মাহবুবুর রহমান
জুন ২৫, ২০২১, ০২:৫০ পিএম
২০১০-১১ সালের দিকে যখন শেয়ার বাজারে কেলেংকারী হলো, কে বা কারা শেয়ার বাজার থেকে মানুষের টাকা-পয়সা চুরি করে নিলো, তখন ড. জাফর ইকবাল স্যার প্রথম আলো পত্রিকাতে একটা কলাম লিখেছিলেন। আমি ক্যাম্পাসের হলে বসে কলামটি মন দিয়ে পড়েছিলাম। তার কলামের একটি অংশ জুড়ে এ ঘটনার নিন্দা জ্ঞাপন করে আশু ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলেছিলেন। আর বাকী অংশ জুড়ে তিনি কষ্ট করে, গায়ে খেটে, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে আয় রোজগার করার জন্য উদ্বুদ্ধ করেছিলেন।
লেখাটি আজও আমার মনে ধরে আছে। কলামটি পড়ার পর আমি নীতিগত ভাবে নিজের জন্য একটা সিদ্ধান্ত নিই। সেটা হলো, শর্ট-কাট রাস্তা দিয়ে, সাময়িক ধান্দা করে, কষ্ট-ক্লেশ না করে কখনো আয়-রোজগারের ইচ্ছা করবো না। আমি এখনো এই নীতিতে অটল আছি এবং বর্তমান সমাজে সচ্ছলতার মধ্য দিয়েই দিনাতিপাত করছি।
আমার মাধ্যমিক লেভেলের বন্ধু, যার সাথে আমার ক্লাসে ফার্স্ট হওয়া নিয়ে প্রতিযোগিতা হতো, এসএসসি তে এ প্লাস পেলো। আমিও বোর্ড বৃত্তি সহ এ প্লাস পেয়েছিলাম। এর পর সে কলেজে ভর্তি হয়ে ডেসটিনি করে আমেরিকা, ইংল্যান্ডে সভা-সমিতি করে বেড়াবে বলে স্বপ্ন দেখতে লাগলো। আমি যখন অনার্স ২য় বর্ষে, সে ঢাকা এসে আমার কাছে একদিন ছিলো। একটা ব্রান্ড নিউ কার দেখিয়ে বললো, এই তো আর ক'টা দিন পরেই আমিও এমন গাড়িতে চড়ে বেড়াবো। তুমি এতো কষ্ট করে পড়ালেখা করে কী করবা?
আমি শুধু মুচকি হেসেছিলাম। আজ সে কোথায় আছে আর খুঁজে পাইনি। বন্ধুদের কাছ থেকে শুনেছি সর্বশান্ত হয়ে এখন কোন একটা কোম্পানিতে সেলস অফিসারের চাকরি করে। আমি আজো তাকে অনুভব করি মন থেকে ভালবেসে। কিন্তু তাকে কোন ভাবেই আর ট্রেস করতে পারিনি। অথচ সে এক অপার সম্ভাবনাময়ী ছেলে ছিলো।
এই যে ডেসটিনির মতো এমএলএম ব্যবসা পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান যেগুলো ছিল বা আছে এগুলো মানুষের চোখে প্রথমে রঙিন চশমা পরিয়ে দেয়। চটকদার কথা-বার্তা, চমক লাগানো সব স্বপ্নের বীজ বুনে দেয় মানুষের অন্তরে, বিশেষত অর্থ কষ্টে ক্লিষ্ট তরুণ প্রজন্মর মধ্যে৷ তারা মুহূর্তে প্রাডো, পাজেরো, মার্সিডিজ বেঞ্জ, এক্সিয়, রকেটে করে ইউরোপ-আমেরিকা হয়ে মঙ্গল গ্রহের পথ পাড়ি দেওয়ার সকল বন্দোবস্ত করে ফেলে। স্বপ্ন মুহূর্তেই মন থেকে উড়ে ইথারে ইথারে ভাসতে থাকে। এভাবেই, সরল মনা বাঙ্গালী যুবকদের পড়ালেখাসহ বুদ্ধিবৃত্তিক ক্যারিয়ারের অপূরণীয় ক্ষতি করে ফেলে এবং আর্থিক ভাবে সর্বশান্ত করে দেয়।
ইভ্যালি অবশ্যই এমএলএম ব্যবসা পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান নয়। তবে উঠতি তরুণ প্রজন্ম ঘরে বসে বিনা পরিশ্রমে আয়-রোজগারের যে মনোবাসনা নিয়ে এর পেছনে ছুটছে তা নিশ্চিত বিবেকে ভয় লাগানোর মতো। আমার অনেক কাছের আত্নীয় যারা মাত্র ৬ষ্ঠ বা ৭ম শ্রেণিতে পড়ে তারাও দেখছি এই ব্যবসায় ঝুকছে। তাদের মাথা থেকে পড়ালেখার চিন্তাতো গেছেই, বরং তারা সারাটাদিন এগুলোর পেছনে খেয়ে-না খেয়ে লেগে আছে।
কষ্ট না করে, মাথার ঘাম পায়ে না ফেলে আয় রোজগার করার নিয়্যাত করা মানেই সেখানে সমূহ বিপদ। মানুষের জন্য এই পন্থা কখনো টেকসই হতে পারে না। কল্পনা করা যায়? একটা প্রতিষ্ঠান, আমি ইভ্যালির কথায় বলছি, যা তার মূলধনের চেয়ে ৬ গুন বেশী টাকা ঋণী, তাদের কাছে টাকা ঢেলে দিয়ে নাকে সরিষারর তেল দিয়ে ঘুমানোর ইচ্ছা করছি আর ভাবছি রাতারাতি কোটিপতি হয়ে যাবো। ইভ্যালি সর্বোচ্চ নিজের একটি পণ্য ক্রয়ের প্লাটফর্ম হতে পারে, তাই বলে এটা কোটি লক্ষ কোটি টাকা বিনিয়োগ করার মতো কোন যায়গা না। হ্যাঁ, আপনার নিজের জন্য কোন একটি পণ্য ক্রয় করা দরকার তার জন্য আপনি টাকা দিতে পারেন। দুর্ঘটনা ঘটলে অল্পের উপর দিয়ে যাবে। কিন্তু ১০ টা মোটরসাইকেল ক্রয়ের জন্য আপনি টাকা জমা দিয়ে রাখছেন। কোন আর্থিক কেলেঙ্কারী হলেই তো আপনি সর্বশান্ত হয়ে যাবেন।
এক্ষেত্রে আমরা শেক্সপিয়ারের লেখা ম্যাকবেথ থেকে শিক্ষা নিতে পারি। তার এই রচনার মূল প্রতিপাদ্য হচ্ছে আমরা মাঝে মাঝে কিছু রঙ্গিন স্বপ্ন দেখি। ভুল ভবিষ্যতে একটা-দুইটা স্বপ্ন মিলে গেলে তখন আমরা বাকি গুলো ছুয়ে দেখার জন্য স্বপ্নে বিভোর হয়ে যায়, ঠিক যে ভাবে ম্যাকবেথ এবং তার স্ত্রী তাদের রাজাকে মেরে ফেলে সমগ্র রাজত্ব করায়ত্ত করার স্বপ্ন দেখেছিল। অবশেষে তারা রাজাকে মেরেছিলো, তবে, নিজেরা আর এ রাজত্ব ভোগ করতে পারিনি। ম্যাকবেথ পাগল হয়ে যান। ব্যাপারটা এমনই। একটু একটু করে টাকার গন্ধে যখন বেশী করে এ সকল ব্যবসায় আমরা আমাদের পুঁজি ঢেলে ফেলি, ঠিক তখনই আমরা আম-ছালাসহ সব হারিয়ে পথে বসে যায় বা এমনটা ঘটার সম্ভাবনা থাকে।
শর্টকাট চিন্তা বাদ দিয়ে পরিশ্রম করলে আল্লাহ তাতে বরকত দেন। প্রবাদ আছে- পরিশ্রমের ভার ভগবানে বয়। আসুন মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কষ্ট করি, পরিশ্রম করি। তাতে আমার আপনার সাথে সমাজের আরো দশেরও উপকার হবে। রাতারাতি বড়লোক হওয়ার ইচ্ছা বাদ দিই। যারা আপনাকে রাতারাতি কোটিপতি হওয়ার স্বপ্ন দেখায় তাদেরকে এড়িয়ে চলুন। নিজে সতর্ক থাকি, আসুন অন্যদেরকেও সতর্ক করি। আমাদের মনে রাখা দরকার- স্লো এ্যান্ড স্টিডি উইন্স দ্যা রেস।
লেখক: মাহবুবুর রহমান
শিক্ষক, আইন বিভাগ, ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি।
আমারসংবাদ/কেএস