প্রিন্ট সংস্করণ॥এনায়েত উল্লাহ
মে ২৪, ২০১৯, ০৯:৩৮ পিএম
ঈদ মানে আনন্দ, ঈদ মানে খুশি। সেই ঈদের দিনে সবাই চায় আনন্দ করতে। যেখানে ধনী-গরিব ভেদাভেদ মানে না। নিজের ছেলেমেয়ে, ভাইবোনসহ স্বজনদের মুখে হাসি ফুটাতে ব্যস্ত থাকে পরিবারের কর্তারা। কর্তার পকেটে টাকা আছে বা নাই তা দেখার সময় নেই স্বজনদের।
গরিব হোক কিংবা ধনী হোক সবার চিন্তা এখন একটাই, কিভাবে তাদের সন্তান ও আত্মীয়দের খুশি করা যায়। নিম্নবিত্ত পরিবারের পক্ষে একসঙ্গে টাকা জমিয়ে ঈদ মার্কেট করা কষ্টকর। তাই তারা ধীরে ধীরে মার্কেট করতে শুরু করে দিয়েছেন। আর দাম কম হওয়ার কারণে তাদের প্রথম পছন্দ ফুটপাতের মার্কেটগুলো।
রাজধানীর সদরঘাট, ওয়াইজঘাট, পাটুয়াটুলী, নবাববাড়ি, বাবুবাজার, গুলিস্তান, বায়তুল মোকাররম দক্ষিণ গেট, উত্তর গেট এবং পশ্চিম পাশসহ সব ফুটপাতে ঈদের আমেজ দেখা গেছে। নিম্নবিত্ত এবং অনেক মধ্যবিত্ত পরিবারের পছন্দের বাজার হচ্ছে ফুটপাত। যেখান থেকে তাদের আয়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিজের পছন্দের কেনাকাটা করতে পারে। যদিও ঈদ আসতে বাকি আরো প্রায় ১০ দিন। ঈদ সামনে রেখে ফুটপাতের বাজারগুলো ইতোমধ্যে বেশ জমজমাট।
২০ রমজানের পরে বড় মার্কেট বা ফুটপাতে পা রাখার জায়গা পাওয়া যাবে না বলেও জানান বিক্রেতারা। সব মার্কেটে থাকবে প্রচণ্ড ভিড়। যেখানে প্রবেশ করা হবে খুবই দুষ্কর। তাই সেই কষ্ট থেকে বাঁচতে অনেকেই আগে থেকে শুরু করে দিয়েছেন তাদের ঈদ মার্কেট। এর পরও গতকাল ছুটির দিন থাকাতে প্রচণ্ড ভিড় ছিল। গুলিস্তানে পা পালানোর জায়গা ছিল না।
ঈদ কাছাকাছি এলে মার্কেটগুলোতে গিয়ে নিজেদের পছন্দমতো বাজার করাটা হয়ে ওঠে কঠিন। তখন প্রচণ্ড ভিড়ের কারণে কোনো জিনিস ভালোভাবে দেখা ও দরদাম করা যায় না। দোকানদার যা বলে তা দিয়েই কিনতে হয় ক্রেতাকে। তাই মার্কেটে প্রচণ্ড ভিড়ের কথা চিন্তা করে অনেক পরিবারের লোকজন আগেই মার্কেট করতে ভিড় জমিয়েছেন ফুটপাতে। খাদিজা আক্তার পেশায় একজন শ্রমিক।
তিনি জিনজিরা জুতার কারখানায় কাজ করেন। গতকাল ছুটির দিন থাকাতে মার্কেট করতে এসেছে সদরঘাটের ফুটপাতে। তার স্বামীকে বলছে তুমি কি কিনবা? স্বামী উত্তরে বলে, আমার তো কিছু কেনার দরকার নেই। গত বছরের শার্টটাই চলবে। ওইটা ইস্ত্রি করলে একদম নতুন হয়ে যাবে। সাথে সাথেই স্ত্রী বলে,আরে কি যে বলো না, ওটা তো পুরাতন হয়ে গেছে। একটা নতুন শার্ট কিনো।
এসময় তাদের সাথে কথা বলা শুরু হলে খাদিজা আক্তার জানান, আমরা তো ধনী মানুষ না। তাই ধনীদের মতো বড় মার্কেটে গিয়ে ঈদ মার্কেট করার ক্ষমতা নেই। আমরা যে গরিব এটা তো বাচ্চারা বুঝবে না। তাই বাচ্চাদের বুঝ দিতে আমাদের সাধ্যানুযায়ী ফুটপাত থেকেই কেনাকাটা করছি। কি কিনছেন জানতে চাইলে বলেন, দুই ছেলের জন্য পাঞ্জাবি কিনছি।
আর মেয়ের জন্য একটা কামিজ কিনছি। আর বাচ্চার বাবার জন্য একটা শার্ট কিনতে চেয়েছিলাম, কিন্তু উনি কিনবেন না। আপনার জন্য কিছু কেনেন নি- প্রশ্ন করলে খাদিজা বলেন, আমি কিছু কিনিনি। আমি তো কোথাও যাবো না। ঈদের দিন ঘরেই থাকব। বাচ্চারা খুশি হলেই আমি খুশি। এত আগে মার্কেট করার কথা জানতে চাইলে তারা বলেন, গত মাসে যে বেতন পেয়েছি তা দিয়ে মার্কেট করছি।
আর এই মাসে যে বেতন ও বোনাস পাব তা দিয়ে বাড়ি আসা যাওয়ার ভাড়া ও ঈদে চুলার বাজার করব। এভাবেই চোখের জল মুছে মুছে নিজের অসহায়ত্বের কথা ব্যক্ত করছিলেন খাদিজা আক্তার। এ থেকে বুঝা যায় ঈদ কারো জন্য খুশি আবার কারো জন্য আনন্দের মাঝেও কষ্টের। নিজের সন্তান ও নিজেদের জন্য পছন্দ অনুসারে ঈদ মার্কেট করতে না পারাতে বুকের মাঝে কষ্টের বিশাল পাথর।
যা সরাতেও পারে না আবার সহ্যও করতেও পারেন না। এভাবেই শেষ হয়ে যায় তাদের জীবন। মার্কেট ঘুরে দেখা যায় ঈদ সামনে রেখে মেয়েদের মনোযোগ বেশি শাড়ির দিকে। গভীর মনোযোগের সঙ্গে শাড়ির পাড়ের কাজ দেখছেন, দেখছেন আঁচল এবং জমিনের কাজটা মানানসই কি না? একজন অন্যজনকে বলছেন, আঁচলের ডিজাইনটা এমন না হলে ভালো হতো। আরে, শাড়ির জমিনটা তো কেমন যেন, পেটানো জমিন দেখান। এই হলো ঈদবাজারের শাড়ির ক্রেতাদের অবস্থা।
পাটুয়াটুলি মার্কেটের বাইরে দাঁড়িয়ে শাড়ি দেখছিলেন নারীরা। এর মধ্য থেকে একজন বলে উঠলেন, ‘শাড়ি কিনতে আইস্যা সবাই দেখি ডিজাইনার হইয়া গেছেন’। রাজধানীর বিভিন্ন ফুটপাতের বিক্রেতা ও ক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, এবার মেয়ে ক্রেতাদের নজর থ্রি-পিস এবং একটু ভিন্ন ধরনের শাড়ির দিকে।
অন্যদিকে রাজধানীর অন্যতম ফুটপাত বাজার হিসেবে পরিচিত গুলিস্তান ও বায়তুল মোকাররম মার্কেট বেশ জমে উঠেছে। গতকাল দুপুরে বায়তুল মোকাররম মসজিদের দক্ষিণ গেটে দেখা যায়, একদল বিক্রেতা বলছেন, যেটাই নেন ৫০০ টাকা। দেইখা নেন, বাইছা নেন ৫০০ টাকা। বিভিন্ন কালার ও ডিজাইনের পাঞ্জাবি ১০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে এই মার্কেটে।
অন্যদিকে, বায়তুল মোকাররমের পশ্চিম পাশে বিক্রি হচ্ছে থান কাপড়, ছোটদের জামা কাপড় ও জুতা। বাচ্চাদের প্যান্ট শার্ট বিক্রি করছেন সেলিম মিয়া। তিনি আমার সংবাদকে বলেন, বেচা বিক্রি শুরু হয়েছে। আজকে ছুটির দিন হিসেবে বেচা বিক্রি ভালো। গুলিস্তান শপিং কমপ্লেক্সের মার্কেটের বাইরে থেকে গৃহিণী ফাতেমা আক্তার একটি শার্ট ও প্যান্ট কিনলেন ২৫০ টাকায়। তিনি জানালেন, এবার ঠিক করেই রেখেছিলেন, ঈদে বাচ্চাদের জন্য প্যান্ট শার্ট কিনবেন।
অন্যদিকে থ্রি-পিসেরও আছে ব্যাপক চাহিদা। ভালো নকশা ও সুন্দর ডিজাইন দেখে থ্রি-পিস কিনছেন মেয়েরা। ফুটপাত থেকে মার্কেট করে আনন্দে আছেন ক্রেতারা। এমনটাই চোখে পড়েছে মার্কেট ঘুরে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, ব্যবসা ভালোই হচ্ছে। পুরোপুরি ব্যবসা এখনো শুরু হয়নি।
পুরোদমে শুরু হবে ২০ রমজানের পর। তখন আমরা একেকদিন ৫০ থেকে ৭০ হাজার টাকা বেচাকেনা করব। এখন কেমন হচ্ছে জানতে চাইলে ব্যবসায়ীরা বলেন, ৩০-৪০ হাজাররের মতো হয় দৈনিক। তবে জুতার ব্যবসার মার্কেট এখনো জমেনি বলে জানিয়েছেন জুতা ব্যবসায়ীরা। তাদের দাবি আগামী সপ্তাহ থেকে শুরু হবে বেচাকেনা।
এ ব্যাপারে গুলিস্তান শপিং কমপ্লেক্সের নিচের জুতা ব্যবসায়ী মু. সলিম মিয়া জানান, চায়না জুতা বেশি চলে। দেশি জুতা চলে তবে একটু কম। তিনি গড়ে দৈনিক দুই থেকে তিন হাজার টাকা বিক্রি করেন। তবে গত বছরের চেয়ে এবার ব্যবসা ভালো হবে। বলে আশা প্রকাশ করেন। মার্কেট ঘুরে দেখা যায়, বাচ্চাদের টি-শার্ট, থ্রি কোয়াটার, মেগি হাতা গেঞ্জি চলছে বেশি।
ক্রেতা তামান্না আক্তার জানান, গরম বেশি তাই হালকা কাপড় কিনেছেন। সজিব নামের ব্যবসায়ী জানালেন, ক্রেতারা আমাদের কাছে এসে দামি মাল চায়, অথচ দাম কম বলে এই মালটাই মার্কেটে গেলে বেশি দামে কেনেন। বিভিন্ন থ্রি-পিসের দাম ৫০০ থেকে শুরু করে চার হাজার টাকা পর্যন্ত আছে। রমজানের শেষের দিকে বেচাকেনা বাড়বে বলে জানান তারা। নবাববাড়ি মার্কেটের সামনে দোকান করেন সিরাজুল হক। তিনি বলেন, এবারের বেচকেনা গত বছরের চেয়ে ভালো তবে আগামী সপ্তাহ থেকে আরো ভালো হবে।
তাহের ক্লথের স্বত্বাধিকারী শামিম জানালেন, এবারের ঈদে ভালো বেচাকেনা হবে। এখন থেকেই এটা বুঝা যাচ্ছে। এখনই দৈনিক ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকা বেচা বিক্রি হচ্ছে। তবে ২০ রমজানের পর এটা এক লাখ থেকে এক লাখ ২০ হাজারে দাঁড়াবে। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বাচ্চাদের কাপড়ের চাহিদা বেশি। অভিভাবকরা নিজেদের চেয়ে বাচ্চাদের প্রতি গুরুত্ব বেশি দেন তাই বাচ্চাদের কাপড় বেশি চলছে।
এ ব্যাপারে সদরঘাটের ব্যবসায়ী তরিকুল ইসলাম জানান, তার দোকানে ০ থেকে ১২ বছরের বাচ্চাদের কাপড় পাওয়া যায়। ঈদের বেচাকেনা ইতোমধ্যেই শুরু হয়েছে তবে পুরোদমে শুরু হতে সময় লাগবে আরো কয়েকদিন। রাজধানীর ওয়ারী থেকে সুমনা হোসেন দম্পতি এসেছেন নবাববাড়ি রোডের একটি ছোট বিক্রয়কেন্দ্রে। কিনেছেন এক জোড়া যুগল পোশাক। পেশায় তারা সরকারি চাকরিজীবী। তাদের ভাষ্য, বিয়ের পর এবারই বাচ্চাদের নিয়ে তাদের প্রথম ঈদ। ঈদের দিন ঘুরতে বের হবে তারা বাচ্চাদের নিয়ে।
সে ক্ষেত্রে দু’জনের পোশাকও কিনেছেন কালার মিল রেখে। সাথে সাথে জমজ দুই বাচ্চার জন্যও কিনেছেন একই কালার একই ডিজাইনের ড্রেস। মিল থাকলে উৎসবের ভাবটা জমে ভালো। আর ছবিও আসে ভালো। একটা সময় যুগল পোশাক হতো শুধু দুই বোন বা দুই ভাইয়ের।
অথবা যমজ বা পিঠাপিঠি ভাইবোন একই রকম পোশাক পরত, যেন দুজনের পোশাকি মিলটাও থাকে। আর এখন সেটা স্বামী-স্ত্রী যুগল পোশাক পাওয়া যাচ্ছে। আগে দম্পতিরা বাজার ঘুরে ঘুরে নিজেরা মিলিয়ে পোশাক কিনতেন, কিংবা দরজির কাছে বানিয়ে নিতেন। এখন ডিজাইনাররা এ কাজ সহজ করে দিয়েছেন।
এবারের ঈদ উৎসবে এ ধরনের পোশাক ভালো গুরুত্ব পেয়েছে বলে মন্তব্য বিক্রেতাদের। বিশেষ দিনের পোশাকে মন ও মতের একাত্মতা প্রকাশ করতে চান যুগলেরা। বেছে নিতে চান একই রং ও নকশার যুগলবন্দি পোশাক। আবার কখনো পরিবারের ছোট্ট ছেলেটি বায়না ধরে, বাবার মতো পাঞ্জাবি পরবে সে।
মেয়েটা হয়তো আবদার করল, তার জামাটি হবে মায়ের শাড়ির মতো। নগরবাসীর এমন বাসনা পূরণ করতে আগে যেতে হতো দরজির দোকানে কিন্তু এখন ফুটপাতই পাওয়া যাচ্ছে এরকম তৈরি পোশাক। বাজার ঘুরে চোখে পড়েছে যুগল বা ম্যাচিং পোশাকের সমাহার।