখেন তারা বিষয়টি জানেন।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের ৬৭ বছরের ইতিহাসে ৪৬ বছর ধরেই শিক্ষকতা পেশায় ছিলেন প্রফেসর মজুমদার। শিক্ষকতার পাশাপাশি গুণী এ প্রফেসরের সঙ্গীত জগতেও আছে অগাধ জ্ঞান এবং বিচরণ। 

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছোট-বড় প্রায় সব ধরণের সংগীত অনুষ্ঠান বা প্রতিযোগিতায় তাঁর বিচরণ ছিল এবং এখনও তা আছে। তাঁর আর্শীবাদ নিয়ে আজ বাংলাদেশের সংগীত জগতে অনেকেই প্রতিষ্ঠিত।

বইয়ের পাতার আদর্শ শিক্ষকের বাস্তব উদাহরণ আমাদের স্যার প্রফেসর সুব্রত মজুমদার। পাঠদান এবং গবেষণা কাজের প্রতি তিনি যেমন দায়িত্ববান, তেমনি কাজগুলো করেন অত্যন্ত নিয়মতান্ত্রিকভাবে। আর এরই ধারাবাহিকতায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের গবেষণার কাজকে কতটা এগিয়ে দিয়েছেন তা স্বচক্ষে না দেখলে বোঝা যাবে না। প্রফেসর মজুমদারের তত্ত্বাবধায়নে আমাদের অনেক সহকর্মী আজ পিএইচডি ও এমফিল ডিগ্রী অর্জন করে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। 

তিনি প্রায় অর্ধশতাধিক আন্তর্জাতিকমানের প্রকাশনা ও কয়েকটি বই লিখেছেন। তিনি ম্যকারারে বিশ্ববিদ্যালয় এবং বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়-এ যথাক্রমে সহযোগী অধ্যাপক এবং সহকারী প্রভাষক হিসেবে প্রায় পাঁচ বছর যাবত শিক্ষাদান করেছেন। প্রফেসর মজুমদার আইসিটিপি, আমেরিকা, কলকাতা এবং বাংলাদেশ ম্যাথমেটিক্যাল সোসাইটির একজন সম্মানিত সদস্য। পাশাপাশি তিনি বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াডের সদস্য হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন। অবসরের পরে তিনি ইউজিসি প্রফেসর হিসেবে মনোনয়ন পান।

রসকষহীন সাবজেক্ট বলে গণিতের অনেক দুর্নাম আছে। দুর্বোধ্য এবং কঠিন বলে কিনা  জানিনা গণিত পড়তে মেয়েদের আগ্রহ অনেক কম থাকতো নব্বই দশকের দিকে। বর্তমানে এর পরিবর্তন ঘটেছে। দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিতে ছাত্র এবং ছাত্রীর ভর্তির অনুপাত প্রায় সমানে সমান এবং ভাল ফলাফলে মেয়েরা অনেক এগিয়ে। 

এর একটা কারণ হতে পারে পড়ালেখার সরাঞ্জাম হাতের নাগালেই পাওয়া যাচ্ছে। বিদেশীদের পাশাপাশি গণিতের উপর পর্যাপ্ত দেশি শিক্ষকরাও বই লিখছেন। সম্প্রতি প্রফেসর মজুমদার স্যার 'গণিতবিদদের জানা-অজানা গল্প' নামে ষোল জন শ্রেষ্ঠ গণিতবিদ ও তাদের কীর্তি নিয়ে একটি বই লিখেছেন।

বইটিতে গণিতবিদদের যে গল্প উঠে এসেছে তা শুধু গণিতের ছাত্রদের নয় অন্য ডিসিপ্লিনের ছাত্রদেরও আনন্দ দেবে এ বিশ্বাস আমার। স্যার ক্লাসে লেকচারের পাশাপাশি গণিত বা ফিজিক্স বিষয়ক থিওরী আবিস্কারের পেছেনের কাহিনী বলার চেষ্টা করতেন বা করেন যা ছাত্রছাত্রীরা বাড়তি পাওনা হিসেবে পায় এবং গণিত ভীতি দূর হয়। 

স্যার একদিন রসিকতা করে বলছিলেন, 'নিউটনের দ্বিতীয় সূত্রটি কেন নিউটনের আগে আবিস্কৃত হলো না সেটাই আমি ভেবে পাই না।' তিনি অবশ্য এও বলেছিলেন, 'নিউটনকে ছোট করার জন্য কথাটি বলছি না, বরং তার এ থিওরী বিজ্ঞানের দ্বার এমনভাবে উন্মোচন করেছে যে শ্রদ্ধায় মাতা নত হয়ে আসে।' 

রাবির গণিত বিভাগে একসময় ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কে ছিলেন প্রফেসর সুব্রত মজুমদার স্যার এবং প্রফেসর আবু সালেহ্ আব্দুন নূর স্যারের। প্রসঙ্গক্রমে নূর স্যার ছাত্রাবস্থায় একদিন সুব্রত স্যারকে বলেছিলেন, 'স্যার আমি আপনাকে খুব ভালবাসি।' সুব্রত স্যারের রসিকতা ছিল, 'আমাকে ভাল না বেসে তো তোমার উপায় নেই।' উল্লেখ্য নূর স্যারদের ক্লাসে

কোনো ছাত্রী ছিল না। মানুষের সৌন্দর্য মনে না বাইরে তা নিয়ে তর্ক থাকতে পারে। কিন্তু গণিত বিভাগে পড়তে এসে প্রফেসর সুব্রত মজুমদার স্যারের সব ধরণের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়নি এমন ছাত্রছাত্রী মেলা ভার। 

স্যারের মায়াবী মুখ যেমন সবাইকে আকৃষ্ট করে, তেমনি ভেতরের সৌন্দর্যবোধ ও রসিকতাও সবাইকে মুগ্ধ করে। আমার বিশ্বাস গণিত বিভাগ-ফেরত সবাইকে আন্দোলিত করে গণিত বিভাগের বারান্দায় দাঁড়িয়ে স্যারের সাথে গণিত চর্চার দিনগুলো। 

গণিত বিভাগের সেই সৌন্দর্য আজ অনেকটা হলেও মলিন হয়ে গেছে বরৈণ্য এসব শিক্ষকের অভাবে। সবশেষে স্যারের দীর্ঘ জীবন কামনা করি আর বলি, 'আমার শিক্ষক যেন সৌন্দর্যবঞ্চিত না হয়।'

লেখক- ড. আসাবুল হক (প্রফেসর, গণিত বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়)

আমারসংবাদ/এআই