Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪,

চুরির বিষয়ে ইসলামের বিধান

মার্চ ২৫, ২০১৫, ১০:৫৬ এএম


চুরির বিষয়ে ইসলামের বিধান

 

সাধারণভাবে অপরের মাল গোপনে করায়ত্ত করাকে চুরি বলে। শরীয়াতের পরিভাষায়, কোনো বালিগ ও সুস্থ বিবেক সম্পন্ন ব্যক্তি কর্তৃক অপরের মালিকানাধীন কিংবা দখলভুক্ত নিসাব পরিমাণ কিংবা তার সমমূল্যের সম্পদ সংরক্ষিত স্থান থেকে গোপনে করায়ত্ত করে, তবে তাকে চুরি বলে।

চুরির মৌলিক উপদান : সুস্থ সমাজ বিনির্মাণে চুরি একটি মারাত্মক ও বিপর্যয় সৃষ্টিকারী নৈতিক অবক্ষয়। যা ফৌজদারী অপরাধ। চুরি অন্যায় পথে সম্পদ অর্জনের যে পথ প্রশস্ত করে ইসলাম তাকে হারাম ঘোষণা করেছে। তবে শরীয়াতে চুরি অপরাধ সাব্যস্ত হওয়ার জন্য চারটি মৌলিক উপদান বিদ্যমান থাকার কথা বলেছে। যেমন-

ক. চোর
খ. মালের মালিক
গ. চুরিকৃত সম্পদ
ঘ. গোপনে সম্পদ হস্তগত করা।

এ সব উপাদান একই সাথে পাওয়া গেলে চুরির শাস্তি প্রয়োগ করা হবে।

চোরের শাস্তি সাব্যস্ত হওয়ার শর্তাবলী : চোরের চুরির শাস্তি হিসেবে শরীয়াতের বিধান হাত কাটার শাস্তি প্রয়োগ করতে হলে নিম্নোক্ত ৮টি শর্ত বিদ্যমান থাকতে হবে।

১. প্রাপ্ত বয়স্ক, সুস্থ ও বিবেক সম্পন্ন হওয়া।
২. মুসলিম বা ইসলামী রাষ্ট্রের স্থায়ী বাসিন্দা হওয়া।
৩. চুরির উদ্দেশ্যে মাল হস্তগত করা।
৪. অপরের মাল জেনেশুনে হস্তগত করা।
৫. স্বেচ্ছায় ও প্রলোভনবশত চুরি করা।
৬. চোর ও মালিক পরস্পর রক্ত সম্পর্কীয় না হওয়া।
৭. হস্তগত মালের মধ্যে চোরের মালিকানা না থাকা।
৮. চুরির নিষেধাজ্ঞা সম্পর্কে জ্ঞান থাকা।

চুরিকৃত মালের সাথে সংশ্লিষ্ট শর্তাবলি : কোনো মালের ওপর চুরির অভিযোগ প্রমাণ করতে হলে মাল সম্পর্কিত নিম্নোক্ত শর্ত পূরণ হওয়া আবশ্যক। যেমন-

১. চুরিকৃত বস্তু প্রকৃত মাল হওয়া।
২. চুরিকৃত বস্তুর আর্থিক মূল্য থাকা।
৩. চুরিকৃত মাল তুচ্ছ বস্তু না হওয়া।
৪. চুকিৃত বস্তু সংরক্ষণযোগ্য হওয়া।
৫. চুরিকৃত বস্তু সাধারণভাবে সকলের জন্য বৈধ না হওয়া।
৬. চুরিকৃত মাল অপরের দখলভুক্ত হওয়া।
৭. চুরিকৃত মাল নিরাপদ সংরক্ষিত স্থান থেকে করায়ত্ত করা।
৮. করায়ত্বকৃত মাল চোর কর্তৃক পুরোপুরি নিজের দখলভুক্ত হওয়া।
৯. করায়ত্ত্বকৃত মাল চুরির নিসাব পরিমাণ মূল্যের হওয়া।
১০. মাল স্থানান্তর যোগ্য হওয়া।

চুরির শাস্তি : চোর যদি চুরি করে এবং সেটা প্রমাণিত হয় তবে শরীয়াতের বিধান অনুসারে তার হাত কাটা হবে। পবিত্র কুরআনে ঘোষণা করা হয়েছে-

الـسـارق والـسـارقـة فـاقـطـعـوا ايـديـهـمـا مـئـرا مـمـا كـسـيـا نـكـا لا مـن الـلـه والـلـه عـزيـز حـكيـم ـ

পুরুষ চোর ও নারী চোর উভয়ের হাত কেটে দাও। এটা তারা যা উপার্জন করেছে তার প্রতিফল এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে দৃষ্টান্ত। আর আল্লাহ তা‘আলা মহাপরাক্রমশালী ও বিজ্ঞানী।

চোরের হাত কাটার ব্যাপারে মুসলিম উম্মাহর অধিকাংশ চিন্তাবিদ একমত। তবে কোন হাত কাটতে হবে তা নিয়ে ইমামদের মধ্যে কিছুটা মতভিন্নতা রয়েছে। তবে চার মাযহাবেরর ইমামদের মতে প্রথমবার চুরি প্রমাণিত হলে ডান হাতের কবজি থেকে হাত কাটতে হবে। তবে একই ব্যক্তি দ্বিতীয়বার চুরি করলে বাম পা কেটে ফেলতে হবে। তৃতীয়বার চুরি করলে কি শাস্তি দেওয়া হবে তা নিয়ে ইমামগণের মাধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। হানাফী ও কতিপয় হাম্বলী ইমামের মতে তৃতীয়বারের চুরির শাস্তি হল কারাগারে আটক রাখা। মালিকী ও শাফিঈ ইমামগণের মতে, তৃতীয়বার চুরি করলে বাম হাত আর চতুর্থ বার চুরি করলে ডান পা কেটে ফেলতে হবে। তারপরও চুরি করলে তাকে কাগারারে আটক রাখতে হবে।

চুরি প্রমাণিত হওয়ার প্রমাণ : যে সব প্রমাণের ভিত্তিতে চুরি সাব্যস্ত হবে তাহল-

১. সাক্ষ্য প্রমাণ।
২. মৌখিক স্বীকৃতি।
৩. শপথ।
৪. লক্ষণ প্রমাণ।

এগুলো পাওয়া গেলে চুরি প্রমাণিত হবে।

চোরের চুরির শাস্তি রহিত হওয়ার কারণসমূহ : বিভিন্ন কারণে ও অবস্থার প্রেক্ষিতে চোরের চুরির শাস্তি রহিত হয়ে যায়। যেমন-

১. সুপারিশ।
২. ক্ষমা।
৩. তাওবাহ।
৪. স্বীকারোক্তি প্রত্যাহার।
৫. হদ অনুপযোগীদের সাথে চুরিতে অংশগ্রহণ।
৬. মালিকানা স্বত্ব অর্জন।
৭. হদ্দকার্যকারিতায় বিলম্ব।
৮. কর্তনের জন্য নির্দিষ্ট অঙ্গ না থাকা ইত্যাদি।

চুরির কুফল : চুরির মাধ্যমে সমাজে একাধিক কুফল প্রতিফলিত হয়। সামাজিক বিশৃঙ্খলার পাশাপাশি নৈতিক, আর্থিক ও পারস্পরিক অবস্থার সৃষ্টি হয়।

চুরির দ্বারা অপরের অধিকার হরণ করা হয়। অপরের মালিকানাভুক্ত সম্পদ অন্যায়ভাবে অনৈতিকভাবে দখল করা হয়। ফলে সম্পদের মালিকের মালের ওপর ন্যায়সঙ্গত অধিকার হরণ করা হয়। চুরির মাধ্যমে সৃষ্ট সংকট দ্বারা সমাজের স্বাভাবিক গতি প্রবাহ ব্যহত হয়, সামগ্রিক ও সমন্বিত উন্নয়ন ব্যহত হয়। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও শিল্প-কারখানায় চুরির মাত্রা বেড়ে গেলে শিল্পপতি ও বিনিয়োগকারীরা হতাশা ও হতদ্যোম হয়ে পড়েন। ফলে বিনিয়োগ কমে যায় এবং কর্ম সংস্থানের সংকট সৃষ্টি হয়।

সমাজে চৌর্যবৃত্তি বৃদ্ধির ফলে সামগ্রিক জীবনব্যবস্থায় নিরাপত্তাহীনতা বৃদ্ধি পায়, মানুষের মাঝে আতঙ্ক বৃদ্ধি পায়। সমাজে অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি পায়।

সর্বোপরি চুরির কুফল হল এর দ্বারা সমাজের মানুষের মাঝে আতঙ্ক বিরাজ করে, চোরের নৈতিক মান ধ্বংস হয়। সমাজের মানুষের সম্পদের নিরাপত্তাহীনতার কারণে মানুষের হক বুঝে পাওয়ার অধিকার ক্ষুণ্ন হয়। ফলে সমাজের সামগ্রিক শৃঙ্খলা ধ্বংস হয়।

চুরি প্রতিরোধে ইসলামের বিধান : কারো মালিকানাধীন সম্পদ গোপনে কিংবা মালিকের অগোচরে আত্মসাৎ করাকে চুরি বলে। চুরি মূলত হাক্কুল ইবাদকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। তাই ইসলাম যাবতীয় চুরিকে অবৈধ ও হারাম ঘোষণা করেছে। চোরের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার কথা দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করেছে। সমাজ থেকে চুরির ন্যায় জঘন্য অপরাধ প্রতিরোধ করতে হলে নিম্নোক্ত বিধানগুলো অনুসরণ করা যেতে পারে।

১. ইসলামের দণ্ডবিধি মেনে চলা : ইসলাম চুরির প্রতিকার ও প্রতিবিধানে মানবতার স্বার্থে এমন কিছু বিধান দিয়েছে যাতে সে অন্যের গুপ্ত কিংবা প্রকাশ্য বস্তুর প্রতি লালায়িত না হয়। যেমন ইসলামের যাকাত বিধান। তারপরও কেউ যদি অন্যের মালের প্রতি সীমালঙ্ঘন করে তার জন্য শাসকের পক্ষ থেকে চুরির উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে। যেমন পবিত্র কুরআনে ঘোষণা করা হয়েছে-

الـسـارق والـسـارقـة فـاقـطـعـوا اسـديـهـمـا جـراء بـمـا كـسـبـا نـطلا مـن الـلـه والـلـه عـزيـز حـكيـم ـ

পুরুষ কিংবা নারী চুরি করলে তাদের হাত কেটে দাও। তা তাদের কৃতকর্মের ফল এবং নির্ধারিত আদর্শদণ্ড। আল্লাহ পরাক্রমশালী প্রজ্ঞাময়। (সূরা মায়িদা আয়াত : ৩৮)

তাই দেখা যায়, ইসলামী বিধানে চোরের হাতকাটার আইন জারি না করা পর্যন্ত চুরির পাপের মূল্যোৎপাটন সম্ভব নয়।

২. চোরের প্রতি ঘৃণা সৃষ্টি : চুরি করা অত্যন্ত জঘন্য কাজ। এটি একদিকে বদভ্যাস অন্যদিকে হাক্বুল ইবাদকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। চুরি হওয়া মালের মালিকের অপরিমেয় ক্ষতি হয়। সমাজ থেকে এটি বন্ধ করতে হলে সামাজিকভাবে চোরের প্রতি ঘৃণা সৃষ্টি করতে হবে। চুরির পেশার সাথে সংশ্লিষ্টদের বয়কট করতে হবে। তাহলে এটি প্রতিকার করা সম্ভব।

৩. সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা : বর্তমান সমাজ ব্যবস্থার দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায় সম্পদের প্রতি লোভ মানুষকে বিভিন্ন পাপের দিকে ধাবিত করছে। এর মধ্যে চুরির পাপ অন্যতম। চুরির ঘটনা এত বেশী বিস্তার লাভ করেছে যে, চুরির মামলায় কোর্টগুলো সদা-সর্বদা ব্যতি বায়ু সময় কাটাতে হয় বিচারকদের চোরের বিচারের যথেষ্ট সময় ব্যয় করতে হয়। এ থেকে প্রতিকার পেতে হলে চোরের প্রতি সামাজিক ঘৃণা সৃষ্টির মাধ্যমে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। চোরদের সামাজিকভাবে বয়কট করতে হবে। তাদেরকে যাবতীয় লেনদেন থেকে বিচ্ছিন্ন করার মাধ্যমে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারলে চুরির সামাজিক অনাচার প্রতিকার করা সম্ভব হবে।

৪. কর্ম সংস্থানের ব্যবস্থা : যারা চুরি করে অন্যের সম্পদ আত্মসাৎ করে তাদের শ্রেণীবিন্যাস করলে দুই শ্রেণীর লোক পাওয়া যায়। একটি শ্রেণী হয় বেকার নতুবা অভাবী। যে কারণে সে নিরূপায় হয়ে চৌর্যবৃত্তিতে আত্মনিয়োগ করেছে। অপর শ্রেণীটি অভাবী নয় বরং স্বভাবের কারণ কিংবা লোভাতুর হয়ে চুরি করে। দ্বিতীয় শ্রেণীকে চুরির যথার্থ শাস্তি দিয়ে এবং প্রথম শ্রেণীকে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে সমাজ থেকে বহু চুরির অপরাধ কমানো সম্ভব হবে।

৫. পুনর্বাসন কর্মসূচি গ্রহণ : যারা বেকারত্ব কিংবা অভাবের কারণে চুরির সাথে সংশ্লিষ্ট তাদের চি‎হ্নিত করে পুনর্বাসন করতে পারলে এ অপরাধ থেকে ফিরিয়ে রাখা সম্ভব হবে। বেকারত্ব একটি অভিশাপ। এ অভিশাপ অনেক সম্ভাবনাময়ী জীবনকেও ধ্বংস করে। কর্মসংস্থান কিংবা পুনর্বাসন সুস্থ সমাজ গঠনের জন্য নিয়ামক।