মো. জহিরুল ইসলাম
অক্টোবর ৩১, ২০২১, ০৭:০৫ পিএম
বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ দুটি শব্দ, একটি ইতিহাস। খোকা থেকে মুজিব, মুজিব থেকে বঙ্গবন্ধু, বঙ্গবন্ধু থেকে বাঙালি জাতির পিতা। অতঃপর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, ইতিহাসের কালজয়ী মহাপুরুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ইতিহাস বঙ্গবন্ধুকে স্থান করে দিয়েছে বাঙালির হূদয়ের মণিকোঠায় চিরদিনের জন্য, মহাকালের জন্য।
খোকা একদিন পিতা হলেন। পিতা শুধু পুত্র-কন্যার জন্য নন। একটি অসহায়, ঘুমন্ত, শোষিত, নিষ্পেষিত-নিপীড়িত অথচ বীর জাতিকে তিনি মুক্তির মন্ত্রে উজ্জীবিত করলেন, বাঁচার অধিকার দিলেন, একটি স্বাধীন দেশ ও স্বাধীন মানচিত্র দিলেন। তিনি গ্রামে গ্রামে, পথে-ঘাটে, মাঠে-প্রান্তরে, মানুষের দ্বারে দ্বারে গিয়ে বাঙালির মুক্তির কথা বলেছেন। তার চেতনা আর আদর্শে ৩০ লাখ বীর বাঙালি বুকের তাজা রক্ত উৎসর্গ করেছিলো একটি দেশের স্বাধীনতার জন্য।
স্বাধীনতা ঘোষণা দেয়ার অপরাধে ২৬ মার্চ ১৯৭১-এর রাত ১টা ১০ মিনিটে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাসভবন থেকে গ্রেপ্তার করা হয় বঙ্গবন্ধুকে। তিনি হয়ে উঠলেন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সমগ্র বাঙালি জাতি ‘জয় বাংলা- জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগানে ঐক্যবদ্ধ হলো। সংগ্রাম, সংকল্প আর ৩০ লাখ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত হলো একটি স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের।
স্বাধীনতার পূর্বেই জাতির পিতা বাংলার যুবসমাজের মুক্তির কথা চিন্তা করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে বড় বিকাশ যুব বয়সে। ভাষা সংগ্রামীরা ছিলেন ছাত্র-যুবক-তরুণ। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন হতে শুরু করে ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের অধিকাংশ ছিলো তরুণ ও যুবসমাজ। ১৯৫৩ সালে ৩৩ বছরের টগবগে বাঙালি যুবক শেখ মুজিবুর রহমানই দায়িত্ব নিয়েছিলেন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন,‘দেশের প্রায় শতকরা সত্তরটা ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে সক্ষম হলাম। যুবক কর্মীরা আমার দিকে ঝুঁকে পড়লো। কারণ আমিও তখন যুবক ছিলাম’।
বঙ্গবন্ধুর রচিত ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ এবং ‘কারাগারের রোজনামচা’ বইয়ে একদিকে তারুণ্যের ওপর এ মহান নেতার বিশ্বাস ও আস্থার কথা, অন্যদিকে তাদের তরুণ বয়সের সংগ্রাম ও ইতিহাসের কথা বলা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর লেখা ‘‘New China 1952’’-এ সাম্যবাদী এক মুজিবকে খুঁজে পাওয়া যায়।
যিনি নিজ দেশের যুবকদের নিয়ে উন্নত ও সমৃদ্ধ রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেছেন। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার অংশগ্রহণ, বিশেষ করে জাতি গঠনে যুবদের অগ্রসৈনিক হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে তার যৌবনের উত্তাপ দিয়ে সাড়ে সাত কোটি বাঙালির মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় গড়ে তুলেছিলেন শিক্ষা-শান্তি-প্রগতির পতাকাবাহী সংগঠন ছাত্রলীগ।
শিষ্ঠাচার, বিনয় ও শিক্ষার সাথে দীক্ষা, কর্মের সাথে নিষ্ঠা, দেশাত্মবোধের সাথে মানবীয় গুণাবলির সংমিশ্রণ ঘটিয়ে সোনার বাংলা বিনির্মাণে বাংলার যুবসমাজকে গড়ে তোলার জন্য তিনি অন্তহীন প্রেরণা জুগিয়েছেন। তিনি বলেছিলেন,‘এ স্বাধীনতা আমার ব্যর্থ হয়ে যাবে যদি আমার বাংলার মানুষ পেট ভরে ভাত না খায়। এই স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না যদি বাংলার মা-বোনেরা কাপড় না পরে। এ স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না যদি এ দেশের মানুষ যারা আমার যুবক শ্রেণি আছে, তারা চাকরি না পায় বা কাজ না পায়’।
১৯৭৩ সালের ৪ মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার ভাষণে বলেছিলেন,‘শেখ মুজিবুর রহমানকে বেটে খাওয়ালেও বাংলা সোনার বাংলা হবে না যদি আপনারা সোনার বাংলার সোনার মানুষ পয়দা করতে না পারেন’। দেশের মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ যুবক। তাদের মেধা-মনন, শিক্ষা-কর্মসংস্থান বিষয়ে বঙ্গবন্ধু অসংখ্যবার নানাভাবে বলেছেন। রাজশাহীতে দেয়া এক ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন,‘আমার বাংলার বেকার যুবকরা কাজ পাক, আমার সোনার বাংলার মানুষ প্রাণ ভরে হাসুক— এটাই আমি চাই’।
বঙ্গবন্ধু যুবকদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন— ‘ছাত্র ভাইদের বলি, একটু লেখাপড়া করো, বাবার হোটেলে আর কতকাল খাবে? তোমাদের মানুষ হতে হবে। মানুষ না হলে দেশ গড়তে আমি পারবো না। ভবিষ্যতে তোমাদের এ দেশের শাসনভার হাতে নিতে হবে’।
তরুণ-যুবদের ভবিষ্যৎ নিয়ে জাতির পিতা ১৯৭২ সালের ১৯ আগস্ট সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এক জনসভায় দেশ গড়ার জন্য যুব-তরুণদের কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেছিলেন,‘কাজ করো, কঠোর পরিশ্রম করো, না হলে বাঁচতে পারবে না। শুধু বিএ-এমএ পাস করে লাভ নেই। আমি চাই কৃষি কলেজ, কৃষি স্কুল, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ও স্কুলে যাতে সত্যিকারের মানুষ পয়দা হয়। বুনিয়াদি শিক্ষা নিলে কাজ করে খেয়ে বেঁচে থাকতে পারবে’। বঙ্গবন্ধু বিশ্বাস করতেন, দেশকে ভালোবাসতে হলে দেশের মানুষকে ভালোবাসতে হবে সবার আগে। আর এই বিশ্বাসের মূলে ছিলো দেশের প্রাণশক্তি তরুণ-যুবকরা।
এ দেশের যুবদের নিয়ে বঙ্গবন্ধুর ছিলো সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের তরুণ-যুবকরা যেন বিপথে পরিচালিত না হয়, পথভ্রষ্ট না হয়, সে জন্য তিনি বারবার যুবকদের প্রতি সতর্কবার্তা দিয়েছেন। যুবদের শারীরিক, মানসিক, সাংস্কৃতিক এবং আত্মিক বিকাশের জন্য তিনি শিক্ষা কমিশন, জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ গড়ে তুলেছিলেন। ডিজিটাল প্রযুক্তির সাথে যুবরা যাতে নিজেদের উপযুক্ত করে গড়ে তুলতে পারে, নতুন যুগের সাথে তাল মিলিয়ে নিজেদের তৈরি করতে পারে, সেজন্য চট্টগ্রামের বেতবুনিয়ায় কৃত্রিম ভূ-উপগ্রহ স্থাপন করেছিলেন, যুব উন্নয়নের জন্য পৃথক প্রশাসনিক দপ্তর গঠন করেছিলেন।
বঙ্গবন্ধুর ভাবনার বিশাল অংশ জুড়ে ছিলো বাংলার যুবসমাজ। তিনি বলেছেন,‘সমস্যা ও সম্ভাবনা দুটোই দেশের যুবসমাজের ওপর নির্ভর করে। কোনো দেশের যুবসমাজ যদি কর্মঠ হয় এবং তারা কাজের জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ পায়, তাহলে এই দেশের উন্নতি কেউ আটকাইতে পারে না’।
যুবকদের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন,‘দেশে দুর্নীতি প্রতিরোধ করার দায়িত্ব শুধু মন্ত্রী বা সংসদ সদস্যদের নহে। এ ব্যাপারে যুবসমাজকে দায়িত্ব পালন করতে হবে। ১৯৭৪ সালে ৪ ফেব্রুয়ারি এক ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন,‘ওয়াদা কর, দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করবি’।
বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত দেশপ্রেমিক আদর্শ যুবসমাজ গড়তে হলে নীতি-নৈতিকতা, দায়িত্ব-কর্তব্যবোধ, মানবিক গুণাবলিসম্পন্ন শিক্ষা-শান্তি-প্রগতির চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে যুবকদের আদর্শ মানুষ হিসেবে তৈরি করতে হবে।
যুব-তরুণদের সাথে আত্মিক ও মানসিক সম্পর্ক ছিলো বঙ্গবন্ধুর। তিনি যুবকদের সংগ্রামের বাণী শুনিয়েছেন। রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, কৃষ্টি ও সক্রিয়তার কথা বলতেন। শিক্ষা ও নৈতিক শিক্ষার আদর্শগুলো নিজেদের জীবনে ধারণ করার জন্য অনুপ্রাণিত করতেন। তিনি তরুণদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে, অসত্যকে পরিহার করতে, শোষণ-বঞ্চনা, অত্যাচার-অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে অনুপ্রেরণা জোগাতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, বাঙালি যুবকরা নৈতিক ও মানবিক গুণাবলির মাধ্যমে একদিন বিশ্বকে জয় করবে। সারা বিশ্বের যুবকরা বঙ্গবন্ধুর আদর্শ, নৈতিকতা, চিন্তা-চেতনাকে ধারণ করে শোষণমুক্ত পৃথিবী গড়বে।
এ বছরের জাতীয় যুব দিবসের প্রতিপাদ্য ‘দক্ষ যুবসমৃদ্ধ দেশ, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ’। ২০৪১ সালে হবে উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা অর্জনে রাষ্ট্রের যুবদের অংশগ্রহণ ও ক্ষমতায়ন অনিবার্য। ৪র্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে ‘ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ট’-এর সুবিধা ভোগ করবে বাংলাদেশ। দেশে বয়স্ক মানুষের তুলনায় কম বয়সিদের সংখ্যা বেশি, অর্থাৎ কর্মক্ষম মানুষ অধিক।
এই ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্টের সুফল পেতে হলে ৪র্থ শিল্পবিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় যুবদের উপযুক্ত কর্মী হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। দেশের মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ যুবক। এ বিশাল যুবশক্তিকে যুবসম্পদে উন্নীত করে মানবিক চেতনায় গড়ে তোলার অপার সুযোগ বাংলাদেশের সামনে।
যুবদের ক্ষমতায়ন ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে অংশীদার করতে হবে। এখন সময় যুবদের, এখন সময় বাংলাদেশের। সেজন্য দরকার শক্তিশালী যুবসংগঠন। যুবসমাজকে প্রগতির পথে নৈতিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তরের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন সুখী-সমৃদ্ধ সোনার বাংলা নির্মাণই হোক জাতীয় যুব দিবসের অঙ্গীকার। যুবসমাজ নিয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চিন্তা ও দর্শনের মূল উৎস বঙ্গবন্ধু।
তিনি বলেছেন,‘সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলতেন— সোনার বাংলা গড়তে হলে সোনার মানুষ চাই। এই সোনার মানুষই হলো যুবসমাজ। তাই আসুন, যুবসমাজকে দক্ষ জনসম্পদে পরিণত করে জাতির পিতার স্বপ্নের সুখী-সমৃদ্ধ সোনার বাংলা এবং তারই সুযোগ্য কন্যা উন্নয়নের রোল মডেল, গণতন্ত্রের মানসকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিশ্রুত ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণে স্ব-স্ব অবস্থান হতে আমরা যথোপযুক্ত অবদান রাখি।
লেখক : উপসচিব, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়