Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ১১ মে, ২০২৪,

বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ: সমান্তরালে ধ্বনিত প্রতিচ্ছবি

শিবু দাশ সুমিত

জানুয়ারি ১৮, ২০২২, ১২:১৫ পিএম


বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ: সমান্তরালে ধ্বনিত প্রতিচ্ছবি

যেখানেই যাও তুমি
এই বাংলার আকাশ, নিসর্গ প্রকৃতি
কুলকুল শব্দে বয়ে চলা জলের ধারা
বাংলার প্রতিটি অর্জন 
বাংলার প্রতিটি গৌরব 
শেখ মুজিবের কথা বলে 
এখানে শেখ মুজিব চির অম্লান, সদা জাগ্রত।

১৭৫৭ সালের ২৩শে জুন পলাশীর ভাগীরতী নদীর আম্রকাননে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাবের পতন হবার সাথে সাথে স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হওয়ার পর দীর্ঘ ১৯০ বছর ধরে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণ ও নির্যাতন চলতে থাকে এই অঞ্চলের মানুষের উপর। ১৯৪৭ সালে ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষ মুক্তি পেলেও পূর্ব বাংলার মানুষের উপর নেমে আসে আরেক বিপর্যয়। ধর্মের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত জিন্নাহর ভ্রান্ত দ্বিজাতি তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে ভারত থেকে আলাদা হয়ে পাকিস্তান নামের একটি অসম রাষ্ট্রের জন্ম হয়! এর মধ্য দিয়ে শুরু থেকে বাঙালির জীবনে আবারও নেমে আসে শোষণ, অত্যাচার, নির্যাতনের খড়গ।

ব্রিটিশ শাসনের হাত থেকে স্বাধীন হলেও এই ভূখণ্ডের বাঙালি আবার পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। তবে থেমে থাকেনি বাঙালি জাতি।বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নামক এক কালপুরুষের হাত ধরে বাঙালি জাতি সংগ্রামের পথ বেছে নেয়। তার দেখানো পথে ধীরে ধীরে বিজয়ের অগ্রপানে ধাবিত হতে থাকে এ জাতি। অবশেষে ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর অর্জিত হয় লাল সবুজের বাংলাদেশ। স্বাধীন ও  সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার অগ্রনায়ক হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২৪ বছরের অনৈতিক শাসন-শোষণের হাত থেকে শৃংখলিত একটি জাতিকে পৃথক জাতিসত্তার পরিচয় এনে দিয়েছেন যাকে আমরা বাঙালি নামে অভিহিত করছি। এর আগে অনেকেই এই অঞ্চলে বাঙালি জাতিসত্তার পরিচয় অর্জন করার জন্য সংগ্রাম করলেও টুঙ্গিপাড়ার সেই ছেলেটিই আমাদের সেটি এনে দেন। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একটি নাম, একটি চেতনা, একটি অধ্যায়। বাংলার আকাশে তিনি ধ্রুবতারার মতো অমর-অক্ষয় হয়ে আজও উদ্ভাসিত হয়ে আছেন। যতদিন বাংলাদেশ আছে ততদিন বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের ইতিহাস সমান্তরালে ধ্বনিত হবে। কারণ বাংলাদেশের ইতিহাস বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামের ইতিহাস, বঙ্গবন্ধুকে ছাড়া এ যেন এক অসম্পূর্ণ বাংলাদেশ। যার বেড়ে ওঠার তথা সংগ্রামের প্রতিটি দিনলিপির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ইতিহাস।

“বঙ্গবন্ধুর জন্ম না হলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না: মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা” 

তিনি যদি এই ভূখণ্ডে জন্ম না নিতেন তবে হয়তো আমাদের স্বাধীনতা ও মুক্তি আসতো না। মহান এই নেতা শৃংখলিত এক জাতিকে মুক্ত করতে ডাক দিয়েছিলেন স্বাধীনতা ও মুক্তির। তার সেই ডাকে সাড়া দিয়ে বাঙালি জাতি বীরের মতো আধুনিক সমরাস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করে স্বাধীন ভূখণ্ড অর্জন করে বিশ্ব মানচিত্রে সার্বভৌম দেশ হিসেবে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত করেছে। এটি অনস্বীকার্য যে, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, চুয়ান্নর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ছাপান্নর শাসনতন্ত্র আন্দোলন, আটান্নর সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলন, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৫ এর রাষ্ট্রপতি নির্বাচন, ৬৬ এর ছয় দফা, ৬৮ এর আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, ৭০ এর নির্বাচন থেকে শুরু করে একাত্তরের স্বাধীনতা সংগ্রাম শুধু বাঙালির নয়, সমগ্র মানবজাতির ইতিহাসেই এক অবিনাশী গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। আর এই অধ্যায়ের মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। 

এই সারসত্যকে কখনো চেপে রাখা যায়নি, 
যাবেও না ভাবীকালে। 
এ যেন রবির কিরণ! 
তোমার আগমনে হেসেছিলো ধরা
মুক্তির আনন্দে মেতেছিলো বাঙালি।

১৯২০ সালের ১৭ মার্চ তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের বৃহত্তর ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার (বর্তমান গোপালগঞ্জ জেলার) টুঙ্গিপাড়া গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে এক ধ্রবতারার আবির্ভাব ঘটে যিনি পরবর্তীতে হয়ে উঠেন বাঙালি জাতির জনক, বাঙালির মুক্তির দূত। 

পিতা শেখ লুৎফর রহমান ও মাতা মোসাম্মৎ সাহারা খাতুনের চার কন্যা ও দুই পুত্রের মধ্যে তৃতীয় সন্তান শেখ মুজিব। বাবা-মা আদর করে তাকে ডাকতেন খোকা নামে। পাড়া প্রতিবেশী ডাকতেন মিয়া ভাই নামে। শৈশবের পুরো সময়টাই তার কাটে টুঙ্গিপাড়ায়। এজন্যই হয়তো এদেশের মাটি-মানুষের প্রতি তার চিরায়ত মায়া ও ভালোবাসা। 

আরম্ভণঃ

৭ বছর বয়সে গিমাডাঙ্গা প্রাইমারি স্কুলে পড়াশোনা শুরু করেন। নয় বছর বয়সে এসে ভর্তি হন গোপালগঞ্জ পাবলিক স্কুলে। মাঝে বেরিবেরি রোগে আক্রান্ত হলে কিছুদিন পড়াশোনা বন্ধ ছিল। গোপালগঞ্জ মিশনারি স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাসের পর ১৯৪৭ সালে তিনি কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ থেকে বিএ ডিগ্রি লাভ করেন। তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হন। চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের দাবি-দাওয়া নিয়ে রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ১৯৪৮ সালে তাকে বহিষ্কার করে। তার সাথে বহিষ্কৃত অন্যান্যরা বহিষ্কারাদেশ তুলে নেয়ার জন্য কর্তৃপক্ষের কাছে ক্ষমা চাইলেও বঙ্গবন্ধু ছিলেন নীতিতে অটল। কারণ তিনি জানতেন তার আন্দোলন যৌক্তিক ছিল। একই বছরে তিনি জেলেও গিয়েছিলেন দুবার। কারাগারে প্রথমবারের অভিজ্ঞতা তাকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা এবং জনগণের অভিভাবক হিসাবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছিল।

সংগ্রামের দিনলিপিঃ

অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে ছিলে সদা তৎপর 
করেছিলে সংগ্রাম পুরো জীবনভর।

 ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার সময় শেখ মুজিব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। দলে তিনি যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। তার জীবনের প্রত্যেকটা দিনই ছিলো সংগ্রামমুখর। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ বাংলা ভাষার দাবিতে ভুখা মিছিল করার সময় তাকে গ্রেফতার করা হয়। ১৯৫২ সালে যখন বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলন তীব্র থেকে আরো তীব্র হচ্ছিলো তখন তিনি জেলে গ্রেফতার থাকা অবস্থায় ছাত্রসমাজের জন্য গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা প্রদান করে গেছেন। 

যখন বঙ্গবন্ধু জানতে পারেন খাজা নাজিমুদ্দিন ঘোষণা করেছেন ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু’ তখনই তিনি এর প্রতিবাদ জানিয়ে ২১ ফেব্রুয়ারিকে রাজবন্দি মুক্তি এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি দিবস হিসেবে পালন করার জন্য রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের প্রতি আহ্বান জানান। ১৪ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু ও মহিউদ্দিন আহমেদ এ দাবিতে জেলখানায় অনশন শুরু করেন। ২১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ছাত্র সমাজ ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল বের করে এবং মিছিলে পুলিশ গুলি চালালে সালাম,জব্বার, বরকত, রফিক, শফিউর রহমান শহীদ হন। এ ঘটনায় বঙ্গবন্ধু তীব্র নিন্দা জানান যার প্রতিবাদে একটানা ১৭ দিন অনশন অব্যাহত রাখেন। জেলখানা থেকে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার দায়ে তাকে ঢাকা জেলখানা থেকে ফরিদপুর জেলে সরিয়ে নেওয়া হয়। ২৬ ফেব্রুয়ারি ফরিদপুর জেল থেকে তিনি মুক্তিলাভ করেন। 

জনসাধারণের সাথে তার সম্পৃক্ততা, সাধারণ মানুষের কাছে তার গ্রহণযোগ্যতা খুব শীঘ্রই তাকে গণমানুষের অভিভাবকে পরিণত করে। যার ফলশ্রুতিতে ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু গোপালগঞ্জ আসনে মুসলিম লীগের প্রভাবশালী নেতা ওয়াহিদুজ্জামানকে ১০ হাজার ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করেন এবং যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভায় সর্বকনিষ্ঠ সদস্য হিসেবে কৃষি ও বন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান। 

নির্বাচিত যুক্তফ্রন্ট সরকারকে সংবিধানের ৯২-ক ধারার অধীনে বরখাস্ত করে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার। করাচি থেকে ফেরার পথে শেখ মুজিবকে ঢাকা বিমানবন্দরে গ্রেফতার করা হয়। ওই বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত তিনি জেলে ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি ১৯৫৫ সালে আবারও পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। এই সময়গুলোতে পূর্ব বাংলার নাম পরিবর্তন করে পূর্ব পাকিস্তান রাখার জন্য পাকিস্তান সরকারের প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে তিনি অত্যন্ত সোচ্চার ছিলেন। এই ইস্যুতে গণভোট আয়োজনের দাবি তোলেন তিনি। এদিকে অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে সামনে রেখে তার দল আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি সরিয়ে শুধু আওয়ামী লীগ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। তারপর ১৯৫৬ সালে আতাউর রহমান খানের প্রাদেশিক সরকারের মন্ত্রিও ছিলেন শেখ মুজিব। তবে দলকে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী করতে তিনি সবাইকে অবাক করে দিয়ে মন্ত্রির পদ থেকে সরে দাঁড়ান। মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দিয়ে দলের জন্য নিজেকে নিবেদিত করার মতো এমন ঘটনার নজির ইতিহাসে বিরল।

১৯৫৮ সালের সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলনেও বঙ্গবন্ধু সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন যা পরবর্তী দিনগুলোতে তাকে সাধারণ মানুষের আরো কাছাকাছি নিয়ে আসে। ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলনে জান্তা সরকারের ভিত নাড়িয়ে দেয় পূর্ব বাংলার ছাত্রসমাজ। সময় যতই গড়াচ্ছিল ততই শেখ মুজিবুর রহমান হয়ে উঠছিলেন বাঙালির অন্যতম আশা ভরসার প্রতীক। 

স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতার পথেঃ

“ছয় দফা বাঙ্গালির স্বাধীনতার সনদ”

বাঙ্গালির মুক্তির সনদ ছয় দফাকে ঐতিহাসিকগণ ম্যাগনাকার্টা এবং বিল অব রাইটসের সাথে তুলনা করে থাকেন। ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক ঘোষিত ৬ দফা কেবল কতিপয় দাবিনামা ছিল না এটি ছিল সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালিদের বাঁচার দাবি। ভারতবর্ষ ভাগ হবার পর থেকেই পূর্ব বাংলার মানুষ দীর্ঘ সময় ধরে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক ও প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে বাঙালির সীমাহীন বঞ্চনার স্বীকার হয়ে আসছিলো। যার পরিপ্রেক্ষিতে নিজেদের ন্যায্য অধিকার ও অস্তিত্ব রক্ষার জন্য বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা দাবি উত্থাপন ছিলো তৎকালীন সময়ের সেরা সিদ্ধান্ত। 

বাঙালি সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও দীর্ঘ ১৮ বছরে (১৯৪৭-১৯৬৫) প্রদেশ বা কেন্দ্রে রাজনৈতিক অধিকার ভোগ করতে পারেনি। প্রশাসনে বাঙালিদের তেমন একটা নিয়োগ দেয়া হতো না। পূর্ব বাংলা থেকে বৈদেশিক বাণিজ্যের প্রায় ৬০ শতাংশের বেশি পরিচালিত হতো। যার অধিকাংশ অর্থই ব্যয় হতো পশ্চিমাঞ্চলের উন্নয়নের জন্য। এর সাথে যুক্ত হয় পূর্ব পাকিস্তানের নিরাপত্তাহীনতা। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের নিরাপত্তা ব্যাপক হুমকির সম্মুখীন হয়। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে আর বৈদেশিক ঋণের বোঝা ছিল পূর্ব পাকিস্তানের। নানা অযৌক্তিক অজুহাতে সেনাবাহিনীতে বাঙালিদের নেয়া হতো না। এসব কিছুই ছিল ঐতিহাসিক সত্য, তাই পাকিস্তানি শাসকরা প্রচারণা, মিথ্যা তথ্য আর ভয়ভীতি দেখিয়ে ছয় দফার আন্দোলন দমন করতে পারেনি। ৬ দফা ঘোষণার পর তা বাঙ্গালির প্রাণের দাবিতে পরিণত হয়। বঙ্গবন্ধু প্রায়ই বলতেন ‘‘সাঁকো দিলাম, স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতায় উন্নীত হবার জন্য।’’ 

জানা যায়, ৬ দফার সমর্থনে বঙ্গবন্ধু সারাদেশে ৩৫ দিনে ৩২টি জনসভায় বক্তৃতা করেন। ১৯৬৬ সালের ৫-৬ ফেব্রুয়ারি লাহোরে বিরোধী দলের একটি সম্মেলনে শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও প্রতিরক্ষার দাবি সম্বলিত এই কর্মসূচী ঘোষণা করেন। দাবি ছিল মূলত ছয়টি। একটু বিশ্লেষণ করা যাকঃ

দফা-১: শাসনতান্ত্রিক কাঠামো ও রাষ্ট্রীয় প্রকৃতি এতে সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা ও প্রদেশের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের কথা বলা হচ্ছে।

দফা-২: কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা শুধুমাত্র দেশরক্ষা ও বৈদেশিক নীতি বাদে অন্য সকল ক্ষেত্রে প্রদেশগুলোর একচ্ছত্র ক্ষমতা থাকবে। 

দফা-৩: মুদ্রা ও অর্থবিষয়ক ক্ষমতা সমগ্র দেশের জন্য দুটি পৃথক অথচ সহজে বিনিময়যোগ্য মুদ্রা থাকবে।

দফা-৪: রাজস্ব, কর ও শুল্কবিষয়ক ক্ষমতা কর ধার্যের ক্ষমতা থাকবে কেবল প্রদেশগুলোর।

দফা-৫: বৈদেশিক বাণিজ্য বিষয়ক ক্ষমতা বৈদেশিক মুদ্রা ও বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে প্রদেশগুলোর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকবে।

দফা-৬: আঞ্চলিক বাহিনী গঠনের ক্ষমতা প্রদেশগুলো চাইলে তাদের আঞ্চলিক সংহতি ও জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষার জন্য নিজস্ব মিলিশিয়া/আধা সামরিক বাহিনী গঠন করতে পারবে।

বঙ্গবন্ধু ৬ দফাকে ‘‘আমাদের বাঁচার দাবি’’ বলে আখ্যায়িত করেন। ৬ দফার দাবিতে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘‘আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না, এদেশের মানুষের অধিকার চাই।’’ ৬ দফার মৌলিক প্রশ্নে কোন সমঝোতা বা আপস করা হবে না।

এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‌''There was no scope of readjustment in his party's six point programme because it was held in the country and as such the six point demands were no more his party's properties, it belonged to the people."

রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্যঃ

৬ দফা আন্দোলনকে দমাতে আইয়ুব খান সরকার বঙ্গবন্ধুসহ ৩৫ জনকে আসামি করে দায়ের করে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। যার আনুষ্ঠানিক নাম দেয়া হয় ‘‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য’’ যাকে বঙ্গবন্ধু ‘‘ইসলামাবাদ ষড়যন্ত্র মামলা’’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। মামলার অভিযোগে বলা হয় ১৯৬২ সালে পাকিস্তান নৌবাহিনীর লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেনের সাথে বঙ্গবন্ধুর সশস্ত্র আন্দোলন নিয়ে কথা হয়। ১৯৬৩ সালে বঙ্গবন্ধু ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলায় তৎকালীন কংগ্রেস নেতা শচীন্দ্রলাল সিংহের সাথে সাক্ষাৎ করে ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুকে বার্তা পাঠিয়ে সশস্ত্র আন্দোলনে সহযোগিতা কামনা করেন। এর প্রতিক্রিয়ায় উদ্ভব ঘটে উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের। 

এ সময়ে জনতার স্লোগান ছিলো “জেলের তালা ভাঙবো, শেখ মুজিবকে আনবো”, “ তুমি কে আমি কে, বাঙালি বাঙালি” বা “তোমার নেতা আমার নেতা, শেখ মুজিব শেখ মুজিব।”  

গণআন্দোলনের কাছে নতি স্বীকার করে আইয়ুব খান সরকার শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। শেখ মুজিব হয়ে উঠেন আপামর জনতার বঙ্গবন্ধু। 

এক ব্যক্তি এক ভোটঃ 

"The Awami League, under Sheikh Mujibur Rahman wins an overwhelming election victory in East Pakistan." -বিবিসি

একেকটি ভোট যেন পশ্চিম পাকিস্তানের দেয়ালে শেষ পেরেক ঠূকে দিচ্ছিলো। ১৯৭০ এর নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ অর্জন করে ভূমিধ্বস বিজয়। ইয়াহিয়া ও জেড এ ভুট্টো জানতেন শেখ মুজিবুর রহমান খাজা নাজিমউদ্দীন বা নুরুল আমিনের মতো নামকাওয়াস্তে বাঙালি ছিলেন না। তাই সমগ্র পাকিস্তানের দায়িত্ব তার উপর ছেড়ে দেবার ব্যাপারে তারা সন্দিহান ছিলেন। বিভিন্নভাবে বাঙালির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে তারা টালবাহানা শুরু করে। ৩ মার্চের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ইয়াহিয়া খান স্থগিত করলে পরিস্থিতি ভিন্ন দিকে মোড় নেয়। ঘোষিত হয় অসহযোগ আন্দোলন। 

রেসকোর্সঃ যেখানে রাজনীতির কবির কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছিলো স্বাধীনতার ডাক

 “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।”

৭ মার্চ, ১৯৭১ সালে তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে ১০ লক্ষ বা তার অধিক মানুষের বিশাল জনসভায় শেখ মুজিবুর রহমান দৃপ্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেন- ‘রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দেব, এদেশের মানুষকে মুক্ত করেই ছাড়বো।’

তার নেতৃত্ব এতোটাই দূরদর্শী ছিল যে, ISI রিপোর্ট করেছিলো- ‘‘চতুর শেখ মুজিব চতুরতার সাথে বক্তৃতা করে গেলেন, একদিকে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে গেলেন, অন্যদিকে বিচ্ছিন্নতাবাদী হওয়ার দায়িত্ব নিলেন না, নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করা ছাড়া আমাদের আর কিছুই করার ছিল না।’’ বঙ্গবন্ধুর ভাষণে উজ্জীবিত হয়ে বাংলার আপামর জনসাধারণ ধীরে ধীরে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। 

যেভাবে স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের হলোঃ 

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মাঝরাতে দখলদার হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালিদের উপর হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়লে শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা করেন। তার স্বাধীনতার ঘোষণায় তিনি বলেনঃ

"This may be my last message, from today Bangladesh is independent. I call upon the people of Bangladesh wherever you might be and with whatever you have, to resist the army of occupation to the last. Your fight must go on until the last soldier of the Pakistan occupation army is expelled from the soil of Bangladesh and final victory is achieved.''

স্বাধীনতা ঘোষণা করার পরপরই শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করা হয় এবং দীর্ঘ নয় মাসের অধিক সময় কারাগারে আটকে রাখা হয়। দৃশ্যত তিনি কারাগারে আটকে থাকলেও তার নামেই পরিচালিত হয় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। দীর্ঘ ২৬৬ দিনের রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম, ৩০ লক্ষ শহীদের আত্মাহুতি এবং ২ লক্ষ মা, বোনের আত্নত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত হয় লাল-সবুজের পতাকা ও স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।

একটি গ্রামীণ পরিবার থেকে উঠে এসে শুধুমাত্র একজন সাধারণ কর্মী হিসেবে খুব অল্প সময়ের মধ্যে তিনি হয়ে উঠেন কোটি কোটি মানুষের অবিসংবাদিত নেতা। তিনি ছিলেন অসাধারণ সাংগঠনিক ক্ষমতার অধিকারী, বাগ্মীতায় তিনি ছিলেন অতুলনীয়। এই দুটি গুণ একইসাথে একজনের মধ্যে দেখা না গেলেও অদ্ভুতভাবে তার মধ্যে এর উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। মানব্জাতির প্রতি ছিল তার চিরায়ত মায়া-মমতার বহিঃপ্রকাশ।

২০১২ সালে প্রকাশিত অসমাপ্ত আত্মজীবনী গ্রন্থে বলছিলেনঃ “একজন মানুষ হিসেবে সমগ্র মানবজাতি নিয়েই আমি ভাবি। একজন বাঙালি হিসেবে যা কিছু বাঙালিদের সঙ্গে সম্পর্কিত তাই আমাকে গভীরভাবে ভাবায়। এই নিরন্তর সম্পৃক্তির উৎস ভালোবাসা, অক্ষয় ভালোবাসা, যে ভালোবাসা আমার রাজনীতি এবং অস্তিত্বকে অর্থবহ করে তোলে।” 

এখান থেকেই এটি স্পষ্ট বলা যায় তিনি নিজেকে বাঙালি পরিচয় দিতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন এবং এখানেই পূর্ব থেকেই যে তার বাঙালি জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন ছিলো সেটির প্রমাণ মেলে। এই আত্মপরিচয় থেকেই এটি বলা যায় যে তার রাজনৈতিক দর্শন ছিলো মূলত বাঙালি জাতীয়তাবাদ, মানবিক গণতন্ত্র, শোষণমুক্ত সমাজ ব্যবস্থা ও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে তোলা। 

যত দূরে যাও পাখি, দেখা হবে ফের
স্বাধীন ঐ আকাশটা শেখ মুজিবের।
-কবি ইমতিয়াজ মাহমুদ

লেখক: সহকারী কমিশনার ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, নড়াইল

আমারসংবাদ/জেআই