Amar Sangbad
ঢাকা বুধবার, ১৬ জুলাই, ২০২৫,

আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলা ভাষা দেশীয় প্রেক্ষাপট

মোছা. জেসমিন আক্তার

ফেব্রুয়ারি ২৪, ২০২২, ০৮:৪০ পিএম


আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলা ভাষা দেশীয় প্রেক্ষাপট

প্রতিটি মানুষের কাছে পরম প্রিয় হলো মা, মাতৃভাষা ও মাতৃভূমি। এসবের যে কোনো একটি  শত্রু দ্বারা আক্রান্ত হলে যে কেউ হয়ে ওঠে প্রতিবাদমুখর। যেমনটি হয়ে উঠেছিল বাঙালি জাতি ৫২’র ভাষা আন্দোলন ও ৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে। আমরা বাঙালি জাতি, বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। 

আমাদের মাতৃভাষাকে কেড়ে নিতে চেয়েছিল তদানীন্তন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী; কিন্তু সংগ্রামের ঐতিহ্যে লালিত বাঙালি জাতি রুখে দাঁড়িয়েছিল, প্রতিবাদে ফেটে পড়েছিল আপামর জনসাধারণ। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ঢাকার রাজপথ শহীদের রক্তে  রঞ্জিত হয়েছিল। সেদিন বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছিলেন তারা বুলেটের সামনে। শহীদ হয়েছিলেন রফিক, শফিক, সালাম, বরকত, জব্বারসহ আরও নাম না-জানা অনেকে। রক্ত দিয়েছে বাঙালি জাতি, তবুও মাথা নোয়ায়নি, পিছপা হয়নি। এ অনমনীয় সংগ্রামের ফলেই বাংলা আজ আমাদের মাতৃভাষার, পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় ভাষাও।

বিগত ৭০ বছরে বাংলা ভাষা যেমন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে দেশের সর্বক্ষেত্রে, তেমনই তা ছড়িয়ে পড়েছে সারা বিশ্বে। এটি আমাদের জন্য পরম গর্বের। পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার প্রায় তিন শতাংশ মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলে। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর প্যারিস অধিবেশনে বাংলাকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে উদ্যাপন করার প্রস্তাব উত্থাপন করা হলে ১৮৮টি দেশ তাতে সমর্থন জানায় এবং একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ২০০০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে দিবসটি জাতিসংঘের সদস্য দেশসমূহে যথাযথ মর্যাদায় পালিত হয়ে আসছে। একই বছরের ২১ অক্টোবর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৬৫তম অধিবেশনে প্রতি বছর একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করবে বলেও জানায়। 

অর্থাৎ, বাংলা আজ শুধু দেশেই নয়, দেশের বাইরেও তার অবস্থান সুউচ্চ। ২০১৬ সালে অস্ট্রেলিয়ার সংসদ বাংলাকে স্বীকৃতির বিষয়ে বিল পাস করে। ফলে বাংলা ভাষা লাভ করে এক অনন্য মর্যাদা। আফ্রিকার দেশ সিয়েরা লিওনে বাংলা ভাষাকে সরকারি ভাষার মর্যাদা দেয়া হয়েছে। বর্তমানে প্রায় ৩০টি দেশের ১০০ বিশ্ববিদ্যালয়ে চালু রয়েছে বাংলা বিভাগ। সেখানে প্রতি বছর হাজার হাজার অবাঙালি  বাংলা ভাষা শিক্ষা ও গবেষণার কাজ করছে। বাংলা ভাষা, সাহিত্য, ইতিহাস ও সংস্কৃতি নিয়ে বহির্বিশ্বে ভারত ও বাংলাদেশের পর ব্রিটেন এবং যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে বেশি চর্চা হয়ে থাকে। 

এর বাইরে চীন, জাপান, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, জার্মানি, পোল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশে বাংলা ভাষার সংস্কৃতিচর্চা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রে কমপক্ষে ১০টি বিশ্ববিদ্যালয় ও এশীয় গবেষণা কেন্দ্রে বাংলা ভাষার চর্চা হচ্ছে। বিশ্বের ছয়টি দেশের রাষ্ট্রীয় বেতারে বাংলা ভাষার আলাদা চ্যানেল রয়েছে। আরও ১০টি দেশের রেডিওতে বাংলা ভাষার আলাদা অনুষ্ঠান সম্প্রচার করা হচ্ছে। ব্রিটেনে ছয়টি ও যুক্তরাষ্ট্রের ১০টি বাংলাদেশি মালিকানাধীন ও বাংলা ভাষার টেলিভিশন চ্যানেল রয়েছে। ব্রিটেনে ১২টি  বাংলা সাপ্তাহিক পত্রিকা বের হয়। 

‘বেতার বাংলা’ নামে সেখানে একটি বাংলা রেডিও স্টেশন রয়েছে। ইউরোপের ইতালিতে বর্তমানে পাঁচটি  বাংলা দৈনিক পত্রিকা এবং রোম ও ভেনিশ শহর থেকে তিনটি রেডিও স্টেশন পরিচালিত হচ্ছে। ইতালি থেকে ছয়টি অনলাইন টেলিভিশন এবং ব্যক্তিগত উদ্যোগে শতাধিক ফেসবুক টেলিভিশন চালু রয়েছে। এছাড়াও ডেনমার্ক, সুইডেনসহ ইউরোপের আট দেশ এবং মধ্যপ্রাচ্যের ছয় দেশ থেকে বাংলা ভাষায় মুদ্রিত ও অনলাইন পত্রিকাও প্রকাশিত হয়।

ইংরেজ আমল থেকে এ দেশের আইন-আদালতে ছিল ইংরেজি ভাষার ব্যবহার। বর্তমানে দেশের নিম্ন আদালত থেকে শুরু করে উচ্চ আদালতের বেশিরভাগ রায় ও আদেশ দেয়া হয় বাংলায়। এমনকি উচ্চ আদালতে বাংলায় রায় ও আদেশ দেয়ার প্রবণতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। হাইকোর্ট বিভাগের অন্তত দুজন বিচারপতি নিয়মিত বাংলায় রায় ও আদেশ দেন। এর বাইরে কয়েকজন বিচারপতি বাংলায় নিয়মিত আদেশও দিচ্ছেন। এক দশক আগেও উচ্চ আদালতে বাংলায় রায় ও আদেশের সংখ্যা ছিল হাতেগোনা। অথচ শুধু ২০২০ সালে পাঁচ হাজারেরও বেশি রায় ও আদেশ বাংলায় দিয়েছেন বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম। প্রতি সপ্তাহে তিন শতাধিক মামলায় বিভিন্ন আদেশ দেয়া হয় বাংলায়।

নিজের ভাষায় তথ্য খোঁজার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রয়েছে নিজেদের সার্চ ইঞ্জিন। আমাদের বাংলা ভাষায় তথ্য ও বাংলাদেশি বিষয় খোঁজার সুবিধা নিয়ে দুটি বাংলাদেশি ‘সার্চ ইঞ্জিন’ রয়েছে ইন্টারনেটে। ২০১৩ সালের এপ্রিলে ‘পিপিলিকা ডটকম’ প্রথম সার্চ ইঞ্জিন হিসেবে যাত্রা করে। এরপর ২০১৮ সালের মে মাসে ‘চরকি ডটকম’ নামের দ্বিতীয় সার্চ ইঞ্জিনটি যাত্রা করে।

ধর্ম-জাতি-জীবনাচারের সূক্ষ্ম প্রভাব নিয়ে উত্তরাধিকার সূত্রে বাংলা ভাষার শরীর গঠন হয়েছে। ভাষা এমন এক বিষয়, যা রাজনৈতিক মানচিত্রের সীমারেখা মেনে চলে না। ভাষা আঞ্চলিক কথন-কাঠামোয় গড়ে ওঠার প্রভাব প্রবহমান ধারায় বয়ে যাওয়া একটি আদি ঐতিহ্য। তাই আদিকাল থেকেই এ দেশের সব অঞ্চলের ভাষার বিচিত্র তারতম্য মিলেমিশে তৈরি করেছে বাংলা ভাষার অবয়ব। এভাবেই বাংলা ভাষার বহমানতা, সমৃদ্ধি, ব্যাপ্তি ও বিকাশ। 

বাংলা ভাষার এই গতিশীলতাকে মাঝেমধ্যে প্রবল হয়ে উঠতে দেখেই সমাজে আশঙ্কার মেঘ জমে ওঠে। এ কথা তো সত্যি, প্রচলিত মূলধারার বাংলা ভাষায় ইংরেজি ছাঁচ অনেক দিনের আমদানি। সে সঙ্গে ভাষার অস্তিত্ব সংকটে প্রসঙ্গটিও উঠে আসে। কিন্তু বর্তমানে আমাদের দেশে বাংলা ভাষায় এমন কিছু অসংগতি দেখা যায়, যা সত্যিই ভাষা মর্যাদার পরিপন্থি। 

বর্তমানে ইংরেজি মাধ্যমের পড়াশোনাকে অভিজাত মনে করা হয়। অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, রাজপথে রক্তের বিনিময়ে বাংলা ভাষা অর্জন করলেও ইংরেজি মাধ্যমে পড়ানোটাই এখন হয়ে দাঁড়িয়েছে স্ট্যাটাসের অংশ। বহুমুখী শিক্ষাব্যবস্থার বৈষম্যই তৈরি করছে এই পার্থক্য। এছাড়াও মহাবিপদ হয়ে উঠেছে হিন্দি ভাষার সিরিয়াল এবং হিন্দিতে ডাবিং করা কার্টুন ও অন্যান্য অনুষ্ঠান।

 ছোট ছেলেমেয়েরা এসব হিন্দি সিরিয়াল দেখে শুদ্ধ বাংলার পরিবর্তে হিন্দি রপ্ততেই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে— যা সত্যিই হতাশাব্যঞ্জক। বাংলা ভাষা এফএম বেতার ও টিভিসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রভাবে হিন্দি-উর্দু-ইংরেজি মিলিয়ে একটি মিশ্র ভাষারূপ অর্জনের পথে অনেক দূর অগ্রসর হয়েছে। আজকাল বেতার-টিভি চালু করলেই শোনা যায় ‘হ্যালো লিসেনার্স’, ‘হ্যালো ভিউয়ার্স’। বাংলা ভাষার মর্যাদার জন্য এসব যে খুব সুখকর নয়, তা বলার অবকাশ রাখে না।

যথাযোগ্য ব্যবহার, চর্চা আর সর্বজনীনতার ওপর ভাষার সমৃদ্ধি অনেকাংশে নির্ভরশীল। সমৃদ্ধি না ঘটলে ভাষা দীন হতে থাকে, একসময় বিলুপ্তিও ঘটে। পৃথিবীতে ভাষার মৃত্যু বা বিলুপ্তির এরূপ অনেক উদাহরণ আছে। ভাষা দীন-দুর্বল হয়ে যাওয়ার নানাবিধ কারণও রয়েছে। এর মধ্যে আছে বিকৃতি সাধন, রূপান্তর, ভাষার ব্যবহারে অসচেতনতা, অপব্যবহার প্রভৃতি। বিশ্বায়ন, আকাশ সংস্কৃতি, ডিজিটাইজেশনের কারণে ইংরেজির অধিক ব্যবহারের প্রভাবে মাতৃভাষা প্রবহমানতা হারাচ্ছে। তার ওপর আছে বিদেশি ভাষার আগ্রাসন।

বাংলা ভাষা আমাদের অস্তিত্ব, আমাদের পরিচয়। এই পরিচয়কে নষ্ট করে দেয়া মানে আত্মপরিচয়কে বিকৃত করা। তাই সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলনধারা অব্যাহত রাখতে প্রয়োজন সবার সচেতনতাসহ সংশ্লিষ্ট মহলের সুদৃষ্টি এবং প্রতিবন্ধকতা দূরীকরণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা। তবেই আমাদের বাংলা ভাষার সর্বস্তরে প্রচলনের ধারা আরও বিকশিত হবে বলে বিশ্বাস করি। 

লেখক : রাজশাহী সরকারি মহিলা কলেজ শিক্ষার্থী