Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪,

একটি ট্যাবলেটে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ একমাস

কাজী আনোয়ারুল ইসলাম টুটুল

সেপ্টেম্বর ২, ২০২১, ১০:৫৫ এএম


একটি ট্যাবলেটে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ একমাস

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০১২ হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী ডায়াবেটিসের কারণে আনুমানিক ২২ লক্ষাধিক মৃত্যু হয়েছিল।  যার মধ্যে ২০১৯ সালে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ১ কোটি। গবেষণায় বলছে ২০৪৫ সালের মধ্যে এটি দ্বিগুণ হবে।

আমেরিকান ডায়াবেটিস এসোসিয়েশনের হিসাব অনুযায়ী, একজন আমেরিকান প্রতিবছর ডায়াবেটিসের চিকিৎসা গ্রহণ করতে প্রায় ১৬৭৫২ ডলার খরচ করেন। বাংলাদেশ-অস্ট্রেলিয়া যৌথ গবেষণায় উঠে এসেছে। একজন বাংলাদেশী প্রতিবছর ডায়াবেটিসের জন্য খরচ করেন ৭০ হাজার টাকার বেশি।এই পরিসংখ্যানগুলো অর্থনৈতিক ও স্বাস্থ্যসেবা ডায়াবেটিসের ভয়াবহ অবস্থা তুলে ধরে।

যদিও ডায়াবেটিস চিকিৎসায় এখন পর্যন্ত ইনসুলিন অপ্রতিদ্বন্দ্বি। তবে এই ব্যবস্থায় একজন রোগীকে প্রতিদিন একবার করে ইনসুলিন বা একাধিকবার ইনসুলিনের ইঞ্জেকশন  নিতে হয়। ডায়াবেটিস চিকিৎসায় খরচ এবং ইনজেকশনের মাধ্যমে ইনসুলিন গ্রহণ।ইনসুলিনের অতিরিক্ত ব্যবহার এবং এর কার্যকারিতা সম্পর্কে বর্তমান চিকিৎসা ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। 

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডাব্লুএইচও)এর মতে, বিশ্বব্যাপী ডায়াবেটিস রোগীদের ৯০-৯৫ শতাংশ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। এবং এদের মধ্যে ৮০ ভাগ রোগী অনুন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশে বসবাস করছে। সুতরাং ৮০ভাগ মানুষের অর্ধেকই ডায়াবেটিকস এর সঠিক চিকিৎসা নিতে পারে না।

ডায়াবেটিস চিকিৎসা সংক্রান্ত সকল জটিলতা দূর করতে বাংলাদেশ ভারত ও দক্ষিণ কোরিয়ার একদল বিজ্ঞানী অনেকদিন থেকেই গ্লুকাগন-লাইক-পেপটাইড-১ (জিএলপি-১) নামক একটি জিন নিয়ে গবেষণা করছিল। এই গবেষণাটি দক্ষিণ কোরিয়ার ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অফ ট্রান্সপর্টেশন, কেরিয়া ইন্সটিটিউট অফ সাইন্স এন্ড টেকনোলজি এবং হানিয়াং ইউনিভার্সিটি তে পরিচালিত হয়। এই গবেষণায় নেতৃত্ব দেন বাংলাদেশি গবেষক শাতিল শাহরিয়ার।ডায়াবেটিকস প্রতিরোধে এই গবেষক দলের মূল লক্ষ্য ছিল এমন এক মৌখিক প্রতিষেধক আবিষ্কার করা।যেটা ইনজেকশনের মাধ্যমে গ্রহণ করতে হবে না। 

বরং মৌখিকভাবে ট্যাবলেট বা ক্যাপসুল এর মত গ্রহণ করা যাবে। খুব অল্প মাত্রায় দীর্ঘদিন কাজ করবে। যাতে ডায়াবেটিসের চিকিৎসা পদ্ধতি সহজ হয় এবং ডায়াবেটিসের চিকিৎসা খরচ অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের রোগীদের সাধ্যের মধ্যে নিয়ে আসা।ডায়াবেটিকস এর সকল পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার বিরুদ্ধে কাজ করবে। 

যেন ডায়াবেটিসের বিভিন্ন উপসর্গের জন্য বিভিন্ন ওষুধ সেবন করতে না হয়। ইনজেকশন নির্ভর বর্তমান চিকিৎসা ব্যবস্থার মাধ্যমে যেহেতু এই লক্ষণগুলো অসম্ভব। তাই গবেষক দলটি নতুন ড্রাগ মলিকিউল নিয়ে কাজ করার পরিবর্তে জিন থেরাপিতে বেশি আগ্রহী ছিলেন বলে জানান শাতিল শাহরিয়ার। সাধারণত একটি ওষুধ রক্তে যতটুকু মাএায় প্রবেশ করে ঠিক ততটুকুই কাজ করে। কিন্তু জিএলপি-১ জিনের জেনেটিক ট্রান্সফেকশন কোষগুলো ডিএনএ প্রবর্তনের এমন একটি কৌশল যেটার মাধ্যমে শরীরের কোষগুলি থেকে প্রয়োজনমত প্রতিষেধক তৈরি সম্ভব। 

সম্প্রতি গবেষণা পত্রটি বিশ্বের সবচেয়ে বিখ্যাত কমিউনিকেশন এর একটি "ন্যানো লেটার্স" কর্তৃক প্রকাশ পায় এবং প্রকাশিত হয়। আমেরিকার কেমিক্যাল সোসাইটির এই এলিট ক্লাস জার্নাল দাবি করেছে যে বাংলাদেশি গবেষক শাতিল শাহরিয়ারের নেতৃত্বে গবেষক দলটি জিন থেরাপি এবং ন্যানোটেকনোলির সমন্বয়ে ডায়াবেটিসের এমন একটি মৌখিক প্রতিষেধক তৈরি করেছেন, যেটা একবার মৌখিক সেবনের মাধ্যমে মানুষের শরীরে একমাসেরও বেশি সময় ডায়াবেটিসের মাএা নিয়ন্ত্রণে সক্ষম।

এই গবেষণার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে এই প্রতিষেধক ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে বহুল ব্যবহৃত ইনসুলিনের চেয়ে হবে সাশ্রয়ী ও ফলপ্রসূ এবং কার্যকরী।ইনসুলিন গ্রহণের আগে যেমন রোগীকে খালি পেটে থাকার প্রয়োজন আছে। এই প্রতিষেধক গ্রহণে সেটার প্রয়োজন নেই। 

ইনসুলিনের মতো আবার দিনের মধ্যে একাধিকবার ইনজেকশনের মাধ্যমে গ্রহণ করতে হবে না এই প্রতিষেধক। এক ডোজে কাজ করতে সক্ষম একমাস অবধি। সুতরাং ডায়াবেটিস চিকিৎসার খরচ চলে আসবে মানুষের হাতের নাগালে। আর প্রতিদিন সহ্য করতে হবে না ইনজেকশনের অসহনীয় ব্যাথা।

একজন সুস্থ মানুষে শরীরে ইনসুলিন তৈরি হয় এবং কাজ করতে পারে। এই প্রতিষেধকও অনুরূপভাবে কাজ করতে পারবে একজন ডায়াবেটিস রোগীর শরীরে। এখানেই পার্থক্য ইনসুলিনের এই প্রতিষেধকের। ডায়াবেটিস রোগীর শরীরেই তৈরি হবে সক্রিয় ইনসুলিন। তাই বারবার ইন্সুলিন ইঞ্জেকশন করার প্রয়োজন নেই। রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা বেড়ে গেলে যেমন একজন সুস্থ মানুষের শরীর থেকে  প্রয়োজন অনুযায়ী ইনসুলিন উৎপাদিত হয়, ঠিক তেমনি এই প্রতিশোধ সেবনে একজন ডায়াবেটিস রোগীর শরীরেও প্রয়োজনীয় মাত্রায় ইনসুলিন তৈরি হবে। সুতরাং ইনসুলিনের মাত্রাতিরিক্ত ডোজ সংক্রান্ত কোন জটিলতার সম্মুখীন হতে হবে না এখন রোগীকে।

বিখ্যাত জার্নাল "ন্যানো লেটার্স" বলেছে স্বল্পমাত্রার এই প্রতিষেধক ইনসুলিন তৈরি বা দীর্ঘমেয়াদিভাবে রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে শুধু করে না বরং ডায়াবেটিস রোগে আক্রান্ত হয়ে শেষ পর্যায় আছে এমন রোগীদেরও খাদ্য অভ্যাস প্ররবর্তন, অস্বাভাবিক ওজন বৃদ্ধি, যকৃত নষ্ট হয়ে যাওয়া, হৃদরোগ এবং উচ্চরক্তচাপ সহ ডায়াবেটিস এর বিভিন্ন ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার বিরুদ্ধে কাজ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে নিয়ে আসতে সক্ষম।

জিএলপি ১ জিনের এই মৌখিক ডোজ মাত্র কয়েকবার সেবনে মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাসের মাধ্যমে বারবার ক্ষুধা বা পিপাসা লাগা এবং বারবার খাবার গ্রহণের প্রবণতা হ্রাস করার পাশাপাশি খাবার গ্রহণে পরিপূর্ণতা এবং তৃপ্তি বাড়িয়ে দিতে সক্ষম।তাছাড়া, শরীরের মেদ ও চর্বি কমানোর মাধ্যমে অস্বাভাবিকহারে ওজন বৃদ্ধি ব্যাহত করে। রক্তে ট্রাইগ্লিসারাইডের মাত্রা অতিরিক্ত উপস্থিতি হৃদরোগ,স্টোক এবং উচ্চ রক্তচাপসহ অগ্ন্যাশয়ের কোষগুলোকে ধ্বংস করে ডায়াবেটিস রোগীদের মৃত্যু পর্যন্ত ট্রাই গ্লিসারাইড এর মাথা ৫০ শতাংশ কমিয়ে দিতে সক্ষম", এমনই চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে গবেষণায়।

সম্প্রতি আমেরিকার ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ) কোষের জিএলপি-১ রিসেপ্টর সক্রিয় করে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করতে পারে এমন দুটি প্রতিষেধক  trulicity (ট্রুলিসিটি)এবং tenzeum (ট্যানজিয়াম)কে স্বীকৃতি দিয়েছে। প্রিক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের তথ্য অনুযায়ী ট্রুলিসিটির প্লাজমা মাত্রা ডায়াবেটিকস বানরে কেবল মাত্র দুই দিনের জন্য স্থির থাকে। 

গবেষণা বলছে, প্রিক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে মৌখিক প্রতিষেধকটি আমেরিকার এফডিএ কর্তৃক স্বীকৃত প্রতিষেধক ট্রুলিসিটির ইনজেকশন এর চেয়ে সাতগুণ বেশি কার্যকরী। কারণ একবার সেবনে ডায়াবেটিস বানরে এই প্রতিষেধক কমপক্ষে ১৪ দিন পর্যন্ত সক্রিয় থাকার প্রমাণ মিলেছে। 

এছাড়া এফডিএ এর তথ্য অনুযায়ী, ট্রানজিয়ামের ইনজেকশন প্রিক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে ডায়াবেটিকস বানরে প্রতি কেজি ওজনের ৫০ মিলিগ্রাম কার্যকর। অন্যদিকে মৌখিক এই প্রতিষেধক ট্রনজিয়াম ইনজেকশনের তুলনায় ১৭০ শতাংশ কম ডোজে কার্যকরী কারণ প্রিক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে এই প্রতিষেধক মাত্র ০.৩ মিলিগ্রাম প্রতিকেজি শরীরের ওজনে সর্বাধিক কার্যকর। 

যেহেতু প্রতিষেধক সেবনে শরীরের ভেতর থেকে ইনসুলিন ও জিএলপি তৈরি হয় তাই অন্য প্রতিষেধকের উপর নির্ভর নয় আশার কথা এই যে এফডিএ কর্তৃক স্বীকৃত এই দুইটি প্রতিষেধক শুধুমাত্র ইনজেকশন ডোজে কার্যকরী। কিন্তু আবিষ্কৃত এই প্রতিষেধক খুব অল্প মাত্রায় মৌখিক ডোজে কার্যকরী অ্যালোমেট্রিক নীতি জার্নালে যে এটা মানুষের শরীরের রক্তের গ্লুকোজ এক মাস অবধি নিয়ন্ত্রণের রাখবে।

ইঁদুর বানর এবং মানব দেহের বিভিন্ন অংশের উপর গবেষণা করে জানা গেছে, এই প্রতিষেধক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াবিহীন গ্লুকাগন পেপটাইড (জিএলপি-1) নামক এই ওষুধটি আমেরিকার ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন দিয়ে কর্তৃক স্বীকৃত। গবেষণায় পাওয়া যায় এই সফলতা ডায়াবেটিস রোগীদের বর্তমানের বেদনাদায়ক চিকিৎসা অভিজ্ঞতাকে পরিবর্তন এবং তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন করতে পারে বলে দাবি আমেরিকান কেমিক্যাল সোসাইটির।

আমারসংবাদ/এআই