Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪,

দুর্যোগে নারী ও শিশু : প্রেক্ষিত বাংলাদেশ

ফারিহা হোসেন

জানুয়ারি ৭, ২০২২, ০৭:১০ পিএম


দুর্যোগে নারী ও শিশু : প্রেক্ষিত বাংলাদেশ

বাংলাদেশ পৃথিবীর সর্ববৃহৎ সক্রিয় ডেল্টা, এর গঠন প্রক্রিয়া এখনো চলছে। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণেই প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ এ দেশ। ঝড়, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস বছরজুড়েই লেগে থাকে। ১৯৭০-এর ১২ নভেম্বর দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে ভয়াল ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে ১০ লক্ষাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। সেই ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষতি আজও মানুষের মনে ও ইতিহাসের পাতায় গেঁথে আছে।

এখনো প্রায় প্রতি বছর ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাস হয়। এ জন্য প্রধানত দায়ী জলবায়ু পরির্বতনের বিরুপ প্রভাব, সাথে মানুষও। পৃথিবীর সর্বদক্ষিণের নিম্নভূমিতে অবস্থান বলে বাংলাদেশে দুর্যোগের মাত্রা যেমন অধিকতর, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি, একইভাবে বদলেছে দুর্যোগের ধরনও। বন্যা, ঝড়, জলোচ্ছ্বাসসহ যে কোনো ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগে মানুষের জীবন ও সম্পদের ক্ষতি হয়। 

তবে সর্বাধিক ক্ষতি এবং ঝুঁকির মধ্যে থাকে নারী এবং শিশু। বিগত দিনে দেশে সংঘটিত বন্যাসহ সব রকমের দুর্যোগে এর প্রমাণ মেলে। বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর অন্যতম। এখানকার জনসংখ্যার প্রায় ৫০-৫৫ শতাংশই হচ্ছে নারী ও শিশু। কাজেই বন্যাসহ সব ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগে দেশের উপকূলবতী এলাকা, দ্বীপ, হাওর-বাঁওড়, চর, পাহাড়িঅঞ্চল এবং শহরের বস্তি এলাকার অধিকাংশ নারী ও শিশু ক্ষতির মুখে পতিত হয়। অবশ্য বন্যা, ঝড় জলোচ্ছ্বাসে মানুষের জীবন রক্ষায় দেশের সমুদ্র উপকূলের জেলা উপজেলায় পর্যাপ্ত আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করেছে। একই সঙ্গে বন্যা জলোচ্ছ্বাসের আগাম সকর্তকতা পেলেই নারী, শিশুদের নিকটস্থ আশ্রয়কেন্দ্রে নিরপদে রাখার উদ্যোগ নেয়া হয়।

সাধারণত বন্যায় নিম্নাঞ্চল এবং সমুদ্র উপকূল প্লাবিত হয়ে জীবন ও ফসলহানি, স্বাস্থ্যঝুঁকি ও বাস্তুচ্যুতিসহ বিভিন্ন সমস্যা তৈরি হয়। টানা বৃষ্টি আর উজান থেকে নেমে আসা ঢলের কারণেই আমাদের দেশে বন্যার সৃষ্টি হয়। এসব এলাকার সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে নারী শিশুরা ক্ষতির মুখে পড়ে। জলবায়ু পরির্বতনের কারণে ঋতুচক্র বদলে যাচ্ছে।

অধিকতর উষ্ণ ও দীর্ঘমেয়াদি গ্রীষ্ম, বিলম্বিত ও দীর্ঘায়িত বর্ষা মৌসুমে অতি বা অনাবৃষ্টি, অন্যদিকে প্রায় অনুপস্থিত শরৎ, ক্ষণেক্ষণে তীব্র শৈত্যপ্রবাহ, স্বল্পমেয়াদের শীত মৌসুম ইত্যাদি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব। বন্যা, খরা, জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ হানা দিচ্ছে প্রতিনিয়ত একই কারণে, যার প্রভাব পড়ছে জল, জঙ্গল ও মাটিতে। এর মধ্যে উপকূলীয় অঞ্চল হচ্ছে গভীর ক্ষতের জায়গা। প্রতিটি দুর্যোগে নারী ও শিশুরাই সবচেয়ে বেশি অসহায়। 

বন্যার কারণে নদী ভাঙন হয়। আবার নদী ভেঙে লোকালয় প্লাবিত হয়। এর ফলশ্রুতিতে প্রাণহানি, জমি ও সম্পদ বিনষ্ট এবং বহু মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়। এর ফলেও তখনও নারী শিশুরাই বেশি বিপদে পড়ে। দেশের মোট জনসংখ্যার ২৫ শতাংশের বসবাসের এই এলাকাগুলো ওই সব প্রাকৃতিক দুর্যোগে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যার শিকার হয় সেসব এলাকায় বসবাসের সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে শিশুরা। বন্যার কারণে সুপেয় পানির অভাব নারী শিশুর জীবনকে বিপন্ন করে ফেলে। পুষ্টিহীনতায় আক্রান্ত হয়ে বাড়তে থাকে শিশুদের জীবনের ঝুঁকি। 

এটা বলা যৌক্তিক যে, আবহাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঋতুচক্রের অস্বাভাবিক বদলের চূড়ান্ত নেতিবাচক প্রভাব সব মানুষের জীবন ও জীবিকায় পড়ছে আর তার খেসারত গুনতে হচ্ছে প্রধানত নারী ও শিশুদের। পরিবারের গৃহস্থালি কাজের জন্য প্রতিদিন সুপেয় পানির প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে মাইলের পর মাইল হাঁটতে হচ্ছে নারী ও কন্যাশিশুদের। ইউনিসেফের ২০১৩ সালের একটি জরিপে পানি সংগ্রহে নারী-পুরুষের ভূমিকার ভিন্নতা দেখা গেছে। ৮৯ দশমিক ছয় শতাংশ নারী পরিবারের জন্য পানি সংগ্রহ করেন। অন্যদিকে এ দায়িত্ব পালন করেন মাত্র চার দশমিক ছয় শতাংশ পুরুষ। উপকূলীয় অঞ্চলগুলিতে লবণাক্ত পানি ব্যবহারের ফলে নারীর প্রজনন স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়েছে। 

আইসিডিডিআরবির এক গবেষণায় বিজ্ঞানীরা বলছেন, খাবার পানির সঙ্গে যে পরিমাণ লবণ নারীদের দেহে প্রবেশ করছে তার প্রভাবে দেশের অন্য অঞ্চলের তুলনায় উপকূলীয় অঞ্চলের নারীদের গর্ভপাত বেশি হয়। এ ছাড়া উপকূলীয় অঞ্চলে যেসব নারী চিংড়ি রেণুপোনা সংগ্রহের কাজ করে তাদেরও প্রজনন স্বাস্থ্যের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। মাত্রাতিরিক্ত লোনা পানির দৈনন্দিন ব্যবহারের ফলে জরায়ুসংক্রান্ত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন উপকূলীয় অঞ্চলের নারীরা। বয়সভেদে নারী ও কন্যাশিশুর ওপর ভিন্ন ভিন্ন প্রভাব পড়ে, যেখানে মাধ্যমিক ও উচ্চপর্যায়ের শিক্ষা থেকে কন্যাশিশুর ঝরে পড়া ও বাল্যবিয়ে বাদ পড়েনি। আর তাতে নারী ও শিশুরাই অধিক হারে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এসব অঞ্চলে বন্যাও এ ক্ষতি আরও বাড়িয়ে দেয়। 

জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে দেশের পার্বত্য তিন জেলার ভূমি, ফসল উৎপাদন ও পানি ব্যবস্থাপনার ব্যাপক পরিবর্তন হওয়ায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন ওই এলাকার নারীরা। এ অঞ্চলের বন উজাড় হওয়ার কারণে পাহাড়ি ছড়াগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে। ফলে পাহাড়ি শিশু ও নারীদের দূরবর্তী অন্য পাহাড় ছড়া থেকে খাবার পানি সংগ্রহ করতে হচ্ছে।

এমনিতেই পাহাড়ি নারী শিশুরা পুষ্টিহীনতায় ভোগে, তার ওপর পাহাড়ি উঁচু-নিচু পথ বেয়ে প্রতিদিন পানি সংগ্রহের কারণে তাদের অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়ে। এ সময় ক্ষতিগ্রস্ত পাহাড়ি আদিবাসী নারী ও শিশু খেয়ে না খেয়ে কোনো রকমে জীবন ধারণ করে। ফ্ল্যাশ ফ্লাও বা হঠাৎ বন্যায় এ অঞ্চলের নারী শিশুদের দুর্ভোগ অনেক বেড়ে যায়।

নেত্রকোনা, সিলেট, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এ সাতটি জেলার প্রায় ৮.৫৮ লাখ হেক্টর জমি নিয়ে হাওয়র অঞ্চল গঠিত। দেশের মোট ধান উৎপাদনের প্রায় ১৬ শতাংশ আসে হাওর থেকে। গবেষক ড. আবুল বারকাতের গবেষণায় দেখা গেছে, জিডিপির দুই শতাংশ আসে হাওরের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে। হাওরে বছরে একবার ফসল (বোরো ধান) হয়। এ সময়ে বছরের ছয়-সাত মাস এলাকায় কাজ থাকে। বাকি সময় মেয়েদের কাজ থাকে না। 

বছরের পাঁচ-ছয় মাস ঘরে চাল থাকে। দেশের বৃহৎ এ হাওয়র অঞ্চলে জলবায়ুর প্রভাবে অকাল বন্যায় বাঁধ উপচে বা ভেঙে ফসলি জমি তলিয়ে যাওয়া, মৎস্যসম্পদ, হাঁসসহ অন্যান্য জলজ সম্পদ নষ্ট হয় প্রায়ই। এ ক্ষেত্রেও বন্যায় সেখানকার নারী ও শিশুরাই অধিক দুর্ভোগে থাকে। পানিবন্দি অবস্থায় খাদ্য সংকট, যাতায়াত, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা সবই দুর্লভ হয়ে পড়ে। এ দুর্যোগের এমনকি অনেক সময় জরুরি প্রসূতি সেবার অভাবে অনেক নারীর মৃত্যুও হয়। পানিবাহিত অন্যান্য রোগের দ্রুত চিকিৎসা না পেয়ে শিশুদের মৃত্যু বেড়ে যায়। পরবর্তী সময়ে তারা পুষ্টিহীনতাজনিত বিভিন্ন অসুখে ভুগতে থাকে।

বিগত ২০০৮ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে উদ্বাস্তু হয়েছে দেশের প্রায় ৪৭ লাখ মানুষ। ২০৫০ সালের মধ্যে প্রতি সাতজনের একজন জলবায়ু উদ্বাস্তুতে পরিণত হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বন্যাসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগকালে নারী ও শিশুরাই বেশি ঝুঁকিতে থাকে। সব ঝুঁকি মাথায় নিয়েই সুরক্ষা দেয়ার কার্যকর উদ্যোগ প্রয়োজন। 

কারণ শিশু ও নারী দুর্যোগে সর্বাধিক প্রতিকূলতার সম্মুখীন হন। যেহেতু প্রাকৃতিক দুর্যোগ বন্ধ বা কমিয়ে আনা আমাদের হাতে নেই, তাই মোকাবিলা এবং এর সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়ার সক্ষমতা বাড়ানোর দিকে জোর দিতে হবে আমাদের। মানবসৃষ্ট দুর্যোগ ভোগান্তির মাত্রা যাতে না বাড়ে সেজন্য সুন্দরবনকে সুরক্ষা দিতে হবে। উপকূলে সবুজ বেষ্টনী বাড়াতে হবে। পুরোনো বেড়িবাঁধ নতুন উচ্চতায় মজবুত করে নির্মাণ করাও জরুরি। দেশের জলাধারগুলো রক্ষা করতে হবে। 

জলাধারগুলোতে বর্জ্য ফেলা বন্ধ করতে নিজে সচেতন হওয়ার পাশাপাশি অন্যকেও সচেতন করতে হবে। নদীগুলোর গভীরতা বাড়াতে খনন এবং ড্রেজিং করতে হবে। আমাদের শিশুদের সাঁতার শিখাতে হবে। বৃষ্টির পানি নিরাপদে সংগ্রহে রাখার ব্যবস্থা করতে সচেতন হতে হবে, যাতে বন্যায় ও খরার সময় নিরাপদ পানির ব্যবস্থা থাকে, বছরের যে সময় বন্যা হয়, সে সময় ঘরে শুকনো খাবারের ব্যবস্থা রাখা জরুরি। পার্বত্য চট্টগ্রাম ও অন্যান্য স্থানে পাহাড় কাটাসহ সারা দেশে বৃক্ষ নিধন বন্ধ করতে হবে। অধিক হারে বৃক্ষরোপণ জরুরি। ছোট বড় বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়নে সরকারের পাশাপাশি প্রয়োজন আমাদের সম্মিলিত উদ্যোগ এবং সচেতনতা। তবেই শুধু নিরাপদ হবে আমাদের শিশু ও নারীদের জীবন । 

পিআইডি- শিশু ও নারী উন্নয়নে সচেতনতামূলক যোগাযোগ কার্যক্রম (৫ম পর্যায়) প্রকল্প কার্যক্রম। 

লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক