Amar Sangbad
ঢাকা মঙ্গলবার, ১৩ মে, ২০২৫,

নারী অধিকার ও আমাদের সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি  

ড. জান্নাতুল ফেরদৌস

ডিসেম্বর ১২, ২০২১, ০৭:৫৫ পিএম


নারী অধিকার ও আমাদের সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি  

নারী অধিকার পরিভাষাটি বলতে বোঝায় এক ধরনের স্বাধীনতা, যা সব বয়সের মেয়ে ও নারীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয়। এই অধিকার হতে পারে প্রাতিষ্ঠানিক, আইনানুগ, আঞ্চলিক সংস্কৃতি দ্বারা সিদ্ধ বা কোনো সমাজের আচরণের বহিঃপ্রকাশ। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই অধিকারকে অস্বীকার করতেও দেখা যায়। আবার সীমান্ত পেরিয়ে বিভিন্ন দেশে এই অধিকারের  সংজ্ঞায় বিভিন্ন ধরনের পার্থক্যও দেখতে পাওয়া যায়।

আভিধানিক দৃষ্টিকোণ থেকে সংস্কৃত ‘নৃ’ থেকে ‘নারী’ শব্দটির উৎপত্তি (নৃ+ঈ=নারী)। মূলত ‘নারী’ কথাটি প্রাপ্তবয়স্ক স্ত্রী-লোকের ক্ষেত্রে ব্যবহূত হয়। প্রসঙ্গত, ‘নারী অধিকার’ বলতে সমগ্র ‘স্ত্রী’ জাতির প্রাপ্য ও ন্যায়সংগত অধিকারকে বোঝানো হয়। তবে কোনটা প্রাপ্য বা ন্যায়সংগত অধিকার— তা নিয়েই বিতর্ক চলছে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে। কিন্তু আজ-অব্দি কোনো উপসংহারে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি।

আমাদের দেশে নয় বরং গোটা বিশ্বেই নারী অধিকার নিয়ে নানা ধরনের মতবাদ চালু রয়েছে। ধর্ম, বিশ্বাস, ঐতিহ্য, মূল্যবোধ, চিন্তা ও আদর্শগত পার্থক্যের কারণে নারী অধিকার নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান এবং মতপার্থক্য লক্ষ করা যায়। এক পক্ষের কাছে যা অধিকার, অপর পক্ষের কাছে তা অনধিকার বলে বিবেচিত হয়। কেউ কেউ পুরুষের সমকক্ষতা অর্জনকেই নারীর প্রকৃত অধিকার বলে মনে করেন।

বাংলাদেশের আইনে সব মানুষের সমান অধিকারের কথা বিভিন্নভাবে বিভিন্ন আইন, ঘোষণা বা সনদে বলা হয়েছে; কিন্তু সমঅধিকারের কথা বলা থাকলেও একটা বিরাট বৈষম্য চোখে পড়ে নারী-পুরুষ সম্পর্কের ক্ষেত্রে। পরিবারে, কল-কারখানায়, কৃষিতে, ব্যবসায়, প্রশাসনে, শিক্ষা-সংস্কৃতিসহ বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে নারীর অংশগ্রহণ থাকলেও শুধুমাত্র নারী হওয়ার কারণে আজও পৃথিবীর প্রতিটি কোণে নারীরা অবহেলিত, নির্যাতিত, বৈষম্য ও বঞ্চনার শিকার হচ্ছে। এই বৈষম্য কখনো রূপ নেয় শারীরিক সহিংসতা পর্যন্ত। পত্রিকার পাতায় পাঠকরা সাজানো আর্টিকেল পড়লে সেটির বাস্তবতা কখনো উপলব্ধি হবে বলে মনে হয় না। 

তবে প্রতিকারের লক্ষ্যে বিশেষভাবে নারীদের অধিকার রক্ষার জন্য জাতিসংঘ কর্তৃক ইতিপূর্বে গৃহীত হয়েছে নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য বিলোপ সনদ (সিডও)। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের পাশাপাশি বাংলাদেশও এ সনদে স্বাক্ষর করে। স্বাক্ষরের পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ সরকার নারী উন্নয়নের লক্ষ্যে জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিমালা ও কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। নারীর উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নের জন্য নারীর মৌলিক অধিকারগুলো নিশ্চিতকরণ, সাংবিধানিক গ্যারান্টিসহ রাষ্ট্রীয় শাসনযন্ত্রের সব স্তরে যেমন পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে নারীর অংশগ্রহণ এবং অধিকার নিশ্চিতকরণের জন্য বাংলাদেশের সংবিধানে পুরুষের সাথে নারীর অধিকারকে সমান স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। নারী-পুরুষভেদে সেখানে কোনো পার্থক্য করা হয়নি বরং নারীদের এগিয়ে আসার জন্য প্রয়োজনে বিশেষ আইন প্রণয়নের কথাও বাংলাদেশের সংবিধানে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে।

পারিবারিক ক্ষেত্রে নারীর অধিকার রক্ষায় পৃথক ধর্মাবলম্বীদের জন্য রয়েছে পৃথক পৃথক পারিবারিক আইন, যাতে মূলত বিয়ে, দেনমোহর, তালাক, ভরণপোষণ ও সন্তানের অভিভাবকত্ব-সংক্রান্ত অধিকারগুলো সন্নিবেশিত রয়েছে। পারিবারিকভাবে সংঘটিত এসব সমস্যা সমাধানের জন্য প্রতিটি জেলায় স্থাপিত হয়েছে একটি পারিবারিক আদালত। কিন্তু আমাদের দেশের বেশিরভাগ নারীই জানেন না, আইনগতভাবে তাদের কী কী অধিকার আছে বা এ অধিকারগুলো না পেলে তারা প্রতিকারের জন্য কোথায় যাবেন। উপরন্তু আমাদের চিন্তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলছে পাচার, যৌতুকের জন্য নির্যাতন, এসিড সন্ত্রাস, ধর্ষণ, যৌন নিপীড়ন ও ফতোয়াবাজির শিকার অসংখ্য নারীমুখ। 

এসব অপরাধ দমনের লক্ষ্যে সরকার বিভিন্ন কঠোর আইন-কানুন প্রণয়ন করেছে; যেমন: নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০, এসিড সন্ত্রাস দমন আইন ২০০২ ও যৌতুক নিষিদ্ধকরণ আইন ১৮০। কিন্তু বাস্তবতার নিরিখে এসব আইন কতটা কার্যকর এবং এর প্রভাবে অপরাধ কতটা দমন হচ্ছে— সেটি প্রশ্নবিদ্ধ। 

আবার আমাদের দেশের নারী অধিকার সংগঠনগুলো নারী নির্যাতনের বিচারের দাবিতে ক্রমশ দুর্বল ভূমিকা রাখছে। দাবি আদায় বা বিচারের দাবি জানানোর ক্ষেত্রে তাদের শানিত ভাবটা অনুপস্থিত। রাজপথেও তাদের অনুপস্থিতি লক্ষ করার মতো। কিন্তু কেন?

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিসংখ্যান অনুযায়ী চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত দেশে ৭১ নারী শুধুমাত্র স্বামীর হাতেই নিহত হয়েছেন। শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ৩৮৭টি। এসব নির্যাতনের মধ্যে সব ধরনের নির্যাতনই আছে। এছাড়া আরও ৩৮৭ নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। ৭১টি গণধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। কেউ কি এসব ঘটনার প্রতিবাদ করেছেন? মহিলা ও শিশু মন্ত্রণালয় বা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে কোনো জবাব দাবি করেছেন? এ দুই মন্ত্রণালয়ের কী কোনো ব্যাখ্যা তারা পেয়েছেন? অব্যাহত প্রতিবাদ, মৃত্যুদণ্ডের বিধান থাকার পরও কেন ধর্ষণের হার বাড়ছে? এর জন্য দায়ী বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা, নানাধরনের আর্থ-রাজনৈতিক-সামাজিক প্রভাব এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সদিচ্ছার অভাব। সে সঙ্গে বলতে হচ্ছে, দাবি-দাওয়া আদায়ে নারী অধিকারকর্মীদের জোরালো ভূমিকার অভাব রয়েছে।

আবার কয়েক বছর ধরে অভিযোগ উঠছে, প্রশাসন মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা নিয়ে ধর্ষণের শিকার নারীর সঙ্গে ধর্ষকের বিয়ের ব্যবস্থা করে দেয়ার নীতি গ্রহণ করেছে। এখন কথা হচ্ছে, ধর্ষণের শিকার নারীর পরিবার কথিত সামাজিক সম্মান রক্ষার যুক্তিতে ভিকটিমের ওপর কী দ্বিতীয়বারের মতো আরেকটি গুরুতর অন্যায় চাপিয়ে দিচ্ছে না? ধর্ষণে যেখানে শারীরিক ক্ষতি ছাড়াও শিকার নারীর সম্ভ্রম বা মানবিক মর্যাদাকে আঘাত করা হয়, তা কি এ ধরনের বিয়েতে পুনরুদ্ধার হবে? ধর্ষণের শিকার নারী যে বিয়ের পর ধর্ষণকারী দ্বারা আরও বেশি বা নিষ্ঠুর নির্যাতনের শিকার হবেন না— তার নিশ্চয়তা কী? 

বিয়ের শর্তে জামিন পাওয়া অভিযুক্ত ব্যক্তি যে পরে বিচ্ছেদ ঘটাবে না কিংবা ফেরার হবে না— তা কীভাবে নিশ্চিত হওয়া যাবে?  বস্তুত ধর্ষক যেখানে নিজের প্রাণ বাঁচানোর জন্য ধর্ষিতাকে বিয়ের মাধ্যমে সমোঝোতায় পৌঁছুতে চায়, সেটি কখনও ইতিবাচক হতে পারে না। বরং এমন ঠুনকো সমঝোতার মধ্য দিয়ে অসহায় নারীকে একটি দীর্ঘকালীন ক্ষতির মুখে ঠেলে দেয়া হয়। পাশাপাশি ইঙ্গিতপূর্ণভাবে আরও অনেক অপরাধপ্রবণ ব্যক্তিতে উৎসাহিত করা হয়, যা নিন্দনীয়। 

তবে আশার কথা হলো, ধীরে হলেও নারী তার নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হচ্ছে। আগে অনেক নারী তার বিয়ের বিষয়ে মতামত প্রদান করতে পারতেন না। সন্তানের অভিভাবকত্ব দাবি করতে পারতেন না। অনেকেই পরিবার থেকে পূর্ণ স্বাধীনতা পেতেন না। কর্মক্ষেত্রে পুরুষের পাশাপাশি নারীরা কাজ করলেও তাদের সে আয় স্বাধীনভাবে নিজের ইচ্ছে অনুযায়ী খরচ করতে পারতেন না। কিন্তু এখন সে অবস্থার ধীরে ধীরে পরিবর্তন হচ্ছে। বাংলাদেশে বর্তমানে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নারীদের উপস্থিতি পুরুষের তুলনায় কম হলেও সেটি আশা জাগানো। 

সর্বোপরি নারীর অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে হলে আমাদের সামাজিক চেতনার আমূল পরিবর্তন সাধন করা প্রয়োজন। শিক্ষাঙ্গন থেকে কর্মক্ষেত্র এবং ঘর থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারণী পর্যায় পর্যন্ত সব স্তরে প্রকৃতপক্ষে নারীদের অধিকারের বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। তবে তার জন্য প্রথমত নারীদেরই এগিয়ে আসতে হবে। নামতে হবে চিন্তা-চেতনার পরিবর্তনের দীর্ঘ যুদ্ধে। 

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, লোকপ্রশাসন বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়