Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪,

পুরুষ নির্যাতন রীতিমত এক ভয়ানক বাস্তবতা

ব্যারিস্টার জাহিদ রহমান

নভেম্বর ১১, ২০২১, ০৮:৪০ এএম


পুরুষ নির্যাতন রীতিমত এক ভয়ানক বাস্তবতা

বিশ্বায়নের প্রভাবে সামাজিক প্রেক্ষাপট বদলেছে। আজ সামাজিক, পারিবারিক এমনকি পেশাগত দিক দিয়েও প্রতিটি ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। সেই সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশেও আজ নারী শিক্ষা এবং নারী ক্ষমতায়ন দেশের প্রতিটি স্তরে প্রতীয়মান। শিক্ষা ক্ষেত্র হোক আর রাজনীতি, নারীদের অগ্রাধিকার সকল ক্ষেত্রে। সম্প্রতি নারী উন্নয়নের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে ব্যাপকভাবে সম্মানিত স্থান অর্জন করেছে। কমনওয়েলথ অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে কোভিড-১৯ মহামারি মোকাবিলায় নেতৃত্ব দানকারী শীর্ষ তিন নেত্রীর তালিকায় এসেছিলেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। 

ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) বৈশ্বিক লিঙ্গ বৈষম্য প্রতিবেদন ২০২০ অনুযায়ী নারী-পুরুষের সমতার প্রেক্ষাপটে দক্ষিণ এশিয়ায় সবার ওপরে বাংলাদেশ। পাশাপাশি বেশ কয়েকটি প্রতিবেদনে নারীর ক্ষমতায়ন সূচকে এগিয়ে ছিল আমাদের দেশ। দেশের প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় সাবেক প্রধান ও বর্তমান স্পিকার ও সংসদ নেত্রী এবং বেশ কিছু মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীসহ শীর্ষস্থানীয় পদগুলোও এখন নারীরা অলংকৃত করে আছেন। এসকল স্বীকৃতি আমাদের দেশের বড় অর্জন হিসেবে নিঃসন্দেহে বিবেচিত হবার মত। যা কিনা বর্তমানে নারী উন্নয়নে আরও ভূমিকা রাখছে এবং উৎসাহ জুগিয়ে যাচ্ছে।

কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, বদলে যাওয়া সমাজেরই নতুন ব্যধি হয়ে দাঁড়িয়েছে “পুরুষ নির্যাতন”। তুলনামূলক কম হলেও নির্যাতিত পুরুষের সংখ্যা আমাদের দেশে নেহায়েত কম নয়। মানবাধিকার নিয়ে কাজ করে এমন বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থার কাছে এদেশের নারী নির্যাতনের পরিসংখ্যান থাকলেও নেই পুরুষ নির্যাতনের সঠিক তথ্য। ফলে নারী নির্যাতনের খবর মিডিয়া কভারেজ পেলেও অন্ধকারেই থেকে যায় পুরুষ নির্যাতনের ঘটনাগুলো। তবে বর্তমানে পুরুষ নির্যাতনকে কেন্দ্র করে বেশকিছু সংগঠন গড়ে উঠছে। 

পুরুষ নির্যাতনের বিষয়টি নতুন ও অনেকের কাছে হাস্য রসিকতার বিষয় মনে হলেও এটা এখন রীতিমত এক ভয়ানক বাস্তবতার নাম। বাংলাদেশে নারী নির্যাতনের পাশাপাশি পুরুষরা ব্যাপকভাবে প্রতিনিয়ত নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির পুরুষ আজ কোন না কোন নারী দ্বারা নির্যাতন নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। শারীরিক, মানসিক, আর্থিক, সামাজিকসহ স্ত্রী কর্তৃক ও শ্বশুর বাড়ির শোষণের স্বীকার হচ্ছে পুরুষ। পুরুষ কর্তৃক নারী নির্যাতনের ঘটনা পত্র-পত্রিকায় ব্যাপকভাবে প্রচারিত হলেও নারী কর্তৃক পুরুষ নির্যাতনের ঘটনা তেমনটি চোখে পড়ে না। কেননা বেশিরভাগ পুরুষই সামাজিক সম্মান হারানোর ভয়ে ও পরিবার, আত্মীয় ও বন্ধুমহলে লজ্জার কারণে এই নির্যাতনের কথা স্বীকার করেন না বা প্রকাশ্যে কথা বলতে অস্বীকৃতি জানান। ফলে পুরুষ নির্যাতনের বিষয়টি চেপে যাওয়া আর নারী নির্যাতনের সংখ্যা প্রকাশ পাওয়ায় নারী নির্যাতনের হার ব্যাপক বলে মনে হয়।

একসময় নারীকে অবহেলিত মনে করা হলেও বর্তমানে নারী ও শিশু নির্যাতনের বিরুদ্ধে এতগুলো ট্রাইব্যুনাল থাকলেও পুরুষদের জন্য একটিও নেই। ফলে নির্যাতিত পুরুষরা যথাযথ আইনি সহায়তা পাচ্ছেন না। সংবিধানের ২৭, ২৮ ও ২৯ নং অনুচ্ছেদে নারীর অধিকারের কথা উল্লেখিত রয়েছে এবং অন্যদিকে নারীর সুরক্ষার জন্য একাধিক আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। যৌতুক নিরোধ আইন-১৯৮০, নারী ও শিশু নির্যাতন আইন-২০০০, এসিড নিরোধ আইন-২০০২, পারিবারিক সহিংসতা ও দমন আইন-২০১০ এদের মধ্যে অন্যতম। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, নারীর নিরাপত্তার নিশ্চিত করণের উদ্দেশ্যে আইনগুলো তৈরি হলেও বর্তমানে এই আইনগুলোকে বেশিরভাগ নারীকে “পুরুষ দমনের হাতিয়ার” হিসেবে ব্যবহার করতে দেখা যাচ্ছে। 

সাবেক আইনমন্ত্রী গণমাধ্যমের সামনে দেশের ৮০ শতাংশ নারী নির্যাতন মামলা ভুয়া ও মিথ্যা বলে মন্তব্য করেছিলেন। ৮০ শতাংশ মামলা যৌতুক, ধর্ষণ ও যৌন পীড়নের অভিযোগে দায়ের করা হলেও এর আড়ালে রয়েছে অন্য ধরনের বিরোধ। তাই এসব মামলা আপসে নিষ্পত্তির জন্য আদালত থেকে সরিয়ে সুপ্রিম কোর্টের লিগ্যাল এইডের কাছে পাঠানোর সুপারিশ করেছিলেন বিচারকগণ। একটি দেশের আইনমন্ত্রী বা বিচারক দ্বারা গণমাধ্যমে প্রকাশিত এসব মন্তব্য অবশ্যই গ্রহণযোগ্য এবং গুরুত্ববহন করে। তাহলে কি দেশের ৮০ ভাগ মিথ্যা মামলার ভুক্তভোগী এবং তাদের পরিবারের সামাজিক, আর্থিক এবং শারীরিক নির্যাতনের দায় আমরা এড়িয়ে যাচ্ছি? অথচ এই মিথ্যা মামলার শিকার যদি পরিবারের একমাত্র কর্মক্ষম পুরুষটি হয়, তবে তার কারাভোগ অথবা হয়রানির ফলে পরিবারে তার অনুপস্থিতি কতটা কঠিন পরিস্থিতি ও সামাজিক অনিরাপত্তার কারণ হতে পারে তা অত্যন্ত সুগভীরভাবে অনুমেয়।

একজন নারী শারীরিক নির্যাতনের শিকার হলে কথিত নারীবাদীদের আওয়াজে গণমাধ্যমে টর্নেডো শুরু হয়ে গেলেও নারী বা স্ত্রী কর্তৃক পুরুষ বা ঘুমন্ত স্বামীর লিঙ্গ কর্তনের মতো ভয়াবহ শারীরিক নির্যাতনে তাদের নীরব থাকতে দেখা যায়, আর গণমাধ্যমকে হাস্যকর শিরোনামে খবর প্রকাশ করে এড়িয়ে যেতে দেখা যায়। আমাদের দেশে যৌতুক নিরোধ আইন আছে, কিন্তু অযৌক্তিক দেনমোহর আদায়ের বিপক্ষে কোনও আইন না থাকায়, একাধিক বিয়ে করে দেনমোহর ব্যবসা হিসেবে নিচ্ছে কিছু অসৎ নারী। ফলে যথাযথ আইনী ধারার অভাবে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থাও গ্রহণ করা যায় না।

বর্তমানে ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রভাব ও পারিবারিক শিক্ষার অভাবে বেশির ভাগ নারী বিয়েকে 'দাসত্ব' মনে করছেন। ফলে তৃতীয়পক্ষের ইন্ধনে স্বামীর পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে বাজে ব্যবহার করা, অতিমাত্রায় চাহিদা উপস্থাপন করে আর্থিক চাপ প্রয়োগ, একাধিক ছেলে বন্ধুর সঙ্গে ফোনালাপ ও সময় কাটানো, পরকীয়া, সন্তানকে অবহেলা করার মতো ঘটনাগুলো ঘটিয়ে স্ত্রীরা নির্যাতন করছেন পুরুষদের। কোন কোন ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, প্রবাস থেকে পাঠানো স্বামীর টাকা অর্থ-সম্পদ আত্মসাৎ করে পরকীয়া প্রেমিকের সাথে পালিয়ে যাচ্ছে। অবৈধ সম্পর্কের প্ররোচনায় স্বামীকে ডিভোর্স দিচ্ছে।

সাম্প্রতিক সময়ে যেভাবে সমাজে নারী ও শিশু আইনের অপব্যবহার করে জেল খাটানোর ভয় দেখিয়ে পুরুষ নির্যাতন করার পাশাপাশি স্ত্রী কর্তৃক স্বামীকে ডিভোর্স প্রদানের হার বৃদ্ধি পাচ্ছে তা সত্যিই উদ্বেগজনক। সাম্প্রতিক সময় দেখা গেছে পারিবারিক বিরোধ হলেও একটি ছেলেকে স্কুল বা কলেজের সামনে ডেকে নিয়ে মিথ্যা ইভটিজিং মামলায় ফাঁসানো হচ্ছে। এমনও নজির আছে মুরগি নিয়ে ঝগড়া শুরু হওয়ায় শেষ পর্যন্ত জিততে না পেরে ধর্ষণ বা নারী নির্যাতন মামলা করে দিয়েছে। সম্প্রতি ফেসবুকে এক পুলিশ কর্মকর্তা তার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন। যেখানে একজন নারী এক মোবাইল বিক্রেতার বিরুদ্ধে থানায় গিয়ে ধর্ষণের অভিযোগ করেন। যদিও প্রকৃত ঘটনা ছিল পছন্দসই মোবাইল ফোন পরিবর্তন করতে না পারার আক্রোশ থেকেই এই মিথ্যা অভিযোগ। পরবর্তিতে ওই নারী পুলিশের জেরার মুখে তা স্বীকারও করেন।

একজন নারী ইচ্ছে করলেই মিথ্যা ঘটনা সাজিয়ে থানা কিংবা আদালতে মামলা দায়ের করতে পারে। এছাড়া বর্তমান সময়ে একটি পরিবারকে ধ্বংস করতেও বিভিন্ন স্থানে নারী নির্যাতন মামলাকে বেছে নেওয়া হচ্ছে। কারণ মামলাটি সহজেই দায়ের করা যাচ্ছে এবং মামলাটি সাধারণত জামিন অযোগ্য। কিন্তু একজন পুরুষ, মেয়ে/নারীদের কাছে নির্যাতন বা প্রতারণার শিকার হয়ে কোনভাবে আইনের আশ্রয় নিতে পারছেন না বা অনেক ক্ষেত্রে নিয়েও প্রতিকার পাচ্ছে না। সাম্প্রতিককালে দেশের নানা প্রান্ত থেকে স্ত্রীর অত্যাচারে বেশ কয়েকজন স্বামীর আত্মহত্যার খবর গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে। চট্টগ্রামের একজন তরুণ ডাক্তার এবং ঢাকার মিরপুরে একজন পুলিশ কর্মকর্তার আত্মহত্যার পথ বেছে নেওয়া তারই উদাহরণ।

এর মধ্যে নতুন যোগ হয়েছে 'বিয়ের প্রলোভন' দেখিয়ে ধর্ষণ পুরুষ নির্যাতনের নতুন সুযোগ। প্রেমের সম্পর্ক ভেঙে গেলে অথবা কিছুক্ষেত্রে অর্থের বিনিময়ে স্বেচ্ছায় সম্মতিতে যৌন সম্পর্কে জড়ানোর পরেও অনেক নারী ইদানীং এই মামলা করে থাকেন। সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় বর্তমানে এমন পর্যায়ে নেমে গেছে যে, নারী-পুরুষের স্ব-স্বীকৃত এই সামাজিক অপরাধকে উভয়ের অপরাধ না দেখে নারীর পক্ষ নেয়া হচ্ছে। আর একচেটিয়া দোষী সাব্যস্ত করা হচ্ছে পুরুষদের।

বাংলাদেশে সবার জন্য আইনি ধারা আছে। নারীদের জন্য, শিশুদের জন্য, তৃতীয় লিঙ্গের জন্য। এমনকি পশু অধিকার রক্ষার জন্য। কিন্তু পুরুষদের অধিকার বা নির্যাতন বিরোধী জন্য কোন আইনি ধারা নেই। যেহেতু যুগের সাথে তাল মিলিয়ে নারীরা এগিয়ে যাচ্ছে, তাহলে এ অবস্থায় এগিয়ে যাওয়া নারীদের জন্য বিশেষ আইন প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা থাকলে পুরুষদের জন্য বিশেষ আইন প্রণয়ন করতে বাধা কোথায়? নারী নির্যাতনের মতো পুরুষ নির্যাতন আইন প্রণয়ন করে নারী-পুরুষদের মধ্যে সত্যিকারের বৈষম্যতা দূর করতে আরও সচেষ্ট হতে হবে।

লেখক: ব্যারিস্টার জাহিদ রহমান। 

আমারসংবাদ/এমএস