Amar Sangbad
ঢাকা বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪,

বিদায় ‘ভাইছা’ 

মোহাম্মদ শাহাদাত হোসেন 

ডিসেম্বর ২৮, ২০২১, ০১:৫০ পিএম


বিদায় ‘ভাইছা’ 

কিশোরবেলা থেকেই তার নাম শুনে আসছিলাম। কারো কাছে তিনি ছিলেন আতংকের, ভক্ত- অনুসারীদের কাছে তিনি ছিলেন ‘মুকুটহীন সম্রাট’। পেশাগত সম্পর্কের সূত্র ধরে তার সঙ্গে একসময়ে ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠা। ‘ভাইছা’ বললেই সবাই যাকে এক নামে চিনতেন। তিনি দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের বহুল আলোচিত চরিত্র জয়নাল আবদীন হাজারী। ফেনী আর ভাইছা তথা হাজারী একসময়ে ছিল এপিঠ-ওপিঠ। ফেনীর বাইরে কোথাও গেলেই এ জেলার মানুষদের কাছে অন্যরা প্রথমেই জানতে চাইতেন হাজারী প্রসঙ্গ।

স্বাধীনতা পরবর্তী অন্তত তিন দশক জেলার রাজনীতি তিনি দাপটের সাথে নিয়ন্ত্রন করেছেন। হাজারীকে বাদ দিয়ে সেইসময় ফেনী আওয়ামীলীগের রাজনীতি কল্পনাও করা যেতো না। অবশ্য ২০০১ সালে যৌথ বাহিনীর অভিযানের মুখে দেশান্তরী হলেও হাজারীকে ছাড়েননি আওয়ামীলীগ। ওই বছর জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ফেনী-২ আসনে চতুর্থবারের মতো তাকেই নৌকার মনোনয়ন দেয়া হয়েছিল। শুধু তাই নয়, আওয়ামীলীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা ট্রাংক রোডের জনসভায় বলেছিলেন- ‘হাজারীর দায়িত্ব আমি নিলাম’। ২০০৬ সালে স্থগিত হওয়া জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তার অনুপস্থিতিতে ছোট বোন খোদেজা হাজারীকেই নৌকার প্রার্থী দেয়া হয়। ২০০৮ সালের নির্বাচনে দেশে না থেকেও ভারতে বসে ভোটের মাঠের কলকাঠি নাড়েন তিনি। ২০০৯ সালে আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় আসার পর তিনি ২৭ মামলা ও ৬৪ বছরের সাজা মাথায় নিয়ে দেশে ফিরেন। কিছুদিন কারাবরনের পর সব মামলায় খালাস পেলেও ততক্ষণে ফেনীর রাজনীতি তার হাতছাড়া হয়ে যায়। একসময়ের তার অনুসারীদের দাপটে তিনি ফেনী ছেড়ে রাজধানী উঠেন। সেখানে থেকে হাজারীকা প্রতিদিন পত্রিকা সম্পাদনা করেন। ২০১৯ সালে দলের উপদেষ্টা পরিষদে ঠাঁই দিয়ে সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে মূল্যায়ন করলেও প্রতাপ ফিরে পাননি নিজ জেলায়। ফলে আর জৌলুস ফিরে পায়নি মাষ্টারপাড়ার শৈলকুটির।

ছাত্রজীবন থেকেই আলোচিত ছিলেন হাজারী। সবসময় আলোচনা-সমালোচনায় থাকতে ভালোবাসতেন। তার সম্পাদিত সাপ্তাহিক হাজারীকার নামকরণ সম্পর্কে একবার জানতে চেয়েছিলাম- পত্রিকার নাম নিজের নামে কেন রাখলেন? তিনি অকপটে বললেন- আমার খবর জানাতে। আমার খবর জানতে মানুষের বেশ আগ্রহ রয়েছে। তাই পত্রিকার নাম দিয়েছি হাজারীকা। অবশ্য পরে রাজধানী থেকে প্রকাশিত দৈনিক পত্রিকাটির নামও দিলেন হাজারীকা প্রতিদিন।

গণমাধ্যমে তাকে নিয়ে বেশি আলোচনা হয়েছে ১৯৯৬ থেকে ২০০১ পর্যন্ত আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় থাকাকালে। ওইসময়ে তিনি ‘স্ট্রিয়ারিং বাহিনী’ পরবর্তীতে ‘ক্লাস কমিটি’ নামে একটি প্রাইভেট বাহিনী গঠন করেছিলেন। ইউনিয়ন থেকে জেলা পর্যায়ে ওই বাহিনীর অত্যাচার-নির্যাতন তখন দেশ-বিদেশে আলোচনার ঝড় উঠে। এসময়ে তিনি গণমাধ্যমে ‘গডফাদার’ নামে সমালোচিত হন। তখন ফেনীকে বলা হতো-‘সন্ত্রাস-সহিংসতার ভয়াল জনপদ’, ‘রক্তাক্ত জনপদ’।

[media type="image" fid="154826" layout="normal" caption="1" infograph="0" parallax="0" popup="1"][/media]

ফেনীর নির্মাণাধীন আদালত ভবনে দফায় দফায় অগ্নিসংযোগ, চর ইঞ্জিমানে গণহত্যা, পূর্বচন্দ্রপুরে ট্রিপল মার্ডার, ফেনীতে মিছিলে ব্রাশফায়ার করে যুবদল নেতা নাছিরকে হত্যা, ড্রিল মেশিন দিয়ে ছাত্রদল নেতাকে নির্যাতন, গাছে বেঁধে কুকুর লেলিয়ে দেয়া, সাংবাদিক টিপু সুলতানের হাত-পা গুড়িয়ে দেয়া, ওমরপুরে সুলতানা মেমোরিয়াল স্কুলে অগ্নিসংযোগ, সাপ্তাহিক ফেনী বার্তা অফিসে দফায় দফায় হামলা, ফেনী সংবাদের প্রকাশনা উৎসবে বোমা হামলা, সাংবাদিক রফিককে ফেনী সরকারি কলেজ হোস্টেলে নির্মম নির্যাতন, লালপোলে উম্মে হানি নামে এক কিশোরীর উপর বর্বরতা সহ নানা ঘটনার পেছনে জয়নাল হাজারীর প্রাইভেট বাহিনীকে দোষারোপ করা হতো। তাকে নিয়ে জাতীয় সংসদেও বিভিন্নসময় তুমুল বিতর্ক উঠে।

‘বিজুর বিচার চাই’, ‘বাঁধনের বিচার চাই’, ‘জয়নাল হাজারী বলছি’ তার রচিত গ্রন্থসমূহকে ঘিরেও আলোচনা-সমালোচনা কম হয়নি। ২০০১ সালে যৌথবাহিনীর অভিযানে দেশান্তরী হওয়ার পেছনে তার প্রাইভেট বাহিনীর অপকর্মকেই দায়ী করা হয়।

অবশ্য এরশাদ আমলেও সরকার বিরোধী আন্দোলনে তিনি একাধিকবার কারাবরণ করেন। ওইসময়ে সরকার দলীয় টাইগার বাহিনীর সঙ্গে হাজারী বাহিনীর সংঘর্ষে প্রাণহানী সহ এ জনপদের বহু ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর প্রতিবাদ করতে গিয়ে নারায়নগঞ্জ থেকে গ্রেফতার হন জয়নাল হাজারী। ওই ঘটনায় তিনি বেশ কয়েকবছর কারাভোগ করেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ভারতের ত্রিপুরা থেকে ‘বুলেট’ পত্রিকার সম্পাদনা করে ফেনীতে পাঠাতেন মুক্তিযুদ্ধের এ সংগঠক। এছাড়া স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময়ে শতাব্দি, প্রবাহ নামে বেশ কয়েকটি সাময়িকীও তিনি প্রকাশনা করতেন। জয়নাল হাজারী একসময়ে দৈনিক বাংলার বাণী পত্রিকার ফেনী সংবাদদাতা ছিলেন। বক্তৃতা ও আবৃত্তিতে তিনি ছিলেন পারদর্শী।

ফেনীর ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে তার সরব বিচরণ ছিল। তার শৈলকুটির প্রাঙ্গন ‘মুজিব উদ্যানে’ প্রতিবছর বৈশাখী মেলার আয়োজন করতেন। এখানে ব্যাডমিন্টন প্রতিযোগিতা হতো প্রতিবছর। বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদানের জন্য ফেনীর কৃতি সন্তানদের সংবর্ধণা প্রদান করা হতো। ২০১০ সালে আমাকেও সাংবাদিকতার জন্য পূবালী পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে ফেনীর আলোকিত সন্তান অলিম্পিক এসোসিয়েশনের তৎকালীন চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) আমিন আহম্মদ চৌধুরী প্রধান অতিথি ছিলেন।

২০০৯ সালে দেশে ফেরার আগে ভারত থেকে তিনি প্রায় আমার সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করতেন। বিশেষ করে দৈনিক ফেনীর সময় প্রকাশনার আগে-পরে সময়গুলোতে তিনি বেশ খোঁজখবর রাখতেন। দেশে ফিরলে তাকে সহযোগিতার অনুরোধ জানান। কারামুক্তির পর ফেনী থাকাকালীন সময়ে তিনি প্রায়ই ফোন করে ডেকে নিতেন। আমার আরেক সহকর্মী আসাদুজ্জামান দারা আর আমি তার সঙ্গে নানা খুনসুটিতে মেতে থাকতাম। সমকালীন রাজনীতি, সাংবাদিকতা ছিল আমাদের আলাপচারিতার বিষয়। ওইসময়কালের নানা কথা নানা স্মৃতি আজীবন মনে থাকবে। ফেনী ছাড়ার পর তার রাজধানীর বাসাতেও একবার আমার যাওয়া হয়েছিল। তখন আমি ফোকাস বাংলায় কাজ করতাম। আলোচিত এ রাজনীতিকের সাক্ষাতকার নেয়ার জন্য অফিস থেকে যোগাযোগ করতে না পেরে আমাকে কাজটি দেয়া হয়। পরে সহকর্মী জাহিদুর রহমান সহ তার বাসায় একটি দীর্ঘ সাক্ষাতকার নিই। এটির অংশবিশেষ দৈনিক ফেনীর সময় এ ও ছাপা হয়েছিল। বর্ষিয়ান এ রাজনীতিকের উত্থান-পতনের ইতিহাস শুধু ফেনী কেন, দেশের সচেতনমহলেও জানাশোনা রয়েছে। প্রকৃতির নিয়ম মেনে জয়নাল হাজারী চলে গেলেও রাজনীতিক কর্মীদের জন্য এক শিক্ষনীয় ইতিহাস হয়ে থাকবেন তিনি। এই কিংবদন্তীর সঙ্গে নানা টুকরো স্মৃতি বিদায় বেলায় অনেকের মতো আমাকেও অশ্রম্নসিক্ত করছে। অনেক কথা মনে আসলেও এ মুহুর্তে ঘুচিয়ে লিখার ভাষা নেই। চিরবিদায়কালে তার আত্মার মাগফিরাত কামনা করি। পরম করুণাময় ভুলত্রুটি ক্ষমা করে তার ভালো কাজগুলোর উত্তম বিনিময় দিন।

[media type="image" fid="154825" layout="normal" caption="1" infograph="0" parallax="0" popup="1"][/media]

লেখক:- মোহাম্মদ শাহাদাত হোসেন, সম্পাদক ও প্রকাশক, দৈনিক ফেনীর সময়

আমারসংবাদ/জেআই